ভালোবাসা বহু দিক দিয়ে আসে; বহু দিক দিয়ে চলে যায়।
ধর্ম-কর্ম, আচরণের স্মৃতিকে জড়িয়েই তার বিস্তৃতি। যারা বড়; তারা এমন ছোট ছোট বিষয়কে গুরুত্ব দেয়৷
জীবন স্বপ্ন। স্বপ্ন বাস্তব হলেও তা ধরে রাখা যায় না। যা ধরা যায় না তা বাস্তব হলেই বা কী? চোখ, হৃদয়, জীবনের সাথে সাথে সময়েরও বয়স বাড়ে। যুগের কাছে যুগের স্বনিলাম হচ্ছে বলেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে সবাই নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে।
স্রষ্টা খেলোয়ার নয় যে, খেলবেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন। শুন্যও তার, নয়ও তার।
আগুনে পোড়া ছেলেটির জন্ম হয়েছিল কোন এক সুশৃঙ্খল পরিবারে; তবুও সে যেন পরিচয়হীন। বন্ধুদের সাথে আনন্দ ঘন অনুষ্ঠান শেষে, বাড়ি ফিরে রাসেল জানতে পারে তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। বিয়ে একটি আনন্দ মাখা গল্প; কিন্তু রাসেলের জন্য তা ছিল ব্যক্তিগত পতন। বাবা কিছুদিন পরই যখন তাদের থেকে পরপর হয়ে যাচ্ছিল; তখন রাসেল জানতে পারে তার মায়ের রোগের গল্প। মা নাকি তার মারা যাবে। মা নিজেই তার বাবাকে বিয়ে দিয়েছেন, জানতে পেরে তার কিছুটা স্বস্তি লাগলেও মায়ের অপরাহ্ন তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। চিকিৎসার অভাবে তার মায়ের একদিন মৃত্যুও হল। মা ছাড়া কেউ ছিল না নয় বৎসরের রাসেলের। সৎ মায়ের কাছে সে কিছু বলতে পারেনি কোনদিন। বাবাও কেন জানি পর হয়ে গেল।
আপনি নিজেও আপনার কাছে ব্যক্তিগত; স্রষ্টা বিনে সব কিছু অন্য কেউ জানতে পারে না। রাসেলের দুঃখও কেউ কোনদিন বুঝেনি। আনন্দের দিন সবাই যখন আনন্দ করে; তখন সেও থাকে সেই স্রোতে কিন্তু তার ছিল না কোনো কাছের মানুষ। বড় ফুফুদের বাড়িতে কাজ করা মেয়েটির সাথে তার কথোপকথন হল একদিন। সেলিনার বয়স তখন সম্ভবত তের হবে। মেয়েটি প্রথম কেউ, যে রাসেলের ভিতরের পোড়া পর্যন্ত স্পর্শ করতে পেরেছিল হয়ত। তাইতো সে আগ বাড়িয়ে বলেছিল, “রাসেল তুমি ইচ্ছা করলে আমার কাছ থেকে টাকা নিতে পার”। তারপর থেকে সত্যি সত্যি রাসেল সেলিনার কাছ থেকে মাঝে মাঝে টাকা পায়। সেলিনার বেতন, চলে যায় গ্রামের সবচেয়ে গরীব পরিবারে। বাবাহীন তার পরিবারেও মা ও ছোট বোন ছাড়া কেউ ছিল না। সত্যি বলতে, বড় বড় মানুষ দীর্ঘ ভাষণ দিলেও সমাজ টিকিয়ে রাখার কাজ ছোটরাই করে। সেলিনা মাঝে মাঝে যে বকশিশ পায়, তাই থেকেই সে রাসেলকে কিছু টাকা দেয়। ছোটরা ঘুষ-সুদ-ভন্ডামি বুঝে না। এগুলোর সুযোগ তাদের দেয়া হয় না। সেলিনার কাজের দক্ষতার ওপর রাসেলের টাকাওয়ালা ফুফু মেয়েটির সমাদর করে। এখানে রাসেলের বাবার তেমন টাকা নেই। এছাড়া মা হারা ছেলেটির জন্যও ফুফুর তেমন টান সৃষ্টি হয় না। অবাক করার মতো ঘটনা হল, সমাজ না জানলেও, সেলিনা জানে যে, রাসেলের এত এত আত্মীয় থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে দু-এক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। সৎ মায়ের ভাষ্য মতে, রাসেল মাঝে মাঝে নিজের ঘরেই চুরি করে।
খাদ্যের অভাবে যে চোর চুরি করে, তার দিকে নয়; বরং মানবতাহীন ফাঁকিবাজ সমাজের বড় বড় মুখের উপরে যেন অভাবীরা থুথু ফেলতে পারে, সে সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত পরিবারে কিংবা কর্মক্ষেত্রে। যোগাযোগ ও সম্পর্ক খেয়ে খেয়ে, ঢেলে ঢেলে পার করতে করতে যারা ক্লান্ত; তারা মহাজন হতে পারে নি। রাসেলের আত্মীয়রা কেউ নিম্ন কোন বংশীয় নয়। সবাই বুক ফুলিয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে ভালোবাসে। কিন্তু নীচু বংশীয় অনাত্মীয় সেলিনাই রাসেলকে বুঝে। রাসেলের পেটের ক্ষুধা বুঝে।
