somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ ডা.জোহরা বেগম কাজীর ১০২তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা খ্যাত বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ, স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ অধ্যাপিকা ডা. জোহরা বেগম কাজী। এদেশের বাঙালি মুসলিমদের মাঝে তিনিই সর্বপ্রথম মহিলা চিকিৎসক। তার পুরো জীবনই ছিল আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত। তিনি যখন চিকিৎসক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তখন মেয়েরা নানা রকম অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের শিকার ছিল। অসুস্থ মেয়েরা চিকিৎসকের কাছে না যেয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নিত। কারণ তাদের ধারণা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার চেয়ে মৃত্যুই ভাল। তখন অপচিকিত্‍সা আর বিনা চিকিৎসায় মারা যেত মেয়েরা। মেয়েদের অধিকাংশ রোগকে জিন-ভূতের আছর বলে মনে করত সবাই। সেসময় মেয়েরা মনে করত বাড়ির বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করালে মেয়েদের ইজ্জত থাকেনা। একারণে মেয়েরা নিজের ইজ্জতকে বাঁচানোর জন্য বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) যে মহিলা চিকিৎসকের শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণের জন্য অনন্য নারী হিসেবে ডা. জোহরা বেগম কাজী। ১৯১২ সালের আজকের দিনে ভারতের মধ্য প্রদেশে জন্মগ্রহন করেন এই মহিয়সী নারী চিকিৎসক। আজ তাঁর ১০২তম জন্মদিন। মানবতাবাদী চিকিৎসক জোহরা বেগম কাজীর জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা


ডা. জোহরা বেগম কাজী ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজনান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলার কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রাম ছিল তাঁর আদি পৈত্রিক নিবাস। পিতার নাম ডাক্তার কাজী আব্দুস সাত্তার। মা মোসাম্মদ আঞ্জুমান নেসা। তিনি রায়পুর পৌরসভার প্রথম মহিলা কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁরা চার বোন ও দুই ভাই। বড় ভাই কাজী আসরাফ মাহমুদ। তাঁর বড় ভাই মাইক্রোবায়োলজিতে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। ছোট এক ভাই কাজী মোহসিন মাহবুব ও বড় দুই বোন অকালে মৃত্যুবরণ করেন। আর ছোট বোন ডাক্তার শিরিন কাজী। তিনি এদেশের দ্বিতীয় বাঙালী মহিলা চিকিৎ‍সক। জোহরা কাজী ১৯২৯ সালে আলিগড় মুসলিম মহিলা স্কুল থেকে প্রথম বাঙালি মুসলিম আলিগড়িয়ান হিসাবে এসএসসি পাশ করেন । এর পর দিল্লির পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত 'লেডি হাডিং মেডিকেল কলেজ ফর ওমেন' এ ভর্তি হন এবং সেখান থেকে প্রথম বাঙালী মুসলিম ছাত্রী হিসাবে প্রথমে এইচ.এস.সি. এবং পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালে ২৩ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমবিবিএস পাস করেন।


১৯৩৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করার পর জোহরা বেগম কাজী কর্মজীবনে প্রবেশ করেন৷ তিনি প্রথমে ইয়োথমাল ওয়েমেন্স(পাবলিক) হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগদেন৷ এরপর বিলাসপুর সরকারী হসপিটালে যোগ দেন৷ মহাত্মা গান্ধীর পরিবারের সাথে তাঁদের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। উভয় পরিবারের মধ্যে যাতায়াতও ছিল। একসময় মহাত্না গান্ধী প্রতিষ্ঠিত সেবাগ্রাম আশ্রমে তিনি, তাঁর বাবা এবং তাঁর ছোট বোন বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছেন। এছাড়াও তিনি ভারতের বিভিন্ন বেসরকারী ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে ডাক্তার হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে যোগ দেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় অবসর সময়ে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অনারারি কর্ণেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন৷ মিডফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় অবসর সময়ে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অনারারি কর্নেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেবার পর বেশকিছু বছর হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসাবে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন৷ পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেলে অনারারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন৷


(জাতীয় জাদুঘরে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক এম.এ. হাদী, অধ্যাপক শাহানা খাতুন ও অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সাথে জোহরা কাজী)
ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ৩২ বছর বয়সে তৎকালীন নরসিংদির রায়পুরের হাতিরদিয়া গ্রামের জমিদার পরিবারর সদস্য, সমাজসেবক ও সাবেক এমপি রাজউদ্দিন ভুঁইয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বৈবাহিক জীবনে নিঃসন্তান হলেও দুইমাস বয়সে পারিবারিক বন্ধুর ভাগ্নে আবিদ ইকবালকে পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে ডা. জোহরা বেগম কাজী বিভিন্ন খেতাব ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘তখমা-ই পাকিস্তান’ খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি ‘ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) তাকে বিএমএ স্বর্ণপদক প্রদান করে। ২০০২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘রোকেয়া পদক’ প্রদান করেন। ২০০৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) প্রদান করে সম্মানিত করেন। এছাড়াও তাঁকে ভাইসরয় সম্মানজনক ডিগ্রি প্রদান করা হয়। তিনিই একমাত্র চিকিৎসক যিনি ইংল্যান্ড থেকে অনারারি এমআরসিইওজি পেয়েছেন। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির মহিলা কমিশনার নিযুক্ত হন। প্রথম বাঙ্গালী মহিলা চিকিৎ‍সক ডা. জোহরা বেগম কাজী মেয়েদের বিভিন্ন কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে তাদেরকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। তিনি মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। সমাজ থেকে অজ্ঞতা দূর করার জন্য তিনি দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করেছেন। মানবতাবাদী চিকিৎসক ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর ৯৭ বৎ‍সর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শতাব্দীর এ আলোকবর্তিকা আজ নিভে গেছে তবে তার কীর্তি তাকে অমর করে রাখবে। আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত প্রচারবিমুখ এই মহীয়সী নারী তাঁর কর্মের মাধ্যমে আমাদেরকে আলোর পথ দেখাবেন সবসময়।


ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা খ্যাত মানব কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা এই মহীয়সী নারীর আজ ১০২তম জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ প্রথম বাঙ্গালি মুসলিম মহিলা চিকিৎসক জোহরা বেগম কাজীর জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×