somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বনামধন্য ভারতীয় বাঙালি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও শিক্ষিকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিনে শুভেচ্ছা

১২ ই অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৫:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। বিশেষত টপ্পা অঙ্গের রবীন্দ্রসংগীতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক গায়িকা। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অতুলপ্রসাদের গানেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন; যদিও এই ধারায় তাঁর রেকর্ড সংখ্যা খুব বেশি নয়। জীবনের অধিকাংশ সময় শান্তিনিকেতনে অতিবাহিত করলেও তাঁর জনপ্রিয়তা পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশেও পরিব্যাপ্ত ছিল। কলকাতা পৌরসংস্থা তাঁর সম্মানে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও রবীন্দ্র সদনের মধ্যবর্তী ময়দানের একাংশে একটি সুরম্য সুবৃহৎ উদ্যান উৎসর্গ করেছেন। স্বনামধন্য এই রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর আজ জন্মদিন। শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৮৯তম জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।


কিংবদন্তি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২৪ সালের ১২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারের কর্মী ও মা অনিলা দেবী ছিলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রমজননী। তাঁদের পাঁচ কন্যা ও তিন পুত্রের মধ্যে কণিকা ছিলেন জ্যেষ্ঠ।ছেলেবেলা কাটে বিষ্ণুপুরের মামাবাড়ির যৌথ পরিবারে। পরে খুব অল্পবয়সে পিতার কর্মস্থল শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। ভর্তি হন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে।
তাঁর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় এই সময় এক কালবৈশাখীর সন্ধ্যায় উত্তরায়ণের বাগানে আম চুরি করতে গিয়ে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ। সহজাতসঙ্গীত প্রতিভার কারণে তিনি সেই বয়সেই কবির বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে পড়েন। কনিকার পিতৃদত্ত নাম অনিমা মুখোপাধ্যায়। ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অণিমা’ নামটি পরিবর্তন করে ‘কণিকা’ রাখেন। অবশ্য ডাকনাম হিসাবে তিনি ব্যবহার করতেন ‘মোহর’। পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই ‘মোহর’ নামটি বিস্তারিত করে বলেছিলেন ‘আকবরী মোহর’। [/


১৯৩৫ সালে শিশুশিল্পী হিসাবে প্রথম মঞ্চাবতরণ করেন কণিকা। শান্তিনিকেতনের শারদোৎসবে একটি অনুষ্ঠানে বালক-বালিকাদের দলে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সেই প্রথম ও শেষ মঞ্চাবতরণ; কারণ সেই অনুষ্ঠানটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ মঞ্চাভিনয়। ১৯৩৭ সালে প্রথম কলকাতার ছায়া সিনেমা হলে আয়োজিত বর্ষামঙ্গল উৎসবে কণিকা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ছায়া ঘনাইছে বনে বনে গানটি গেয়েছিলেন। কলকাতার মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরূপে সেটিই ছিল তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ। এই সময়ে অনেকগুলি গান রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স্বয়ং শিখিয়েছিলেন। কণিকা অভিনয় করেছিলেন তাসের দেশ নাটকের দহলানী, ডাকঘর নাটকের সুধা, বিসর্জন নাটকের অপর্ণা ও বশীকরণ নাটকের নিরুপমা চরিত্রে। ১৯৪০ সালের ২৪ জুলাই বোলপুর টেলিফোন কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ওগো তুমি পঞ্চদশী গানটি গেয়েছিলেন। গানটি তিনি সরাসরি রবীন্দ্রনাথের কাছেই শেখেন। এই অনুষ্ঠানটি বেতারে সম্প্রচারিত হয়। এটিই কণিকার প্রথম বেতার অনুষ্ঠান।


