বড় চাচা মারা গিয়েছে তবুও সজল এতো সুখ আগে কখনও পায় নি। মৃত্যু ভাগ্য সম্পর্কে বাস্তবিক এক অভিজ্ঞতা হলো তার। সকাল সকাল, সে শুনতে পেল ওর চাচা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সবার মতো সজলও তাকে ঘিরে দাড়িয়েছে। চাচার ছেলে-মেয়েরা চতুর্দিক থেকে উনাকে দোয়া পড়াচ্ছিল। চাচাও তাদের তালে তালে দোয়া পড়ছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, আমাকে একটু ডানকাত করো। ডান কাত করার পর তার বড় ছেলের বউ হয়ত কিছু একটা টের পেয়েছিল। শুধু বল্লেন, “আব্বা ......”! সজলসহ সবাই বুঝতে পারল লোকটি চির নিদ্রার কাছে ধরা পড়েছেন। এ ঘুম আর ভাঙবে না।
সজলের ভিতরটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তাড়নায় শীতল হয়ে গেল। এই চাচার সাথে সে কতো গল্প করেছে। রাজনীতির এপিঠ-ওপিঠ শুনেছে। জীবনের সাদা-কালো চিত্র বুঝেছে। দেখা হলেই জ্ঞানগর্ভ কতো গল্প করেছে সে। অথচ আজ চোখের সামনে মৃত্যু সম্পর্কে বাস্তবিক কোনোরূপ অভিজ্ঞতার বর্ণন না দিয়েই, তিনি বিদায় নিলেন। মৃত্যু সম্পর্কে তার অনেক কিছুই জানার ছিল। এতো স্বাভাবিক আনুষ্ঠানিকতার মাঝে, দোয়া পড়তে পড়তে কীভাবে মৃত্যু হয়; মৃত্যু যে সহজও হতে পারে তা যেন চাচার মৃত্যুতে কিছুটা বুঝতে পারল সজল।
দিকে দিকে প্রচার হয়ে গেল, ‘নাসির সাহেব মারা গিয়েছে’। সবাই আসছেন, বলছেন। সজল শুনছে, ‘কালই কথা হলো’ ‘দেখা হলেই দাদা কী সুন্দর সুন্দর কথা বলত’ ’জানা মতে, লোকটি কোনদিন কারও দুই পয়সা মেরে খান নি’ ‘ছেলে-মেয়েদের ইনসাফ করে গেছেন’ ‘কাউকে ছোট করে কথা বলেন নি’ ‘রাগী থাকলেও গ্রামের কাউকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেন নি’।
আরও কতো ধরনের কথা চলছে। সজল জানে, মৃত ব্যক্তির সামনে মানুষ নানাভিনয়ে মিথ্যা প্রশংসাহ করলেও তার চাচার বিষয়ে কোনটিই বাড়াবাড়ি কিংবা মিথ্যা নয়।
সবাই লাশের মুখ দেখছে। সজল, প্রিয় মানুষদের মৃত্যু মুখ দেখে না। শেষ জীবন্ত চিত্রটিই সে ধরে রাখতে চায়। সে চায় না, তার চাচার মৃত মুখ কখনও তার সামনে ভেসে আসুক।
শেষ চেহারাটা তার মনে পড়ছে, চাচা থেমে থেমে পড়ছেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নাই। তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সা: তার বান্দা ও প্রেরিত রাসুল।) ”।
চাচার মৃত্যু, সজলের সুখের অন্যতম কারণ। তার চাচা গড় বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বয়সে মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় স্রষ্টার কাছে চলে গিয়েছেন। উনার জীবদ্দশায় তিনি গ্রামের সকল হিন্দু-মুসলিমের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। তার সন্তানেরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। তিনি গীবতের চেয়ে প্রশংসা করার চেষ্টা করেছেন বেশি। সব চেয়ে বড় কথা কারও বোঝা না হয়ে, শান্ত এবং নির্মল, পারিবারিক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ধর্মীয় সুর জপতে জপতে নিদ্রা গমণ করেছেন।