রাসেল-সেলিনা বয়সের ব্যবধানে সমাজের ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করতে করতে বয়স পার করছিল। এরই মাঝে রাসেলও বুঝতে পেরেছিল, সেলিনা নামের মেয়েটির কাছে সে যা চাবে; মেয়েটিও যেকোন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেও তাকে তা এনে দেয়ার চেষ্টা করবে। সত্যি সত্যি যেদিন সুন্দর কোনো আচরণে আপনি খুবই মোহিত হবেন; সেদিন থেকে আপনিও রূপে নয়, গুণে মনোযোগি হবেন। তাই বোধহয়, রাসেল সময়ের সাথে সাথে সেলিনা নামের আপনে বেড়ে উঠছিল।
নীল নিঠুর হলে,
লালের জীবনে গল্প আসে।
রাসেল এখন নদীর মতো, শুরু শেষ নদী যেমন নিজেও কখনও জানে না; অথচ তাতে ঘটা জোয়ার ভাটার জল তাকে প্রশ্ন করে, যে প্রশ্নের প্রশ্নতেই জবাব লুকিয়ে থাকে; তবে তর্ক তার তর্ক চালায় যুগ যুগ ধরে।
বাঁচার জন্য সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। স্রষ্টা সুযোগ দিবেন; লোভ ডিঙ্গিয়ে মুক্ত হতে পারলেই ইন্দ্রজাল ছিঁড়ে যাবে। স্রষ্টার দেয়া মগজ কষ্ট লাঘবে ব্যয় না হলে; তা দিয়ে কাজ নেই। দিনশেষে, লোভীদের জন্য ফাঁদ পাতা আছে।
রাসেল একটি কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। সৎ মায়ের ঘরে তার দুই ভাই আছে। সেলিনার বিয়ে হয়েছে। স্বামী তার ভ্যান চালায়। সেলিনার স্বামীও রাসেলের খোজ নেয় মাঝে মাঝে। এমনি খোজখবরের গল্প চলতে চলতে সেলিনা তার ছোট বোনের জন্য রাসেলকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রথমে শুনেই রাসেলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। যাদের সে সারাজীবন তাদের বাড়িতে কাজ করতে দেখল, তারা কিনা তার সাথে আত্মীয়তা করতে চায়। আদম-হাওয়া কেউই গরীব ছিল না। গরীবতা স্রষ্টার তৈরি নয়। মানুষ নিজেকে সমৃদ্ধ করতে গিয়ে অন্যকে গরীব বানাচ্ছে। এ বিষয়টি রাসেল বুঝল না। বরং রাগে-দুঃখে সে সেলিনা এবং তার স্বামীর সাথে সম্পূর্ণরূপে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল।
অন্ধকারে, রূপের পাখি যখন আকাশের আলোতে কালো দেখায়। তখন কালো সে রূপে প্রকৃতি শান্ত হয়; ব্যস্ততা মরে যায়। কিছুদিন যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর; রাসেল অনুভব করল কোথাও যেন কোন মমতা নেই। বাবা ফোনে যোগাযোগ করলে, প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে যে, সে বেতন কত পেয়েছে। স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে ছাড়েন না। বরং সৃষ্টি অনেক সময় তার বিচার শক্তির সীমবদ্ধতায় নিজেকে নিঃস্ব মনে করে। এছাড়া, বুদ্ধির সীমাবদ্ধতায় অহংবোধ মিশলে, সে নিজেকে নিজের সাহায্যকারী মনে করে। অথচ তার শরীরের কোন কিছুই সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রাসেল ধীরে ধীরে বুঝতে পারল যে, ধনী গরীবকে দিবে ততক্ষণ, যতক্ষণ না তারা ধনী হয়। স্রষ্টা, সবার অভিযোগ শুনবেন। এই কথা, এই দিন শেষ হবে না। রাতের মতো, ঘুম ভেঙ্গে গেলেই ফির আলো দেখা যাবে।
দেখতে দেখতে যোগাযোগহীন দু’বছরে, ভিন্ন রকমের একটা জীবন কেটে গেল রাসেলের। সেলিনা নামের মেয়েটি এই সময়ে কোনো ঘটনার সূত্র ধরে আসে নি। শত শত আপন, ধীরে ধীরে বহু দূরে চলে গিয়েছে৷ অবাক করার মতো করে, অচেনারা নতুন হয়ে তার জীবনের সাথে মিশে চলছে৷ কে আসছে ; কে যাচ্ছে, বুঝা না গেলেও রাসেল বুঝল, জীবন অনেক বড়। এখানকার আসা-যাওয়া গণনা করা যায় না৷ এভাবে অজানা সংখ্যার সাথেই হয়তো একদিন ধাক্কা লাগবে ; মৃত্যুর সাথে চুড়ান্ত চুক্তি হবে৷ এ জীবন আরও বড় হবেে৷
