নানামুখী প্রতিভার অধিকারী নাট্যকার, গীতিকার ও চলচ্চিত্রকার তুলসী লাহিড়ী বাংলা নাটক ও অভিনয়ের জগতে একটি বিশিষ্ট ও স্মরণীয় নাম। যিনি পুরোনো বাণিজ্যিক ধারার থিয়েটারকে ভারতীয় গণনাট্য সংস্থার মাধ্যমে নবনাট্য আন্দোলনের মাধ্যমে রূপান্তর করেন। তৎকালীন সময়ে নাট্য ও সংগীত শিল্পীদের অনেকেই বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় পুলিশের নজর এড়াতে পিতৃদত্ত নাম বদলিয়ে হেমেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী হয়ে যান তুলসী লাহিড়ী। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি গাইবান্ধা ছেড়ে চলে যান কোচবিহারে। পরবর্তীকালে তুলসী লাহিড়ী গোটা ভারতবর্ষে পরিচিতি পান নাট্যকার, অভিনেতা, সুরকার, সংগীত পরিচালক, চিত্র নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকার হিসেবে। নির্বাক যুগ থেকে শুরু করে বাংলা চলচ্চিত্রের সংগে কয়েক দশকের ঘনিষ্ঠতা ছিলো তাঁর। নাট্যরচনা, মঞ্চাভিনয় এবং পাশাপাশি চিত্রপরিচালক ও অভিনেতারূপে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিলো ব্যাপক, সিদ্ধি ছিলো ঈর্ষাজনক। বহুমুখী প্রতিভার এই নাট্যকার ১৯৫৯ সালের আজকের দিনে কলকাতায় পরলোকগমন করেন। আজ এই অভিনেতার ৫৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। গীতিকার ও চলচ্চিত্রকার তুলসী লাহিড়ীর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
নাট্যকার ও অভিনেতা তুলসী লাহিড়ী ১৮৯৭ সালে (জন্মতারিখ অস্পষ্ট) গাইবান্ধা জেলার সাদুলস্নাপুর উপজেলার নলডাঙ্গায় বিখ্যাত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী এবং মাতার নাম শৈলবালা দেবী। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় পুলিশের নজর এড়াতে পিতৃদত্ত নাম তুলসী লাহিড়ী বদলিয়ে হেমেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী নাম ধারণ করেন। পিতার কাছে সঙ্গীতচর্চায় হয় তাঁর হাতেখড়ি। রংপুরে নানা অনুষ্ঠানে সঙ্গীতের ব্যবস্থা করতেন পিতা সুরেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী। রংপুরে সেই সময়কার নাট্যসংস্কৃতি, জমিদারের ছেলে হয়েও কৃষিজীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তরের রূঢ় অভিঘাত এবং সর্বোপরি মূল্যবোধে দৃঢ়বিশ্বাস তাঁর শিল্পী মানসকে প্রভাবিত করেছিল। সংগীতের মাধ্যমে তাঁর নাট্যজগতে প্রবেশ। শিক্ষাক্ষেত্রে বি. এ. ও বি. এল. পাস করে প্রথমে রংপুরে ও পরে কলকাতার আলিপুর কোর্টে ওকালতিতে যুক্ত হন। কিন্তু পালে যার সংস্কৃতির হাওয়া তিনি কি তার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে। তাই আইনব্যবসা ত্যাগ করে বহুমুখী আগ্রহ ও পারদর্শিতা নিয়ে চলচ্চিত্র ও নাট্যাভিনয়ে যোগদান করেন তিনি। ১৯২৮ সালে তাঁর রচিত দুইটি গান জমিরুদ্দিন খাঁ রেকর্ডিং করলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ ঘটে। পরবর্তীকালে এইচএমভি ও মেগাফোন গ্রামোফোন কোম্পানিতে সংগীত পরিচালক পদে নিযুক্তি লাভ। এ থেকেই শুরু হলো অজস্র গান রচনা আর সুর সংযোজন। গানের জগতে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল কাজী নজরুল ইসলামের সংগে। তাঁর লেখা বহু গান এখন নজরুলগীতি বলে প্রচলিত আছে। তিনি একটি অর্কেস্ট্রা দলও গঠন করেছিলেন, যা ওই সময়ে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর রচিত দুটি বিখ্যাত গান হচ্ছে ভুলো না রেখো মনে বাঁচবে যত কাল এবং কুল মজালি ঘর ছাড়ালি পর করালি আপনজনে। দুঃখের বিষয় সহস্রাধিক জনপ্রিয় বাংলা গানের এই গীতকারের কোনো গীতসংকলন নেই।
(গাইবান্ধা নাট্য সংস্থাঃ নাট্যকার তুলসী লাহিড়ী ছিলেন এই সংস্থার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক)
