বাংলাদেশের প্রখ্যাত অভিনেতা,আবৃত্তিকার এবং স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকসহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। সৈয়দ হাসান ইমাম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ অবদানের জন্য তিনি সিকোয়েন্স পুরস্কারও লাভ করেন। আজ এই গুণী অভিনেতার ৭৮তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ফুলেল শুভেচ্ছা।
১৯৩৫ সালের এই দিনে ভারতের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সফল সংগঠক ও অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম। হাসান ইমাম মাত্র দুই বছর বয়সে তাঁর বাবাকে হারান। সৈয়দ হাসান ইমাম ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যনত্ম বর্ধমান রাজ কলেজে এবং ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যনত্ম বর্ধমান টেকনিক্যাল কলেজে অধ্যয়ন করেন। ছাত্র জীবনেই তিনি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৬০ সাল থেকে শুরম্ন হয় অভিনয় জীবন। প্রথম দিককার বিখ্যাত কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে অভিষেক হয় টেলিভিশন নাটকে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষের কেন্দ্রীয় উৎসবে ডামা সার্কেল প্রযোজিত তাসের দেশ, রাজা ও রানী এবং রক্তকরবী নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৬৬ থেকে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের মঞ্চে নাটক-নাটিকা ও গণসঙ্গীত পরিচালনা করেন। তাঁর পরিচালিত নাটকগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী, গোর্কির মা, সোমেন চন্দের না ইত্যাদি বিশেষ উলেস্নখযোগ্য।
১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে শিল্পী সমাজের পক্ষে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন হাসান ইমাম। ১৯৭১ সালে ফেব্রম্নয়ারি মাসে হাসান ইমামকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এ সংগঠনের শিল্পীরা পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করেন। গণআন্দোলনের চাপে পাক সরকার ৮ মার্চ থেকে বেতার টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চের গণহত্যার আগ পর্যনত্ম বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ সফলভাবে এ দায়িত্ব পালন করে। ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর হাসান ইমাম মুজিব নগরের চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায় সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৬ ডিসেম্বর পর্যনত্ম সংবাদ পাঠ এবং নাট্য বিভাগের দায়িত্বভার বহন করেন। এ সময় জহির রায়হানকে সভাপতি ও হাসান ইমামকে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিব নগরে চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি গঠন করা হয়। এ সমিতির উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য চলচ্চিত্র দলিল 'লেট দেয়ার বি লাইট' প্রামাণ্য চিত্রটি নির্মিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর সাংস্কৃতিক বিপস্নব সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠায় হাসান ইমাম গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বসত্মবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করেন। শহীদ জননীর জীবনাবসানের পর হাসান ইমাম এ সংগঠনের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। হাসান ইমামের মৌলবাদ বিরোধী ভূমিকায় ভীত অশুভ চক্র কয়েকবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে, পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টির সভায় এবং ছায়ানটের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার সময় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। অথচ মৌলবাদী প্রচার মাধ্যমগুলো নৃশংস এ বোমা হামলার জন্য তাঁকেই অভিযুক্ত করে মিথ্যা প্রচারণা চালাতে থাকে। ফলে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে দেশত্যাগে বাধ্য হন হাসান ইমাম।
দেশত্যাগের আগে পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, ঘাতক দালাল নিমর্ূল জাতীয় সমন্বয় কমিটিসহ বহু সংগঠনের সভাপতি-আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ অবদানের জন্য সিকোয়েন্স পুরস্কার এবং দেশের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকসহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ হাসান ইমাম বিশিষ্ট নৃত্য শিল্পী-শিক্ষক-অভিনেত্রী লায়লা হাসানকে বিয়ে করেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি, বাংলাদেশ টেলিভিশন আপীল বোর্ড এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন পর্ষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি লায়লা হাসান এশিয়ান ডান্স কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কোরিয়ান রিপাবলিকের সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এশিয়ান দেশগুলোর প্রতিনিধি সমন্বয়ে এশিয়ান ডান্স কোলাবরেশন গঠিত হয়েছে। লায়লা হাসান, বাংলাদেশের নৃত্যাঙ্গনে দীর্ঘ দিন তাঁর অবদানের জন্য ২০১০ সালের একুশে পদকের সম্মান অর্জন করেছেন।
বাঙালি সংস্কৃতি চর্চায় নিরলস ব্রতী, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, অভিনেতা, আবৃত্তিকার এ রকম বহু বিশেষণে বিশেষায়িত, বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী সৈয়দ হাসান ইমামের আজ ৭৮তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর জন্য আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা।
বিঃদ্রঃ বিগত বছরগুলোতে পত্রিকা মাধ্যমে জানতাম এই গুণী নাট্যাভিনেতার জন্মদিন ২৯ জুলাই। কিন্তু আজ ২৭ জুলাই চ্যানেল আইয়ের "তারকালাপ" অনুষ্ঠানে সৈয়দ হাসান ইমামকে নিয়ে তাজ জন্মদিন পালন করা হলো। সাথে ছিলেন তার সহধর্মিনী লায়লা হাসান। সুতরাং তাঁর জন্মদিন নিয়ে বিভ্রান্তি দূর হলো।