somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রথিতযশা বাঙালি কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা কামিনী রায়ের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা

১২ ই অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাহিত্য ক্ষেত্রে “রূপসী বাংলার” কবি জীবনান্দ দাশের পরেই প্রধান কবি কামিনী রায়। তিনি একাধারে ছিলেন একজন কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা; তদুপরি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক। তৎকালে মেয়েদের শিক্ষা বিরল ঘটনা ছিল। সেই সময়ে কামিনী রায় নারীবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। লিখেছিলেন সব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ও নারী জাগরণের পক্ষে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ করে নারীকল্যাণে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। কামিনী রায় ভারতের প্রথম মহিলা অনার্স গ্র্যাজুয়েট এবং তিনি সব সময়ই শিক্ষানুধ্যায়ীদের ভালোবাসতেন, উৎসাহ দিতেন ও সহযোগিতা করতেন অন্য নারী সাহিত্যিকদের। তিনি ১৯২৩ সালে এক সম্মেলনে বরিশাল এলে কবি বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাকে লেখালেখির বিষয়ে প্রবল উৎসাহ দেন এবং মনোনিবেশ করতে বলেন। তিনি ১৯২২-২৩ সালে নারীশ্রম তদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন। আজ কবি কামিনী রায়ের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৬৪ সালের এই দিনে তিনি বরিশালের ঝালকাঠিতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে কবির জন্য আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা।


(কবি কামিনী রায়ের বাড়ি বাসণ্ডা, ঝালকাঠি)
কবি কামিনী রায় ১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের চন্দ্রদীপ (বরিশাল জেলা)-এর অন্তর্গত বাকেরগঞ্জ মহুকুমার ঝালকাঠির বাসন্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম চন্ডীচরণ সেন এবং মাতার নাম বামাসুন্দরী দেবী; কামিনী রায় ছাড়াও তাদের আরেকটি কন্যা ও একটি পৃত্র সন্তান ছিলো। তার পিতা বৈচারিক পেশায় নিয়োজিত থাকলেও ব্রাহ্ম মতের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি সেবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কামিনী রায়ের পড়াশুনার হাতেখড়ি তার পরিবারের মধ্যেই, বিশেষত মায়ের কাছে। বাড়িতেই তিনি বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ এবং শিশুশিক্ষা শেষ করে নয় বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন এবং ওই বছরই আপার প্রাইমারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর ১৪ বছর বয়সে তিনি মাইনর পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। কামিনী রায় ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বেথুন ফিমেল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিকের সমমানের) পরীক্ষা ও ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ফার্স্ট আর্টস (উচ্চ মাধ্যমিকের সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই বেথুন কলেজ থেকে তিনি ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম নারী হিসেবে সংস্কৃত ভাষায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি বেথুন কলেজেই শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।


কবি কামিনী রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সংস্কৃত সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে খুব অল্প বয়স থেকে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত ‘আলো ও ছায়া’ কামিনী রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। কামিনী রায় কবিতা লেখার শুরুতেই মধ্যযুগের নৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং মহাজগতকে পরস্পর বিরুদ্ধ শব্দ দ্বারা চিনতে শিখেছিলেন। পৃথিবীকে ও তার বস্তুসমূহকে সাদা-কালো, আলো-আঁধার, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি বিপরীত শব্দ দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন এবং পরপর বিপরীত শব্দগুলো দ্বারা কবিতার বাক্য গঠন করেছিলেন। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে; যেমন_ ‘কেউ হাসে, কাঁদে কেউ/.....দুঃখে-সুখ রয়েছে বাঁচিয়া’, ‘জীবন ও মরণের খেলা’, ‘ভাসাইয়া ক্ষুদ্র তরী, দিবালোকে, অন্ধকারে’, জীবন-মরণ একই মতন’, ‘মুক্তবন্দি’ ইত্যাদি অনেক ধরণের বাক্য তিনি ব্যবহার করেছেন। বাঙালি প্রায় সব কালেই সবকিছুকে এরকম পরস্পর-বিরুদ্ধ ভাব দ্বারা ব্যাখ্যা করেছে যা দ্বান্দ্বিক হলেও যান্ত্রিকতা-দোষে দুষ্ট ও অবৈজ্ঞানিক; সাদা-কালোর মাঝেও অনেক স্তর রয়েছে; মানুষ শুধু ভালো বা মন্দ নয়, সে আরো অনেক কিছু; আলো-অন্ধকার নিয়েই মানুষের জীবন নয়, জীবনের নানা দিকে রয়েছে বৈচিত্রের বর্ণিল সমাহার। এরকম বিস্তৃত জায়গাতে মানুষকে কামিনী রায় দেখেছেন সাদা চোখে একদেশদর্শি মানুষের চিন্তার মতো।