চাচার সাথে জীবন্ত কথাগুলির কতো-শত দর্শন ছিল, আহা। এতো বয়সেও কতো সৃজণশীল ভাবনা মস্তিষ্কে জমা রেখেছিলেন। চাচার কাছ থেকে সজল ধর্মীয় কিছু দর্শন সম্পর্কে বুঝেছে-
আমি মানি কিংবা না মানি, স্রষ্টা তো তার সৃষ্টি থেকে বড় হবেনই। প্রভুর সমকক্ষ আর কিছু হতে পারে না; একটি বিশ্বাস। মানুষ তার পরিবেশ থেকে বিশ্বাস অর্জন করে। তারপর ধীরে ধীরে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুভবে জ্ঞান রাখতে রাখতে এক সময় পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন ভাবে বিবেকে স্থির হয়। যারা স্রষ্টার একত্ববাদে বিশ্বাস করে; তাদের তো অহংকার করার কথা নয়। স্রষ্টায় শ্রদ্ধাবোধ রাখা মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টিকে কোনো কিছু করাতে বাধ্য করতে পারে না। স্রষ্টা-সৃষ্টির বিশ্বাসে তৃতীজনকে ফয়সালা দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয় নি। সৃষ্টির তালিকায় একমাত্র মানুষই বিজ্ঞানের ধ্যানে নিজেকে সাক্ষর করেছে। আদম-হাওয়ার প্রারম্ভ, চিন্তা-ভাবনায় সৃজণশীল কার্য, ইতিবাচক সামাজিক অংশগ্রহণে কখনও এক মানুষ অন্য মানুষকে অবজ্ঞা করার ক্ষমতা রাখে না।
সজলের চোখে, হজ্জ্ব করার পর ওর হাজী চাচা কোনদিন তার আচরণে অহংকারের প্রদর্শন করেন নি। বরং হজ্জ্ব করার পর তার ধর্মীয় জ্ঞানের অন্যতম কথা ছিল- রাসুল (সাঃ) ছিলেন, তার সময়ের, তার জন্মস্থানের উন্নত ব্যক্তিত্ব। দল-মত নির্বিশেষে তৎকালীন ইতিহাস তাই বলছে। সুতরাং প্রতিটি মুসলিম হবে তার সময়ের, তার সমাজের উন্নত ব্যক্তিত্ব। সে মিথ্যা বলবে না। অশ্লীল হবে না। অন্যের হক মেরে খাবে না। মানুষকে অযথা হয়রানি করবে না।
সজলের চাচী মারা গেছেন প্রায় পনেরো-ষোলো বৎসর হলো। ইচ্ছা করলে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারতেন কিন্তু সন্তানদের কথা চিন্তা করে হয়ত তা করেন নি। সত্যি বলতে তাকে দেখে সজল কিছুটা আচ করেছিল যে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও, জীবন অনেক বড়। ডট ডট যখন বিন্দু বিন্দু; তখন ৩৬০ ডিগ্রি পরিভ্রমণ না করলেও জীবনের পরিসর অনেক বড়।
লোভ কিংবা হিংসা, জীবনকে ছোট করে দেয়। চোখ, কান, নাক, অনুভব -এ সবের জন্য লোভ ততটা গুরুত্ব রাখে না। যেখানে মরণ সত্য; সেখানে যতটুকুই তা হোক, তার আকার বড়।
জন্ম বড়, মত্যু ছোট। যারা জন্মেছে, তারা বেড়েছে। যারা মরেছে, তারা ফির জন্মেছে; সে জনম আরও বড় হবে হয়ত। সে জনমে প্রিয় মানুষেরা, হয়ত একটি প্রিয় জগতের মাঝে চির হয়ে থাকবে।
------- মৃত্যু ভাগ্য
------- আব্দুল্লাহ আল- মাহমুদ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:৪৬