প্রেমহীন অবাক সংসারে, ভালো রাখাই নিয়ম। তাই ছেলেটি তার কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত কৃষ্ণ বর্ণের স্ত্রীকে ভালো রাখে। নরকের হাজারো সাদা; স্বর্গের কালোতে বিলীন হয়। দুর্গন্ধের মাঝে বেড়ে ওঠা কত-শত মলিন প্রাণ; কোনোদিন সুবাস না পেয়েও দিব্বি বেঁচে থাকে। জীবনের রং ভালো হয়; মন্দ হয়। অসহ্য রকমের ভীড়, অদ্ভুত ছন্দময়।
সভ্যদের হাতে লেখা ভদ্রতার সমাজে, সহজ মৃত্যুর সাথে কঠিন জীবনের বিনিময় হয় না৷ অথচ অসভ্যদের হৃদয়ের কোনো এক গহীন কোণে, হালকা রঙের একটি অনুভবে শান্তি আছে হয়তো।
দুর্বল ব্যবস্থার মাঝে দুর্গন্ধ নিয়ে বেড়ে ওঠা ছেলেটি নাম। দাদীর ভিক্ষা দেখতে দেখতে তার চোখে ভিক্ষার মোহিত রূপ গেঁথে গেছে। এই দাদীই যেন ছিল ওর পৃথিবী। গ্রামের ভদ্র পরিবেশের নীচু মানের সেই বৃদ্ধা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তার অসুস্থতার রেশে সমগ্র ঘরে গন্ধে লেপ্টে গেছে। দুর্ঘন্ধের তীব্রতায় কেউ ঘরে না ঢুকলেও, নাম তার দাদীকে জড়িয়ে কাঁদছে।
সেদিন দুপুরের তীব্র গরমে একা একা নাম তার দাদীর মৃত দেহ সমেত বসে আছে। ব্যথা লাগলে, শরীর ও মন তা আকস্মিকভাবে তীব্রতা দিলেও সময়ে সময়ে তা সয়ে যায়। দুঃখের বিস্তৃতি শান্ত একটি অনুভব হৃদয়ের কেন্দ্রে স্থাপন করে। নাম বসে আছে; চোখের পানির শুকিয়ে গেলেও অতিরিক্ত ঘামে শরীর ভিজে একাকার।
হঠাৎ পাটখড়ির পুরাতন দরজাটি সরিয়ে কে যেন ঘরে এলো। অতি সাহসী কোনো এক কণ্ঠ বলে উঠল, ”আপনারা আর কতক্ষণ মরা লাশটিকে ঘরে রেখে দিবেন?” নিরু ফকিরের কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে কিবানু। গ্রামের এমন কোনো বাড়ি নেই, যেখানে সে কাজ করে নি। কারও বাড়ির উঠোন ঝাড়ু, ফসল তোলা কিংবা বড় কোনো রান্নার আয়োজনের অন্যতম কর্মা। কাজের সুবাদে সবাই মেয়েটিকে পছন্দ করলেও পিতা-মাতার পরিচয়হীন এই মেয়েটির একমাত্র আশ্রয় নিরু ফকির। এ কারণেই সব কাজের পরেও মেয়েটিকেও মাঝে মাঝে তার বাবার সাথে ভিক্ষায় বের হতে হয়। অনেক সময় কাজের জন্য মানুষ প্রিয় হয়; পছন্দের তালিকায় আসে। কিন্তু সব কিছুই তো আর আচরণ দিয়ে অর্জন করা যায় না। তবুও নিরুর ফকিরের মেয়ের কণ্ঠে সবাই যখন নিজেদের সামাজিক দায়ের বিষয়টি বুঝতে পারল; তখন ধীরে নিচু সমাজ থেকে কিছু মুখ এগিয়ে এলো। দুর্ঘন্ধ ভেদ করে সবাই এমন পরিবেশে প্রবেশ করতে পারে না। যারা পারল; তারা বমি করা ভুলে গেছে।
দাদীর দাফন শেষে; নাম একা। কী যেন নেই। অশ্চর্য রকমের একটি ঘটনা। অসুস্থ মানুষ হারিয়ে গেলেও যে শুন্যতা হয়; তা নামের নীরবতাই বলে দিচ্ছে।
