সত্তর দশকে বাংলাদেশের ঢাকাই চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি নায়িকা শবনম। ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামের আবিস্কার শবনম ঐ সময়ে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম - উভয় অংশেই সমানভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৫৬ সালে আব্দুল জ্বার খানের মুখ ও মুখোশ ছবির মাধ্যমে ঢাকার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। বাংলাদেশের ছবির পাশাপাশি একসময় নিয়মিত অভিনয় করেছেন পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে। ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০'র দশক পর্যন্ত একজন হিন্দু অভিনেত্রী হিসেবে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে বা ললিউডে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প বা ঢালিউডে অভিনয় করে যাচ্ছেন। আজ জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর জন্মদিন। ১৯৪০ সালের আজকের দিনে তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। রোমান্টিক নায়িকা শবনমের ৭৪তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।
১৯৪০ সালের ১৭ আগস্ট তৎকালিন পূর্বপাকিস্তানের ঢাকাস্থ মদন মোহন বসাক লেনে জন্মগ্রহণ করেন শবনম। তার প্রকৃত নাম ঝর্ণা বসাক। চলচ্চিত্রের রূপালী আকাশে তিনি শবনম নামে খ্যাত। তার পিতার নাম ননী বসাক। শবনমের অতীত জীবন বড়ই বর্ণাঢ্যময়। ছেলেবেলায় সারাক্ষণ মার্বেল খেলা এবং ঘুড়ি উড়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তিনি। একবার তো ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে যান। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এতো উপর থেকে পড়ে গিয়েও ব্যথা পাননি। শৈশবে নাচ শেখা শুরু করেন তিনি। এ জন্য বাবা ননী বসাক ওকে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। নাচ শেখার পরে শবনম সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত হতে থাকেন। ১৯৫৬-৫৭ সালে নৃত্যশিল্পী হিসেবে শবনমের খুব নাম হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী বুলবুল ললিতকলা একাডেমির নৃত্যকলা বিভাগের ছাত্রী থকাকালীন ক্যাপ্টেন এহতেশামের এদেশ তোমার আমার ছবিতে একটি দলীয় নৃত্য দৃশ্যে অভনয় করেন। এরপর নবারুন, রাজধানীর বুকে এবং আসিয়া ছবিতে প্রথম নৃত্যশিল্পী হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ। দেখতে লম্বা ছিপছিপে ফর্সা ছিলেন বলেই এহেতাশাম ও মুস্তাফিজের চোখে ধরা পড়ে গেলেন। ১৯৬০ সালে চুক্তিবদ্ধ হলেন ‘হারানো দিন’ ছবিতে নায়িকা হিসেবে। ১৯৬১ সালে বাংলা চলচ্চিত্র 'হারানো দিন' এর মাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন শবনম। ছবির শুরুতেই ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি/ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি/’ গানের দৃশ্যের সঙ্গে নাচতে নাচতে শবনম অনেকেরই প্রিয় নায়িকা হয়ে উঠলেন শবনম। ‘হারানো দিন’ ছবিটি রিলিজের পর শবনমকে দেশের সিনেমা দর্শকরা তকে বরণ করে নিলেন নায়িকা হিসেবে। সম্ভবতঃ বিশ্বে তিনিই একমাত্র চলচ্চিত্র অভিনেত্রী যিনি ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০'র দশক পর্যন্ত তিনটি দশক ধারাবাহিক ও সফলভাবে রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয় করে অগণিত দর্শক-শ্রোতার মন জয় করেছিলেন।
শবনমের প্রথম উর্দু ছবি হলো ‘তানহা’। এ ছবিতে একটি ছোট্ট চরিত্রে ছিলেন তিনি। ছবিতে একটি নাচের দৃশ্যে অংশ নিতে হয়েছিল তাকে। ওই ছবির নায়িকা ছিলেন লাহোরের শামীম আরা। ১৯৬০ সালে এ ছবির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ‘কখনও আসেনি’ ছবি থেকে শবনমের অভিনয় শুরু । ওই ছবিতে নায়ক আনিসের ছোট বোনের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। ‘কখনও আসেনি’ মুক্তি পায় ১৯৬১ সালের ২৪ নভেম্বর। শবনম যখন ঢাকার ছবির নায়িকা ছিলেন তখন ছিল পাকিস্তান আমল। ঢাকায় যেসব বাংলা ছবি নির্মিত হতে লাগল তা তেমন বাজার পেল না। এ জন্য ঢাকার চলচ্চিত্র নির্মাতারা গোটা পাকিস্তানে ছবির বাজার পাওয়ার জন্য অনেকেই উর্দু ছবি নির্মাণ শুরু করে দিয়েছিলেন। ঢাকার উর্দু ছবিতে শবনমেরই ছিল বেশি দাপট। ১৯৬২ সালে উর্দু চলচ্চিত্র 'চান্দা' ছবির মাধ্যমে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে রাতারাতি তারকাখ্যাতি পান। হারানো দিন ও চান্দা দু'টি ছবিই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় ঢাকায় নির্মিত হতে লাগ উর্দু ছবি, যেমন—চান্দা, তালাশ, প্রীত না জানে রীত, সাগর, ক্যায়সে কুহু, আখেরি স্টেশন, পয়েসে, কারওয়া, কাজল প্রভৃতি। এসব উর্দু ছবির নায়িকা ছিলেন শবনম। