somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী স্বনামধন্য বাঙালি বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের ৮৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

০৭ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ভারতের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারীদের একজন দীনেশচন্দ্র গুপ্ত। ভারত উপমহাদেশে বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তার মূলে যে সকল বিপ্লবী রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ঢাকার দীনেশ গুপ্ত অন্যতম। যিনি দীনেশ গুপ্ত নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ঢাকা ও মেদিনীপুরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। মেদিনীপুরে তাঁর সংগঠন পরপর তিন জন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করেছিল। তিন বাঙালী যুবকের সেই সংগ্রাম আজও আমাদের অবাক করে। কতটা সাহসী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে এইরকম আক্রমণ শানানো যায় তা ভাবার বিষয়। পুলিশের তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে রাইটার্সে ঢোকা এবং বেরোনোর পথ রুদ্ধ জেনেও হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মানসিকতা দেখে উদ্বুদ্ধ হয় বিপ্লবীরা। ওই যুদ্ধে ভীষণভাবে আহত মুমূর্ষু অবস্থায় দীনেশ ও বিনয় ধরা পড়েন। দীনেশের বিচারের জন্য আলীপুরের সেসন জজ মি. গ্রালিকের সভাপতিত্বে ব্রিটিশ সরকার এক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। উক্ত ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে চলে প্রহসনের নাটক। বিচারে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়। ইংরেজ সরকার ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই দীনেশের ফাঁসি কার্যকর করার নির্দেশ দেয়। আজ এই বিপ্লবীর ৮৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। স্বনামধন্য বাঙালি বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের ৮৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।


১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) যশোলঙে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সতীশচন্দ্র গুপ্ত। আর মায়ের নাম বিনোদিনী দেবী। ছোটবেলায় দীনেশ গুপ্তের ডাকনাম ছিল নসু। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে দীনেশ গুপ্ত ছিলেন বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। দীনেশ গুপ্তের বাবা সতীশচন্দ্র ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী। চাকরির সূত্রে তিনি একবার পরিবার নিয়ে বেশ কিছুদিন গৌরীপুরে ছিলেন। এরপর বাবার চাকরির কারণে ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন। এ সময় দীনেশ গুপ্ত ঢাকার গেন্ডারিয়া অঞ্চলে দাদুর বাড়িতে বসবাস করতেন। কিছুদিন পর পৈতৃক বাসভবন ওয়ারীতে চলে আসেন। ঢাকায় আসার পর দিনেশগুপ্ত ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই দীনেশ গুপ্ত ছিলেন নির্ভীক ও দুরন্ত প্রকৃতির। ১০ম শ্রেণীতে পড়াশোনাকালীন তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (বিভি) নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে (ঢাকা বোর্ড) ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দেন। কিন্তু বিপ্লবী দলের কাজকর্মের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার কারণে তিনি আইএসসিতে পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। এর পর ১৯২৮ সালের মাঝামাঝি দীনেশ গুপ্ত মেদিনীপুরে গিয়ে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং মেদিনীপুর কলেজে ভর্তি হন। সেখানে মেদেনীপুর বিপ্লবী দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ওইখানে বিভির শাখা স্থাপনের কাজ শুরু করেন। এ সময় তিনি বিপ্লবী দলের সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। দীনেশ মেদিনীপুরের বহু স্কুল-কলেজের ছাত্রকে বিপ্লবী দলে টেনে এনেছিলেন।