রাতে খাবার নেই। সমাজ বিষয়টি ভুলে গেলেও একটি প্রাণে তার খবর হয়েছে। পেটে পেটে যে টান তা ক্ষুধার্তদের মাঝেই হয়। নিরু ফকিরের মেয়েও মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকে। কিন্তু আজ তার ঘরে খাবার আছে বলেই সে নামের দরজায় খাবারসহ হাজির হয়েছে। নীচু সমাজের ভালো লেনদেনে মধ্যম সমাজের খুব মাথা ব্যাথা হয়।
অনেক সময় এই ব্যাথা ভালোও যে হতে পারে, তা এই ঘটনা থেকেই বলা যায়। সবাই গল্পে গল্পে দুই ফকিরের মধ্যে সম্পর্কের রটনা ঘটিয়ে বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে গেল।
নিরুর মেয়ে এবং নামের সংসার হলো। এ সংসারে দেনমোহর হল না। কীভাবে দিন চলবে, তার আলোচনাও হলো না বিন্দু পরিমাণ। দুটি দেহ, ক্ষুধার্ত পেটে প্রাণ বেঁধে এক হলো।
নিরু ফকিরের পাতানো এক বোন, সে নিজেও ভিক্ষা করে। নিরুর মেয়ের সংসার দেখতে এসেছে। তেমন কিছু দিতে না পারার অপরাগতা স্বীকার করে বৃদ্ধা কিছু বচন শুনিয়ে গেল, “কয়েকজনের আছে; কয়েকজনের নেই। যাদের আছে তারা অন্যকে কিছু দিয়ে ভারসাম্য আনুক। সবাই সুন্দর হোক। সুন্দরে ভরে যাক পৃথিবী!”
পাশে থেকে নাম কথাগুলো শুনল। ওর মনে পরে গেল, ওর দাদী যখন সুস্থ ছিল তখন কত সুন্দর সুন্দর কথা দাদী বলত। রমজানের সময় ভিক্ষা করা দুয়েকটি খেজুর দিয়ে ওকে ইফতার করাতো। একবার কোনো এক রোজায় নামের দাদী ওর প্রশ্নের জবাবে বলেছিল, ”সবাই একইভাবে রোজা রাখে না৷ কেউ ঘামে ভেজা শরীরে, ক্ষুদ্র আয়োজনের মাধ্যমে স্রষ্টার শুকরিয়া করে সেহরি- ইফতারের আয়োজন করবে৷
কেউ দামী দামী বস্তা ভরা পুষ্টি খেয়ে, সারাদিন ঘুমিয়ে রোজা রাখবে৷
অথচ রোজা একটি উপলব্ধি৷ অল্পতে তুষ্ট থাকার চেষ্টা।” এটা নাকি দাদীর বাবা বলেছিলেন তাকে। ওর দাদীর বাবা নাকি ভিক্ষুক ছিল না। দাদীর কপাল উনাকে ভিক্ষায় নামিয়েছে। এতো উন্নত কথার সেই মানুষটি, দাদীর বাবা তিন বিয়ে করেছিলেন। দায় সারা করে মেয়েকে কোনোমতে বিয়ে দিয়েছিলেন। নামের বাবার জন্মের পর সেই দাদা তার দাদীকে ছেড়ে অন্য কোথাও সংসার বসায়। ছেলেকে অনেক কষ্টে বড় করতে পারলেও সুষ্ঠু চিকিৎসার অভাবে বাঁচাতে পারেন নি। নামের জন্মের পর তার বাবা মারা গেলে, মাও হারিয়ে যায় সমাজের অন্ত গহীনে। পরেছিল দাদীর ভিটায় দুটি প্রাণ।
বিয়ের পর নামের ভিতরে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সংসারের দায়ভার কিছুটা অনুভব করতে পারলেও সঙ্গীর রূপ-যৌবন নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে বুঝেছে, দাদী গেছে; এখন ঘর খালি হয়ে যাওয়ায় কপালের ফেরে ঘরে অন্য কেউ এসেছে।
নিশিত রাতে যখন চাঁদের সাথে তারাদের গল্পরা জমে ওঠে তখনও সে ঘরে