কবি কামিনী রায়ের লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছেঃ আলো ও ছায়া (১৮৮৯), নির্মাল্য (১৮৯১), পৌরাণিকী (১৮৯৭), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অশোক সঙ্গীত (সনেট সংগ্রহ, ১৯১৪), অম্বা (নাট্যকাব্য, ১৯১৫), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), জীবন পথে (১৯৩০), একলব্য, দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্ন, শ্রাদ্ধিকী। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ‘মহাশ্বেতা’ ও ‘পুণ্ডরীক’ তাঁর দু’টি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এছাড়াও, ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন। আলো ও ছায়া (১৮৮৯) কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ যাতে নিঃসঙ্গতা, জীবন সম্পর্কিত প্রশ্ন, জগতবোধ, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি খাপছাড়াভাবে ফুটে উঠেছে। এ-বইটিতে কবি অত্যন্ত জটিল ও অদৃশ্য অনেক কিছুকে নিয়ে ভাবিত থেকে কবিতা লেখার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।


তাঁর কবিতা পড়ে বিমোহিত হন সিবিলিয়ান কেদারনাথ রায়। ১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দে কামিনী রায়ের সাথে সাথে কেদারনাথ রায়ের বিয়ে হয়। তাদের ৩ টি সন্তান জন্মায়। প্রথম সন্তানটি জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই (১৯০০ সালের দিকে) মারা যায়, তার নাম জানা যায়-নি; অপর দুই সন্তানের নাম ছিলো লীলা রায় ও অশোকরঞ্জন রায়। ১৯০৩ সালে কামিনী রায়ের বোন কুসুম, ১৯০৬ সালে প্রথমে ভাই ও পরে বাবা মারা যায়। ১৯০৮ সালে তার স্বামী কেদারনাথ রায় ঘোড়ায় গাড়ী উল্টে গিয়ে আঘাত পেয় মারা যান এবং এর কয়েক বছরের মধ্যে তিনি সন্তান লীলা ও অশোককেও হারান। এভাবে মাত্র ৭ বছরের মধ্যে প্রায় সকল আপনজনকে হারিয়ে তিনি একেবারে নি:স্ব হয়ে ভেঙে পড়েন। প্রিয়জন হারানোর শোক ও দুঃখ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তার এই ব্যাথ্যাতুর হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি আমরা তার রচনায় খুজে পাই। কামিনী রায়ের কবিতায় বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ যেমনঃ আশা-নিরাশা, হর্ষ-বিষাদ, অবসাদ, আর্তনাদ, সুখ-দুঃখ, স্বর্গ-মর্ত, ভয়, আলো-আঁধার, অশ্রু, জীবন-মরণ, মলিন, শোক, বেদনা, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদির দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি জীবনের ইতি ও নেতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং কবিতার বিষয়বস্তুর দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে তিনি জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা, দুঃখ, বিষাদকেই প্রধান বিষয় করে তুলেছেন।


কামিনী রায় সবসময় অন্য সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতেন। ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দে তিনি বরিশাল সফরের সময় কবি সুফিয়া কামালকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নারী জাগরণে আসামান্য অবদান এবং তৎকালীন পশ্চাৎপদ সমাজের মধ্যে থেকেও প্রথম স্নাতক সম্মান ডিগ্রি অর্জন করায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবি কামিনী রায়ের স্মরণে ১৯২৯ সাল থেকে ‘জগত্তারিণী পুরস্কার’ প্রবর্তন করে। তিনি ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি ও ১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। শেষজীবনে কবি কামিনী রায় ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের হাজারীবাগে বসবাস করতেন এবং ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এখানেই তার জীবনাবসান ঘটে।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী `পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।

মানব-জীবনের লক্ষ্য ও কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ তা-ই আমরা জানতে পারি এই কাব্যাংশ থেকে; মানুষের এই জীবনের আলেখ্যের মূল রচিয়তা কবি কামিনী রায়। কামিনী রায়ের ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ কবিতার মর্মার্থ আজও আমাদের চলার পথে দ্বিধার পাহাড় ডিঙোতে প্রেরণা জোগায়।


উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যাজুয়েট, নীতি কাব্যের নারীবাদী কবি কামিনী রায়ের আজ ১৫০তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে কবিকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×