বাড়ি থেকে রাসেলের সৎ ভাই এসেছে। গল্পে গল্পে তার কাছ থেকে সে পেল, সেলিনার ছোট বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
কথাটা শোনার সাথে সাথেই তার ভিতরে কেমন যেন একটা অনুভব হল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, চৌদ্দ-পনের বছর আগে যখন সে প্রথম সেলিনাদের বাড়িতে গিয়েছিল; তখন সেলিনার মা নিজের ছেলের মতো তাকে আপ্যায়ন করেছিল। নানান স্মৃতির প্রবাহে কেন জানি সে সেলিনার ছোট বোনের প্রতি নিজেকে দুর্বল ভাবতে শুরু করল। রাতে ঘুম হলো না ঠিক মতো। স্রষ্টা, সবার আবেগকে গুরুত্ব দেন। তাই আমরা সবাই হাসি; সবাই কাঁদি। রাসেল হাসতে পারছে না; কাঁদারও কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু সে কেন জানি ভিতর থেকে কিছু একটা ছিড়ে যাওয়ার ব্যথা অনুভব করছে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে- সেলিনার বোনেরও হয়ত একজন সখা ছিল; এখন তারা দুজনেই বয়সের বাস্তব বয়স্য।
রাসেলের দুঃখ হলো; তারা এমন একটি বিষয় তাকে জানায় নি। পরক্ষণেই নিজের আচরণের কথা মনে করে; নিজের প্রতিই ধিক্কার দিতে লাগল।
খুব কাছ থেকে বাস্তবতা দেখে ফেল্লে, অনেক সময় যেমন পৃথিবীর কোনো কিছুই বিশ্বাস হতে চায় না। রাসেলও নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না, যে সে আসলে সেই রাসেল; যে সেলিনার মতো একটি বড় বোনকে ত্যাগ করেছিল। মূলত রাসেলের বেড়ে ওঠার অনুপ্রেরণাই ছিল সেলিনার ভালোবাসা। যারা গুজবে, সুযোগে নিজের অস্তিত্বকে মূল্যহীন করে; তারা নিজেরাই নিজেদের বোঝা হয়ে যায়। যার ভার ব্যক্তিকে ভিতর থেকে টেনে ধরে।
খাবার দাও, ওষুধ দাও, সেবা দাও; জনম সার্থক হবে৷ অপরের সেবা করার ভাগ্য সবার হয় না। সেবার সুযোগ স্রষ্টা যাকে দিবেন, তিনি যদি তার যথোপযুক্ত মীমাংসা করেন, তিনি সফল। কিন্তু রাসেলের জন্য মমতামাখা ভালোবাসা দিয়ে কেমন সফল হয়েছে সেলিনা? তারা কেউ কাউকে চিনত না; অথচ পৃথিবীর সামাজিক গতিতে তারা যেন জনম জনমের মতো পরিচিত। রাসেল মোবাইলে সেলিনার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। তাদের মোবাইল বন্ধ। কবে থেকে তারা নাম্বারটি বন্ধ রেখেছে; তাও সে জানে না।
আপনাকে অন্যে কেন মনে রাখবে? কেনই বা আপনাকে ফোন দিবে, যখন আপনি নিজে থেকেই সম্পর্কের মাঝে ঘৃণার বীজ বপন করেছেন।
ঘৃণা চর্চা করা মানুষ, ভালোবাসা অর্জন করবে কীসের প্রভাবে?
ভালোবাসাহীন জীবন; দেখতে ছাইয়ের মতো। ছাই শুধু উড়ার জন্য তৎপর কিন্তু স্থির হতে পারে না।
স্থির সমুদ্রেও ঢেউ আসে বাতাস কিংবা চন্দ্র-সূর্যের প্রভাবে। কিন্তু ঘৃণার জীবন দেখলে, যে কারোর প্রাণেই ঘৃণার উদ্রেক হবে। ভালোবাসা বাতাস নয় যে, এমনি এমনি জীবনে চলে আসবে।
রাতে, রাতই মানানসই৷ রাতের অন্ধকারে দিনের স্থাপন, মন্দ; এটা ভালো কিছু নয়। তবুও রাসেল যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ধীরে ধীরে চেষ্টায় ঘূণ ধরে। সময়ের সাথে সাথে কোটি কোটি আত্মার মিছিলে রাসেল তার মায়ের স্মৃতির মতো সেলিনাকেও নিজেতে লুকিয়ে রাখে। যদিও মায়ের মৃত্যু হয় না কিন্তু সেলিনাদের অনেকেই হত্যা করে।
----------মনোমত
---------- আব্দুল্লাহ আল- মাহমুদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০২২ সকাল ১০:২৮