কোনো কথা হয় না। কিবানু ভিক্ষুকের মেয়ে; তার মনে ভিক্ষার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জেগে ওঠে। নাম ভিক্ষা না করলেও দাদীর কাজের দিকেই তার প্রবৃত্তি সায় দিচ্ছে। দু’টি প্রাণই আদম-হাওয়ার সন্তান। অথচ সমাজের উন্নত সমাজের মতো তারা ভাবতে পারছে না। দু’জনেই নিজেদের পুর্ব অভিজ্ঞতায় ঝুকে যাচ্ছে। এভাবে নানান ভাবনায় তারা একে অন্যকে নিয়ে ভাবছে। পেটের কথা ভাবছে। ক্ষুধার ভবিষ্যৎ সমাধান খুজছে।
এভাবেই কিবানুর বাবার ভিক্ষার পয়সাতেই তারা কয়েকদিন পার করলেও তারা তাদের নিজেদের জন্য কোনো সমাধান পায় নি।
পৃথিবীর নিয়মে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, পথ বন্ধ বলে কিছু নেই। কোনো না কোনো দিক থেকে মানুষ বের হওয়া কিংবা প্রবেশ করার পথের সাক্ষাৎ পাবে। নামও পেল; একটা ডাক। কবর খুড়তে হবে।
চৌধুরি সাহেবের ছোট ছেলেটা আত্মহত্বা করেছে। গ্রাম জুড়ে রটে গেছে প্রেমের জন্যই নাকি তার এই দেহত্যাগের করুণ সিদ্ধান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক অপরূপার প্রেম বিচ্ছেদ ঘটনা।
নাম কবর খুরছে। পাশে লোকে বলাবলি করছে, ছেলেটির প্রেমের মহত্ত্ব। পাশাপাশি শাজাহান-মমতাজ, দেবদাস-পারুর নামও শুনছে সে। নামের কাছে বিষয়টি বিরক্ত লাগছে। প্রেম আবার কী? একজন অন্য জনের জন্য জীবন দেবে কেন? মানুষের জীবন কি এতোটাই সস্তা? লাশ কবরে দেয়ার সাথে সাথে পৃথিবী থেকে একটি নাম সরে গেল। প্রেমের জন্য যার আত্মত্যাগ সে কি পেয়েছে তার প্রেম কে?
নামের কবর খোরা, বাঁশ কাটার ধরণ মোটামুটি সবার নজরে এসেছে। ভিক্ষার থলি হাতে নেয়ার পুর্বেই সে বাঁশ কাটার ডাক পাচ্ছে বেশ রকমের। গ্রামের সবাই জানে, নামের নতুন বিয়ে; তাই বোধহয় টাকার পরিমাণও কিছুটা ভারী হয়েছে। যে যার জায়গা থেকে হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিবানুও বুঝতে পারছে স্বামীর আয়ের সাথে সাথে তারও মর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এর আগে সবাই তার উপর আদেশ জারী করত তাদের কাজ করার জন্য কিন্তু এখন অনুরোধ করে।
কিবানুর গায়ের রং; এবরো-থেবরো দাতের কথা স্বাভাবিক সমাজ যত নিম্ন ভাবেই নিক না কেন; নামের কাছে এই মেয়েটিই ক্ষুধা সময়ের সঙ্গী। তার শরীর খাটানো পয়সা কিবানুর পেটের জন্যও বরাদ্দ সমানভাবে।
প্রবাসী নবাব মারা গেছেন। অনেক পয়সা রোজগার করে একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন লোকটি। বছর তিন পর, নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলেও প্রিয়জনদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন ঘামার্জিত অনেক সম্পদ। কিন্তু তার বেঁচে থাকাকালীন প্রিয়রা যে পরিমাণ ছিল, এখন তার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে তা বৃদ্ধি পেতে থাকল। আশ্চর্য রকম ভাবে