পাশের বাদামওয়ালা বাদাম রেখে দিব্বি সিগারেট টানছে। সিগেরেটওয়ালাও স্থির হাসির ভাব রেখে দু-একটা বাদাম খাচ্ছে। ভিন্ন স্বভাবের, ভিন্ন গোত্রের নানান বর্ণের মানুষগুলো এখানে আসে। নেই কোনো সতেজতা, নেই কোনো নিঃস্বাস নেয়ার মতো উন্নত পরিবেশ তবুও আকাশের তারার ভীড়ে বাস টার্মিনাল ভিন্ন একটি জায়গা।
নদী যখন ছোট ছিল তখন বড় দা তাকে ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছে সব। বড় দা’র সংসার হয়েছে। সে এখন অন্য কাউকে ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখায়। নদীর ছোট ছেলেও অনেকটা বড় দা’র মতো। ঘুরে দেখছে সব। মা, ঐ মানুষগুলো নোংরা কেন; সবাই এতো রাতে কী করছে; উনাদের বাড়ি কোথায়; আরও কত ধরণের প্রশ্ন। রাজীবের বাবাও কোথায় যেন গেল, বোধহয় বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও চা খাচ্ছে। বড় ছেলেটা হয়েছ ওর বাবার মতো। ক্ষুধা লাগলে খাও, ভালো না লাগলে ভালো লাগিও না। আকাশের তারা, পূর্ণিমার চাঁদ, নদীর স্রোতে তাদের কাজ নেই।
নদীর বড় মেয়ে সুবাহর শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছে ওরা। মেয়ের সাথে প্রতিদিনই কথা হয়। আজ প্রায় একমাস পর মেয়েটিকে ছুয়ে দেখবে সে।
তারার মিছিলে, রাত এগারোটাকে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা। দূর পাল্লার বাস ছাড়া তেমন সমাগম নেই। আটটার সময়ের গাড়ি। রাস্তায় কী এক গণ্ডগোল হয়েছে, এখনও খবর নেই। কাউন্টারে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। নদী ছোট ছেলের সঙ্গে হাটাহাটি শুরু করল।
সত্যি, এতো রাতেও কতো মানুষের সমাগম এখানে। সবাই ছুটছে। কোনো এক জরুরী কাজের টান টান উত্তেজনা সবার মাঝে। কেউ কাউকে চিনে না, অথচ সবাই একই ভাবে ব্যস্ত। টার্মিনাল দৌড়াচ্ছে নাকি মানুষগুলো চলছে বুঝা মুশকিল।
বয়স্ক এক লোক। মাথায় টুপি। গায়ের রং কালো। ফ্লাক্সে করে, রং চা বিক্রি করছেন। অপরিচ্ছন্ন এই লোকটিকে দেখে বাবার কথা মনে পড়ল নদীর। তার বাবাও এমন বয়স নিয়ে ওপারে গিয়েছে। বাবার স্নেহ প্রত্যাশার মহানুভবে লোকটির কাছে এসে ’চাচা’ সম্বধনে জিজ্ঞাসা করল যে তিনি কেমন আছেন। লোকটিও যেন বহুদিন ধরে তার কোনো হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে খুজছিলেন। গল্প চল্ল কাছাকাছি সম্পর্কের মানুষের সাথে যতটুকু করা যায়, ততটুকু। চাচার বাড়ি গ্রামে। থাকেন ছেলের সাথে কোনো এক রিক্সার গ্যারেজে। তার ছেলে টার্মিনালের কোনো এক পাশে, দোকানে, চা বিক্রি করেন। তার জীবন নাকি পূর্ণতা পেয়েছে, শুধু তার ছেলের ভালোবাসা অর্জন করার জন্য।
হঠাৎ বাবার কথা মনে গেল নদীর। রাতের নামাজে কেন জানি মাঝে মাঝে খুব কাঁদতেন। বড় দা’র সঙ্গে মাঝে মাঝেই নামাজ নিয়ে বাকবিতণ্ডা লাগত তার। বাবা মাঝে মাঝেই বলতেন, “বড় ছেলেটা নামাজী হলেই জীবনের সব কিছুই পূর্ণ হতো”।
বাবার আশা তখন পূর্ণ না হলেও, তার পরলোকগমণের পর, বড়’দা ঠিকই নামাজ ধরেছে। বাবার সেই অবাধ্য ছেলেটাই এখন সংসারের সবচেয়ে শান্ত ও নিয়মানুবর্তিতা প্রিয় মানুষ। বড়’দার কাছে বাবার এতোটাই গুরুত্ব ছিল, আগে বুঝেনি নদী।
টার্মিনালের বিপরীত মুখের খোলা রাস্তার পাশে, রাজীবের সাথে ওর বাবাকে দেখা যাচ্ছে। কারও সঙ্গে মনে হয়, খুব আলাপ জমিয়েছে। ছোট ছেলেটার হাত ধরে, আকাশের তারা দেখছে নদী। অসংখ্য তারা মিটমিট করে জ্বলছে। নদী ছাড়া আর কারও চোখ আকাশে নেই। নদী, আকাশের দিকে তাকিয়ে, নিজেকে শৈশবের অনুভবে ভাবছে। বাবা-মা, বড় দা, মেজো ভাই ও আদরের ছোট ভাই মাহিনকে নিয়ে কতো চাঁদ দেখেছে ওরা।
আহা, বাস টার্মিনালের মতোেই যেন মানুষের জীবন। এক একটি জীবন, এক একটি টার্মিনাল। কেউ এখানকার আকাশ দেখে না। এখানে তেমন পরিবেশ নেই। দূরের গন্তব্যে পৌছানোর জন্যই মানুষ এখানে আসে। টার্মিনাল কেউ ভালোবাসে না, এখানে কেউ থাকতে আসে না। কোথাও হারিয়ে যাওয়ার জন্যই মানুষ এখানে আসে। এই টার্মিনাল শুরু করে, শেষ করে।
বাবার বাড়ি ছিল এক ধরণের টার্মিনাল। এখন সে আছে আরেক টার্মিনালে। এভাবেই হয়ত মানুষ কোনো এক সময় শেষ টার্মিনালে পৌছায়।
------ টার্মিনাল
------ আব্দুল্লাহ আল - মাহমুদ
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:২৩