সম্পর্ক একটা নির্ভেজাল দুধ সাদা বস্তু। তাকে কোন কিছু দিয়েই পৃথক করা যায় না। শুধুমাত্র নামকরনের দৌরাত্ম্যে তাকে আমরা আলাদা ভাবে চিনি। কিন্তু যে সম্পর্কের কোন নাম নেই, যে সম্পর্কের কোন অস্তিত্ম নেই তাদের? আপনারা বলবেন অনেক কবি কাব্য করে লেখে সম্পর্কের কোন নাম নেই, সে শুনেছি, কিন্তু যার অস্তিত্ম নেই, তাহলে সেটা কি সম্পর্ক নয়। আমি বলব হ্যাঁ হয়, অস্তিত্ম না থাকলেও সম্পর্ক হয়। অন্তত আমার তো হয়।
আমার বাড়ির পাশের আম গাছটায় এখনও অবধি মুকুল আসে নি। আমি যে আম খাই সে আম আমার বাবা বাজার থেকে কিনে আনে। আমাদের পাশের কারোর আম গাছ নেই। তাই বাড়ি বয়ে এসে কেউ তার নিজের গাছের আম দিয়ে যায় না। কিন্তু আমার তাতে সমস্যা হয় না কারন আমি তো আম খাই, বাজারের আম।
মাছ খুব একটা বেশি আমি পছন্দ করি না। তাও গুটিকয়েক মাছই খাই। কিন্তু আমার মনে পড়ে বছর দুয়েক আগে আমি বেনামি এক মাছ খেয়েছিলাম। তাজা পুকুরের মাছ। আমার বন্ধুর মামাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে, জায়গাটার নাম ঠিক মনে নেই, তবে শেওরাফুলি থেকে অনেকটা যেতে হয় আরও। আমার বাড়ির পাশে আর একটাও পুকুর নেই। আর আমার কোনদিন পুকুরের কোন বেনামি মাছ খাওয়া হয় নি।
কেমন একটা যোগাযোগহীন কথা লিখে যাচ্ছি মনে হচ্ছে। সম্পর্ক, আম, মাছ। কোনটার সাথে কোনটার মিল নেই, সম্পর্ক নেই। আসলে প্রথমে যে অস্তিত্মহীন সম্পর্কের কথা বলছিলাম। এই বিষয়গুলোর সাথে আমারও সেই সম্পর্ক। আমি কোনদিন দালানবাড়ি দেখিনি। আমি কোনদিন নিজেদের দীঘি দেখি নি। আমি কোনদিন পালকিতে চড়িনি। ছোটবেলা থেকেই আমি দশ বাই বারোর ঘরে বড় হয়েছি সবার সাথে। মা,বাবা,দাদু,ঠাকুমা, কাকা, কাকি আরও সবার সাথে। একান্নবর্তি পরিবার। বাড়িতে বড় হাড়িতে দিনে দুবার ভাত হত। ঠাকুমা বলত “আমাগো দেশের বাড়িতে এর থেইক্যাও বড় হাড়িতে ভাত হত, তখন কত লোক খেত”। আমি তখন দেশের বাড়ি বুঝতাম না। কারন আমদের তো আর কোন বাড়ি নেই, এই একটাই তো বাড়ি। মাও গল্প করত ছোটবেলায় যখন মা দিদার সাথে হাত ধরে চাল ধুতে পুকুরে যেত তখন নাকি সরপুঁটি মাছ এসে জলে পড়ে যাওয়া চাল খেয়ে যেত। আমি তখনও বুঝতাম না মা কোন পুকুরের কথা বলছে, আমাদের বাড়ির পাশে তো কোন পুকুর নেই আর মামাবাড়ির আশেপাশেও নেই, তাহলে কোন পুকুর। আর সরপুঁটি মাছ, সেটা কেমন? আমি তো খাই নি কখনও।
তখন বুঝতাম না কিছু। কোন দেশের কথা বলা হচ্ছে। ছোটবেলায় দেখেছি, কানাইয়ের মাকে। মাঝে মাঝেই দুপুরের দিকে আসত, ছোট ছেলেটাকে নিয়ে। এসে কখনও দেখতাম নারকেল ছুলে দিত, বা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে গল্প করে যেত। আর চেয়ারে বসে দাদু সে গল্প শুনত। একদিন এসে বলল নেপাল জ্যাঠা নাকি মারা গেছেন। কে নেপাল জ্যাঠা? আমি তো কোনদিন তার নামও শুনিনি। কিন্তু কি আশ্চর্য সেদিন রাতে দাদুর ঘরে দুধ দিতে গিয়ে দেখলাম দাদু তখনও ঘুমায়নি, আর তার গালে দু ফোটা জল। আমি সেদিন বুঝিনি। আজ বুঝি। পরে মাকে জিজ্ঞেস করাতে মা বলেছিল নেপাল দাদু নাকি দাদুর দেশের বাড়ির পাশে থাকত। মা এখনও কোন দেশের কথা বলে। আমি বুঝি না।