তুলসী লাহিড়ী একের পর এক মঞ্চে এবং প্রায় ৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৯৪০ সালে তিনি ঠিকাদার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অভিনেতা হিসেবে তিনি সহজেই জটিল থেকে কৌতুককর এবং ভিলেইনি থেকে নিষ্পাপ; প্রায় সব চরিত্রেই অভিনয় করতে পারতেন। আঞ্চলিক উচ্চারনেও তার দক্ষতা ছিল চমৎকার। ১৯৪৬ সালে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে তাঁর প্রথম নাটক ‘দুঃখীর ইমান’ অভিনীত হয়। ১৯৪৭ সালের মে-জুন নাগাদ নাটকটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ ও তুলসীবাবুর ‘দুঃখীর ইমান’ সমসাময়িক দু’টি রচনা। কিন্তু আদর্শগত কারণে গণনাট্য সংঘ এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেনি। এটি মঞ্চস্থ হয়েছিল পেশাদার নাট্যমঞ্চে। তাত্ত্বিক দিক থেকে তুলসীবাবু কমিউনিস্ট ছিলেন না। তিনি মানবতাবাদী একটি বিশেষ আদর্শে বিশ্বাস করতেন। যুগের প্রভাবে কৃষক শ্রেণির দুঃখ-বেদনা-বিশ্বাসের দিকটি তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর নাটকে। সুধী প্রধান লিখেছেন, ‘বিজন মার্ক্সবাদ পড়ে যা করতে পারেনি – তুলসীবাবু না পড়ে তাই করেছেন।’ সেই কারণেই হয়ত শিল্পবাদী এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শোধনবাদী শম্ভু মিত্রের ‘বহুরূপী’ দলে যোগ দিয়েছিলেন তুলসীবাবু। অবস্থানের দিক থেকে তাই তাঁকে গণনাট্য অপেক্ষা নবনাট্য দলের একজন বলতে হয়।
১৯৫৩ সালে তুলসী লাহিড়ী পথিকের চিত্রনাট্য করেছেন এবং পরিচালনা করেছেন ১১টি সিনেমা। পঞ্চাশের মহামন্বন্ত্মরের পটভূমিতে লেখা তাঁর নাটক, ছেড়াতাঁর ও দু:খীর ইমান' অভাবিত খ্যাতি অর্জন করে। গণনাট্য সংঘের নাট্যরচনা ও প্রযোজনার নিয়মনীতি তুলসী লাহিড়ী কিছুটা অনুসরণ করলেও ভাববাদ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেননি। একটি বিশেষ মূল্যবোধ, আদর্শবাদ ও ভাববাদী মনোভাব তুলসী তাকে বিশেষভাবে পরিচালিত করেছিল। তুলসী লাহিড়ী বিরচিত ‘ছেঁড়াতার’ ঐ পঞ্চাশের মন্বন্ত্বর-এর (১৯৪৬) পটভূমিতে এক মুসলমান দম্পতির মানবিক এবং কঠিন সঙ্কটে পড়ে যাবার মর্মান্তিক ট্রাজেডি। ১৯৫০ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে বহুরূপীর প্রযোজনায় তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ নাটকটি অভিনীত হয়। সেই আকালে বিপাকে পড়ে রহিমুদ্দীন ত্যাগ করেছিল তার পত্নী ফুলজানকে। তালাক দিতে বাধ্য হয়েছিল। আর হদিসে আছে, - একবার ‘তালাক’ হয়ে যাবার পরে যদি আবার সেই দম্পতি ঘর বাঁধতে চায় তাহলে সেই মেয়েটির অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে ‘নিকা’ হওয়া আবশ্যক। সেই ‘নিকা’ থেকে তালাক পেলে তবেই সে তার প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে আসতে পারবে এবং নিকা হবে তাদের। তার আগে নয়। ১৯৫০-৫১-তে ’৪৩-এর ঐ মন্বন্ত্বরের ক্ষতের যন্ত্রণা তীব্র। ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে কেবল অবস্থার চাপে দু’জন সৎ এবং ভালো মানুষের এইরকম ফাঁদে পড়ে যাবার কাহিনী বাঙ্গালীকে প্রবল নাড়া দিয়েছিল। শব্দ করে কেঁদে উঠতেন দর্শক। কৃষক জীবনের সাধারণ সমস্যার সঙ্গে মুসলিম সমাজের তালাকের সমস্যা তিনি যেভাবে এই নাটকে উত্থাপন করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হয়, যে শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ‘ছেঁড়া তার’ নাটকের সূচনা, সেই শ্রেণিসংগ্রামই নাটকে পরে গৌন হয়ে গেছে। ‘ছেঁড়া তার’ নাটকে ছেকিমুদ্দিনের সাজা হয়ত শোষক পক্ষের পরাজয়ের প্রত্যক্ষ প্রমাণ, কিন্তু নাট্যকারের মূল লক্ষ্য ছিল রহিমের ট্রাজেডিটি তুলে ধরা। তাই তুলসী লাহিড়ী নাট্যকার রূপে প্রগতিশীল ভাবধারার অনুসারী হয়েও শেষবিচারে তিনি ভাববাদী, আদর্শবাদী ও শিল্পবাদী। এই নাটকে তিনি নিজে হাছিমুদ্দি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর অন্যান্য নাটকের মধ্যে রয়েছে মায়ের দাবি (১৯৪১), পথিক (১৯৫১), লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার (১৯৫৯), মণিকাঞ্চন, মায়া-কাজল, চোরাবালি, সর্বহারা প্রভৃতি। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অসাড়তা প্রমাণ করার উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি নাটকগুলি রচনা করেন।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যুগনায়ক তুলসী লাহিড়ী ১৯৫৯ সালের ২২শে জুন কলকাতায় পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৬২ বছর। আজ এই অভিনেতার ৫৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। গীতিকার ও চলচ্চিত্রকার তুলসী লাহিড়ীর মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৪ সকাল ৯:৪৮