সুভাষ চন্দ্র বসু তখন 'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স'কে অ্যাকশনধর্মী বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন। শুরু হয় বিপ্লবীদের আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণে দীনেশ গুপ্তও বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। একপর্যায়ে সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এই সংগঠনের বিপ্লবীরা কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদের হত্যা বা নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করেন। আর এই অপারেশনের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো দীনেশ সহ বিনয় ও বাদল- এই তিন বিপ্লবীর উপর। যথারীতি সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তারা প্রস্তুত হলেন। ৮ ডিসেম্বর (১৯৩০) বেলা ১২টায় রাইটার্স বিল্ডিং যখন কর্মমুখর তখন সামরিক পোষাকে বিনয়, বাদল ও দীনেশ সেখানে প্রবেশ করেন। তারপর পুলিশের কারা বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা কর্ণেল সিম্পসন সাহেবের কক্ষে ঢুকে তার উপর তিন জনেই রিভলভারের গুলি চালান। গুলিতে সিম্পসন সাহেবের প্রাণহীন দেহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর বিনয়-বাদল-দীনেশ রাইটার্স ভবনের অন্যান্য ইংরেজ রাজ কর্মকর্তাদের উপর আক্রমণ শুরু করেন। এই আক্রমণে নেলসন ও টয়নয় নামক উচ্চ পদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তা আহত হন ও অন্যান্যরা গুলির মুখে পালিয়ে যান। কিন্তু বিপ্লবীদের এই আক্রমণের পরে বৃটিশ শাসকরা তাদের সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে রাইটার্স ভবন ঘেরাও করে। বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয় গুর্খা বাহিনীকে। অস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত গুর্খা বাহিনীর আক্রমণের সামনে শুধু রিভলভার হাতে যুদ্ধরত তিনজন বিপ্লবী। এক সময় তাদের গুলি ফুরিয়ে যায় এবং দীনেশ পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। পরাজিত হয়ে বৃটিশদের হাতে ধরা পড়ার বদলে তারা মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করলেন। তাই মারাত্মক বিষ পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে নিলেন এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেকে তাদের শেষ গুলিটি নিজেদের মাথায় বিদ্ধ করলেন। বাদল তৎক্ষণাৎ মৃত্যু বরণ করলেও ভীষণভাবে আহত মুমূর্ষু অবস্থায় দীনেশ ও বিনয় ধরা পড়েন। উভয়কেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও সেখানেও তাদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালানো হয়। পুলিশ কমিশনার ট্রেগার্ট অচেতন বিনয়ের হাতের আঙুলগুলি বুটের আঘাতে ভেঙে দেয়। আরও অত্যাচার এড়াতে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বিনয় মাথার ব্যান্ডেজের ভেতর দিয়ে মগজে আঙুল ঢুকিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেন। এদিকে ডাক্তার-নার্সদের অক্লান্ত সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠা দীনেশের উপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। এভাবে ক্রমাগত নির্যাতন এবং তারপর চিকিৎসায় সুস্থ করে আবার নির্যাতন চলতে থাকে দীনেশের উপর। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে বিচারের নামে শুরু হয় প্রহসন। শেষমেষ তার বিরুদ্ধে ফাঁসীর আদেশ দিয়ে তাকে কন্ডেমড সেলে পাঠানো হয়। ইংরেজ সরকার দীনেশের ফাঁসি কার্যকর করার নির্দেশ দেয়।


১৯৩১ সালের ৭ জুলাই, প্রকৃতি তখন রাতের গভীর অন্ধকার কাটিয়ে দিনের আলোয় উদ্ভাসিত হবার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। একটি নূতন দিনের প্রভাত জীবনের কলরবে মুখর হবার প্রতীক্ষায়। ঠিক সেই ক্ষণে মাত্র ১৯ বছরের এক তরতাজা তরুণ প্রাণ স্নান শেষে জীবনকে বিদায় জানাতে নিঃশঙ্ক চিত্তে ফাঁসীর মঞ্চে এগিয়ে গেলেন। হাসিমুখে নিজের হাতে ফাঁসীর দড়ি মালার মত গলায় দিলেন।
কর্মরত কারা কর্তৃপক্ষ এসময় জানতে চাইলেন ‘তুমি কি কিছু বলতে চাও?
‘আমাদের বলার অধিকার কারা কেড়ে নিয়েছে, তা তোমরাই ভাল জান। তাই ডু ইওর ডিউটি’- তরুণ দীনেশের ধীর স্থির কণ্ঠস্বর থেকে উত্তর ভেসে এল। এরপর তরুণের হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত স্বাধীনতার মন্ত্র ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনির অনুরণন আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে একটি অবিনাশী জীবনের দীপশিখা নিভে গেল। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে খুন করা হলো বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তকে।


স্বাধীনতার পর তাঁর ও তাঁর অপর দুই সহবিপ্লবীর সম্মানার্থে কলকাতার প্রসিদ্ধ ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ (সংক্ষেপে বিবাদীবাগ) রাখা হয়। আজ এই বিপ্লবীর ৮৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। স্বনামধন্য বাঙালি বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৬
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×