১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সময় কণিকা ছিলেন শান্তিনিকেতনে। এই সময় রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ মতো সমুখে শান্তিপারাবার গানটি যে বৃন্দদলে গাওয়া হয়, সেই দলে ছিলেন কণিকা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই গানটি মৃত্যুর কয়েক বছর আগে রচনা করলেও, রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে তাঁর মৃত্যুর পরেই প্রকাশিত ও গীত হয়। এরপর ইন্দিরা দেবী চৌধরানী, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, অমিতা সেন, রমা কর প্রমুখ খ্যাতনামা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষকের কাছে গান শিখতে থাকেন কণিকা। শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন হেমেন্দ্রলাল রায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভি ভি ওয়াজেলওয়ার, পি এন চিনচোর ও ধ্রুবতারা যোশির কাছে। ভজন শেখেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও প্রকাশকালী ঘোষালের কাছে। কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের পিতা হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নিকট শেখেন অতুলপ্রসাদের গান। এছাড়াও কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগমের কাছে কিছুকাল নজরুলগীতিও শেখেন কণিকা। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও অন্যান্য ধারার বিভিন্ন গান কণিকা রেকর্ড করেন বিভিন্ন সময়ে। তার মধ্যে রয়েছে ভজন, কীর্তন, অতুলপ্রসাদী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, নজরুলগীতি ইত্যাদি।


(হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)
১৯৪২ সাল থেকে তিনি হিজ মাস্টার্স ভয়েসের শিল্পী। ১৯৪৩ সালে বিশ্বভারতীরসঙ্গীত ভবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করেন কণিকা। এই বছরেই আকাশবাণীর নিয়মিত শিল্পীরূপে তাঁর যোগদান। পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর এমিরিটাস অধ্যাপকও হন তিনি। ১৯৪৪ সালে কলকাতায় গীতবিতানসঙ্গীত বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা মঞ্চস্থ হলে কণিকা সেই নাটকে প্রমদার চরিত্রটি করেন। এই অনুষ্ঠানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সূত্রে তিনি পরিচিত হন বাঁকুড়ার বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পরের বছর বৈশাখ মাসে বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি আবদ্ধ পরিণয়-সূত্রে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বীরেনবাবু ছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারের কর্মী, রবীন্দ্র-বিশারদ ও আত্মকথা বাদে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত সকল গ্রন্থের সহলেখক।


(১৯৫৪ সালে শান্তিনিকেতনে, সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতে অনন্য ভূমিকা রাখায় বহু সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেছেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনে পেয়েছেন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার। ১৯৭৩ সালে বি এফ জে এ পুরস্কার, ১৯৭৮ সালে ই এম আই গ্রুপ গোল্ডেন ডিস্ক, ১৯৭৯ সালে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার , ১৯৮৬ সালে হন পদ্মশ্রী পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে এশিয়ান পেন্টস শিরোমণি পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম দ্বারা সম্মানিত করা হয় তাঁকে। ১৯৯৮ সালে পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি কেন্দ্র তাঁকে সম্মান জানান। ১৯৯৯ সালে পান আলাউদ্দিন পুরস্কার। এছাড়া মৃত্যুর পরে কলকাতার বিখ্যাত সিটিজেন্স পার্কটিকে তাঁর নামে উৎসর্গিত করা হয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল লাগোয়া এই সুরম্য বিশাল উদ্যানটির বর্তমান নাম মোহরকুঞ্জ।


(কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেবব্রত বিশ্বাস)
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৭৪, ১৯৭৮ ও ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা; ১৯৭৬, ১৯৮০ ও ১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ড এবং ১৯৮০ সালেই জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। বহুবার তনি বাংলাদেশ ভ্রমন করেন। তাঁর প্রিয় ছাত্রী ও বিশিষ্ট বাংলাদেশী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার তত্ত্বাবধানে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে শেষবার সেই দেশ ভ্রমণ করেন কণিকা। ১৯৮৪ সালেসঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর নেন কণিকা। ১৯৯৩ সালে বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ ‘মোহর’ নামে তাঁর জীবনভিত্তিক একটি তথ্যচিত্র তোলেন। এর প্রযোজক ছিল ফিল্ম মেকার্স কনসর্টিয়াম। তাঁর শেষজীবন কাটে শান্তিনিকেতনে। অসুস্থতার কারণে শেষদিকে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০০০ সালের এপ্রিল ৫, ২০০০ কলকাতাতেই তাঁর জীবনাবসান হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।


স্বনামধন্য এই রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর আজ জন্মদিন। শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৮৯তম জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছাতার জন্মদিনে তবু মনে রেখো
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×