আত্মীয় স্বজনেরাও একটু বেশিই কান্না করছে। অথচ নবাব যে নারীর সাথে তার জীবনের ভাগাভাগি করা প্রতিজ্ঞা করেছিল; সে নারী পাথর হয়ে গেছে। সময়ে সময়ে, জীবন যুদ্ধে সরল সে যুবার মৃত্যু হলে, তার স্ত্রীর জন্য রেখে যাওয়া সম্পদ বণ্টিত হলো অন্যদের মাঝে। মেয়েটি শুধু যেন পেল, অন্যকে বিয়ে করার অধিকার। অথচ তার কাজল ঢেকে দেয়া রক্ত; অমাবস্যায়ও আড়াল হয় নি।
নবাবের কবরটিও নামের হাতে খোরা হয়েছিল। নাম কবর খুড়তে খুড়তে, বাঁশ কাটতে কাটতে কিবানুকে গড়ছে। কিবানুও তার স্বামীর জন্য বাড়ি ঘরের সজ্জা বৃদ্ধি করছে। নাম কিবানুকে নিয়ে রোমান্টিক কোনো ভাবনা ভাবে না; কিন্তু সে সাধারণ মানুষের মতো কিবানুকে খাবার দিতে চায়।
মেয়েটির মুখ লাল করানোর জন্য পান এনে দেয়। কালো ঠোটের সে রূপে স্বাভাবিক মানুষের জন্য রূপ না থাকলেও নামের চোখে একটি ক্ষুধার্ত পেটের সুখ চোখে আসে। নিজের পেটের প্রশান্তিতে, নাম তার কিবানুর ক্ষুধা মিটে যাওয়ার মুক্তি দেখতে পায়। তার সংসারে রূপের জন্য আফসোস নেই। এখানে সংসারের দায়িত্বটিই বড়।
দেখতে দেখতে নাম ও কিবানুর ঘরে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হলো। তবে তার পরিচয় ভিক্ষার সাথে যোগ হল না। বরং সে বড় হয়ে সমাজের নামী কোনো ঘরে বিয়ে করল; অভাবহীন সে দম্পতিদের মাঝে বহুদিন কবিতারা ঘুরে বেড়াল। জীবন ও কবিতার পাশাপাশি সম্পদ ও সম্পর্কের প্রদর্শণ চল্ল যেখানে-সেখানে। তাদের রচনার ভাবার্থ; অভিনয়ের শালীনতা ছিল এমন-
ক্ষুদ্র একটি গল্প প্রিয়,
ব্যবধান শেষে শুনিয়ে যেয়ো।
জানা শব্দে, জানা ঢঙ্গে, পাশে থেকো।
দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখার, সে সময় শেষ হয় না যেন।
এভাবেই সমাজের চোখে সফল কোনো এক দম্পতিতে তারা রূপায়িত হলেও ভিতরে ভিতরে কবিতার ছন্দমালা, একদিন জীবনের পরিবর্তনে হারিয়ে গেল। তাদের সংসারে পুর্বের রূপে, ক্লান্তি এলো। ক্লান্ত সে অভাবহীন যান্ত্রিকতা মনে মনে তৃষ্ণার্ত হলো।
অথচ রূপ ও লোভের উপরে জীবনের স্থিতি স্থির থাকে। প্রকৃতি কালো-সাদাতে বিলীন। নানা রঙ্গের নানান চিত্র; একে অন্যতে লুকানো আছে। পৃথিবীর কোনো ধরণই অনর্থক কিংবা ভিত্তিহীন নয়। সূত্রগুলো নির্দিষ্ট গতিতে থাকার জন্য; নির্দিষ্ট ভারসাম্য বুঝানোর জন্যই আকাশের নীলে দৃষ্টি রাখে।
নাম ও কিবানুর জীবনে কোনোদিন কবিতা আসেনি বলেই বোধহয় নামের মৃত্যুর পরেও কিবানু তার সংসারের ভাঙ্গা জায়গাগুলো মেরামত করে। নাম নেই; কিন্তু কিবানু নামের বৃদ্ধা এখনও তার হৃদয়ে বয়ে বেড়ায় প্রেমহীন শুদ্ধ সংসার।
----------- প্রেমহীন শুদ্ধ সংসার
----------- আব্দুল্লাহ আল- মাহমুদ
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:৪৪