কানাইয়ের মাকে দেখতাম ঠাকুমা ভাত এনে দিলে সে অমনিই কত গল্প করতে করতে বারান্দায় বসে খেত। তার মুখেই প্রথম শুনেছিলাম দ্বিবার্ষিক আমের কথা। একবছর ছাড়া ছাড়া নাকি সে আম হয়, আমি আজও অবধি সেটা কখনও খাইনি। কানাইয়ের মা প্রতিবারই খাওয়ার আগে বলত, দিদি তোমাদের কারোর কম হবে না তো, তোমারা জানতে না আমি আসব। ঠাকুমা প্রতিবারই ধমকের সুরে বলত এই তুই এখন খা তো, না থাকলে তোকে দিতুম কি করে। আমি তখন জানতাম যে আজ দুপুরেও মাকে মুড়ি খেয়েই থাকতে হবে। কারন কালও দুপুরবেলা কাকার এক বন্ধু এসেছিল আর তাকে খাবার দেওয়ার পর মার জন্য কিছু ছিল না। কারন মা সবার শেষে খায়। কিন্তু কি আশ্চর্য হজমিগুলি খাওয়ার জন্য মার কাছ থেকে যখন ৫০ পয়সা চাইতে গেলাম তখন দেখলাম মা রান্না ঘরে বসে খাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম মা কি করে খাচ্ছে। সেদিন মাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয় নি। আজও অবধি করিনি সেদিনের খাবার কথা থেকে এসেছিল। হয়ত সেদিন একটু বেশীই রান্না হয়েছিল।
আমরা ওই ছোট ঘর একান্নবর্তি পরিবার ছেড়ে আজ বেশ কিছুদিন হল নতুন বাড়ি করে চলে এসেছি। তবুও খুব বেশি দূর না হওয়ায় রোজই প্রায় সময় পেলে পুরানো বাড়িতে যাই। কিন্তু অনেকদিন কানাইয়ের মাকে দেখি না। আগে দেখতাম লক্ষ্মী পুজার দিন, জন্মাষ্টমীর দিন ও বিভিন্ন পুজার দিন কানাইয়ের মা আসত। এখন বহু বছর হয়ে গেছে দেখি না। কিন্তু এই কানাইয়ের মা কে ছিল আজও জানতে পারলাম না। মাকে অনেকদিন আগে কারো সাথে গল্প করতে শুনেছিলাম, মার বিয়ের অনেক আগে নাকি কানাইয়ের মা এ দেশে চলে এসেছিল তার আগে বেশ কিছুদিন স্মরনার্থি শিবিরে ছিল। দাদুই নাকি গিয়ে নিয়ে এসেছিল। ওর স্বামীর নাকি খোঁজ পাওয়া যায় নি।
আজ এতগুলি দিন পড়ে এসে আমি কানাইয়ের মাকে চিনতে পারি। আমি স্মরনার্থি শিবিরকে দেখতে পাই। আমি সেই রেললাইনটাকে দেখতে পাই যেটা আজ সীমান্ত হয়ে গেছে, কিন্তু বেশ কিছু বছর আগে ওখান থেকে ট্রেনে করে নেমেই নাকি ওপারে যাওয়া যেত। আজ নাকি আর যাওয়া যায় না। আজ এক অদৃশ্য বেড়াজাল নাকি এপার থেকে ওপারকে আলাদা করে দিয়েছে।
আজ আমি মায়ের মুখে, ঠাকুমার মুখে শোনা দেশের কথা জানতে পারি, সেই দেশ কি বুঝতে পারি। কিন্তু না, সে দেশকে আমি কখনও না দেখেও কখনও তার মাটির সুগন্ধ না পেয়ে, কখনও তার ধানের শিষে হাত না বুলিয়েও বুঝতে পারি সে দেশের মাটির সাথে আমার দেশের মাটিরও কোন অমিল নেই। সে দেশের বাতাসেরও যে সুগন্ধ, আমিও তো সে সুগন্ধই পাই। সে দেশের নদীর যে গতিময়তা আমার বাড়ির পাশের নদীরও তো সেই একই গতিময়তা। সে দেশের মানুষ গুলোও তো আমাদের মতনই, তারাও তো বাংলা ভাষায় কথা বলে তারাও তো রবিঠাকুরের গান গায়। তবে কেন সে দেশ আমার দেশ নয়, তবে কেন এ দেশ তাদের দেশ নয়।
না, আমি না। আমি মানব না। এপার ওপার বলে কিছু নেই, এদেশ ওদেশ বলে কিছু নেই। এদেশি, বাঙাল বলে কিছু নেই। আমরা এক ও অভিন্ন। ধর্মের নামে যারা তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার নামে মাঝখান দিয়ে একটা অদৃশ্য রেখা টেনে দেশ টাকে ভাগ করে দেয়, যাদের ক্ষুদ্রান্নেসি স্বার্থের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা হল, লক্ষ লক্ষ কানাইয়ের মা তাদের নিরুদ্দেশ স্বামীকে ছেড়ে এল, একটা এক ও অভিন্ন জাতিকে শুধুমাত্র ভাগ করে দেওয়া হল। তারা চিরতরে শান্তিতে এখন কবরে শুয়ে