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শবনম পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন। সত্তর দশকের শুরুতে শবনম ললিউডে (লাহোর) পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন।
খ্যাতির তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর উপমহাদেশের বরেণ্য সুরকার ও সংগীত পরিচালক রবীন ঘোষের সঙ্গে শবনমের বিয়ে হয়। দাম্পত্য জীবনে তাদের একমাত্র সন্তান রনি ঘোষ। ঢাকার উর্দু ছবিতে শবনমের সাফল্য দেখে তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ছবি নির্মাতা ওর প্রতি ঝুঁকে পড়লেন। লাহোর ও করাচির উর্দু ও পাঞ্জাবি ছবিতে শবনমের চাহিদা বেড়ে গেল। পেশাজীবী মনোভাবের কারণে ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তানের করাচীতে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন এবং উর্দূ চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। করাচিতে গিয়ে তিনি প্রথম অভিনয় করলেন ‘আনজান’ ছবিতে। এই ছবি দারুণ ব্যবসা সফল হওয়াতে এক সঙ্গে ১২/১৩টি ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেলেন। এভাবে শবনম লাহোর ও করাচির প্রথম সারির নায়িকা হয়ে উঠলেন। এসময় তার অভিনীত ছবি 'তালাশ' সমগ্র পাকিস্তানে মুক্তি পেলে ঐ সময়ের সর্বাপেক্ষা ব্যবসা সফল ছবির মর্যাদা লাভ করে। তিনি নায়িকা হিসেবে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে ধ্বস নামার পূর্বে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন।
১৯৮৮ সালে শবনম তার চরিত্র পরিবর্তন করেন এবং পুনরায় ঢাকা ও লাহোরের চলচ্চিত্রাঙ্গনে অভিনয় করতে থাকেন। ৪০ বৎসরের অধিককাল ধরে অভিনয়ের ফলে তিনি প্রায় ১৮০টি চলচ্চিত্রের অনেকগুলিতে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে অসামান্য অবদান রাখায় শবনম সম্মানসূচক পুরস্কার হিসেবে মোট ১২বার নিগার পুরস্কার লাভ করেন। নিগার পুরস্কারের পাশাপাশি তিনবার পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও পাকিস্তান টেলিভিশনের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী শবনম এবং তাঁর স্বামী বরেণ্য সুরকার ও সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষকে আজীবন সম্মাননা দিয়েছে । নব্বুইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান থেকে পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে এসে আরো কিছু বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কাজী হায়াতের পরিচালনায় ও ঢাকা প্রোডাকশনের ব্যানারে তিনি ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ আম্মাজান চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। ‘আম্মাজান’ ছবিতে এক সময় নায়ক মান্নার মায়ের ভূমিকায় শবনমকে দেয়া গেল। ছবিটি ব্যবসা সফল হলেও ঢাকার ছবিতে শবনম আগের মতো আর ব্যস্ত হতে পারলেন না।
ঢাকার প্রথম দিককার নায়িকা হিসেবে বিশেষ করে উর্দু ছবিতে সবচেয়ে বেশি সফল শবনম বর্তমানে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। তার হাতে কোন কাজ নেই।স্বামী রবীন ঘোঘের অবস্থাও তাই। রবীন ঘোষ ছিলেন খ্যাতিমান সুরকার বর্তমানে তার হাতেও কোন কাজ নেই। তাদের একমাত্র ছেলে রনী ঘোষ কখনও দেশে কখনও বা প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। গ্ল্যামার জগতের এটাই নিয়ম, বয়স চলে গেলে এ লাইনে প্রয়োজন যে ফুরিয়ে যায়। শবনমের বেলায় তাই হলো। তবে শবনম নায়িকা হিসেবে তার প্রথম বাংলা ছবি ‘হারানো দিন’-এর মাধ্যমে কিংবদন্তি হয়ে রইলেন। আজ জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর জন্মদিন। ১৯৪০ সালের আজকের দিনে তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। রোমান্টিক নায়িকা শবনমের ৭৪তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।