আছে। কিন্তু আমরা আজও ওরা আমরা লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশের পাড়ার নিলাদির সঞ্জয়দার সাথে বিয়ে হয় না, নিলাদি কষ্টে দুঃখে আজও প্রাইমারী স্কুলের চাকরি করে একা একা থাকে। সঞ্জয়দার কোন খবর পাই না। সঞ্জয়দারা এদেশি ছিল বলে নাকি নিলাদির বাবা ওর সাথে নিলাদির বিয়ে দেননি। আজ যখন আমি আমার প্রেমিকার কথা বলি, নিলাদি আমায় জিজ্ঞেস করে ওরা কি এদেশি না বাঙাল? আমি বলি আমি তো সেটা জানি না। আর আমি এসব মানিও না। নিলাদি আমায় বলে তুই না মানলেও এখনও অনেক মানুষ আছে যারা এসব মানে। আসলে কি জানিস এপারের মানুষ গুলো যেমন ওপারের মানুষগুলোকে বিশ্বাস করতে পারে না তেমনি এপারের মানুষগুলো ওদের বিশ্বাস করতে পারে না। কেন বলত দেশটা ভাগ হল? তাহলে তো সবাই সবাইকে বিশ্বাস করত। আজ হয়ত তাহলে সঞ্জয়ও আমার পাশে থাকত, আর তুই এই শীতের দুপুরে আমার খোকাকে কোলে নিয়ে আমাদের সাথে কোথাও ঘুরতে যেতে পারতিস। আমি নিলাদির মুখে একটা হাসি লক্ষ্য করি। কিন্তু তার থেকেও বড় তার রাগটা লক্ষ্য করি, তার দুঃখটা লক্ষ্য করি। আমি চিৎকার করে বলি নিলাদি এসব ভেদাভেদ কিছু নেই, আমি মানি না, আমরা সবাই এক। বীরভূম এক বরিশাল এক, মালদা এক সিলেট এক, কলকাতা এক ঢাকা এক, পশ্চিমবাংলা এক বাংলাদেশ এক। কিন্তু নিলাদি সে কথা শুনতে পায় না। সঞ্জয়দার পুরানো একটা কবিতা নিজের মুখেই আবৃত্তি করে ওঠা। ওর মুখে এর আগেও এটা বহুবার শুনেছি। সঞ্জয়দার এটাই নাকি ওকে প্রথম দেওয়া উপহার ছিল।
আমি ওর ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসি, রাস্তা দিয়ে একা একা হেঁটে যাই। রাস্তায় কেউ নেই। শীতকাল একেই, তার ওপর অনেক রাত হয়েছে। নিলাদির জন্য মনটা আজ বড় খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু তার চেয়েও খারাপ হয়ে গেল তাদের জন্য যারা আজও এদেশটাকে তাদের মানতে পারল না, আর দুটো দেশকে আলাদা করে দিল।
দুটো দেশই এক, দুটো দেশের মানুষ এক, দুটো দেশের ফসল এক, দুটো দেশের মাটি এক, দুটো দেশের বায়ু এক, আমরা সবাই এক। আমরা কেউ হিন্দু নই, আমরা কেউ মুসলিম নই, আমরা কেউ এদেশি নই, আমরা কেউ বাঙাল নই, আমরা সবাই বাঙালি। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, মোদের গর্ব মোদের আশা আমরি বাংলা ভাষা।
যে স্বরে বন্দেমাতরম বলি, সেই স্বরেই জয় বাংলা বলি। যে আবেগ নিয়ে জন গন মন অধিনায়ক গাই ঠিক সেই আবেগই এসে চোখের কোনে জমা হয় সোনার বাংলা শুনি।
তাই বারবার বলি, বলব, মানি, মানব...আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। তাই যে দেশকে আমি দেখেনি, যে দেশের মানুষকে আমি দেখেনি, যে মাটি শুঁকি নি, যে দেশের হাওয়া খাইনি, সেই দেশের সব কিছুর সাথে আমার সম্পর্ক আছে। অস্তিত্ম না থেকেও, এ সম্পর্কের আশা আছে, ভরসা আছে, আবেগ আছে, আনন্দ আছে। সর্বোপরি রক্তের বাইরে এসেও আমার আত্মার সাথে এক গভীর সম্পর্ক আছে, যে সম্পর্কের কোন নাম নেই, কোন অস্তিত্ম নেই, শুধু এর প্রভাব আছে আমার মধ্যে।
সর্বশেষে ধন্যবাদ সেই সমস্ত মানুষদের যারা আমার মধ্যে এভাবে চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। ধন্যবাদ ঋত্বিক কুমার ঘটক, ধন্যবাদ তারেক মাসুদ, ধন্যবাদ কল্লোল লাহিড়ী।।
ছবি সৌজন্যেঃ কল্লোল লাহিড়ী।