পর্নোগ্রাফি নির্মাণের হোতারা অপ্রতিরোধ্য!
'আধুনিক ডিভিডি হোম' ও 'এম আর ওয়ার্ল্ড মুভি'। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার দুটি দোকান। ভিডিও সিডির পসরার বেশির ভাগ জুড়ে ছিল অশ্লীল সিডি! ১১ মার্চ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম শাখার সদস্যরা অভিযানে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখে অবাক হন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ড. আল-মামুনুল আনসারীর নেতৃত্বে অভিযানকালে দুটি দোকান থেকে জব্দ করা হয় ১০ হাজার ৫৭৫টি পর্নো সিডি। গ্রেপ্তার করা হয় মিন্টু ও হৃদয় নামে দুই বিক্রেতাকে। পরে পুলিশ কর্মকর্র্তারা জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা শুধু পর্নো সিডির বিক্রেতা নয়, তারা পর্নো সিডি তৈরির কাজও করে। এর আগে ১২ ফেব্রুয়ারি র্যাব-২ রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ হাজার ৭২৫টি পাইরেটেড সিডি, সিডির দুই হাজার মোড়ক ও ছয় চ্যানেলের একটি সিডি রাইটার উদ্ধার করে। অভিযানে ইয়াছিন নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়।
এমন অভিযান প্রায়ই চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না পর্নোগ্রাফি তৈরি ও বিক্রি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য ও কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বাজারে দেশি পর্নোর চাহিদা থাকায় নানা কৌশলে তৈরির কাজ চালাচ্ছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট। রাজধানীতেই প্রায় অর্ধশত সিন্ডিকেট সক্রিয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, এমনকি সুন্দরী গৃহবধূরাও জড়িয়ে পড়ছে এর সঙ্গে। গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে পর্নো সিডি তৈরি করা হচ্ছে। এক শ্রেণীর কথিত মডেল ও অভিনেত্রী পর্নো সিডি সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। চলচ্চিত্রের সিন্ডিকেট তৈরি করেছে নতুন বাজার।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গত এক বছরে শুধু র্যাবই প্রায় ১১ লাখ সিডি-ডিভিডি উদ্ধার করেছে। এ সময়ে অন্তত ৮০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অশ্লীল ও জাল সিডি-ডিভিডির বিরুদ্ধে নিয়মিত র্যাবের অভিযান চলছে।'
রাজধানীতে অর্ধশত সিন্ডিকেট : র্যাব সূত্র জানায়, কম্পিউটার ব্যবসায়ী আহম্মেদ হোসেন জুয়েল ধানমণ্ডির 'রায়হান আর্কাইভ' ও 'দ্য হোম টাইম' নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। অভিযোগ আছে, রাজধানীর পর্নো সিডি তৈরি ও বাজারজাতকরণের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক সে। ধানমণ্ডির ১৩ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় জুয়েলের তত্ত্বাবধানে চলত পর্নো সিডি তৈরির কারখানা। ২০০৮ সালে র্যাব-৩ অভিযান চালিয়ে জুয়েলের পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করলেও সে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সূত্র জানায়, পাঁচ-ছয়টি মিউজিক ভিডিওতে নৃত্যশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছে সিনথিয়া। ভোলার ইলিশা এলাকার মেয়ে সিনথিয়া নৃত্যের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে পর্নো সিডি তৈরি ও বাজারজাতকরণের একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক। লন্ডন প্রবাসী সিলেটের মুজিব মিয়ার অর্থায়নে এ সিন্ডিকেটে রয়েছে তোফায়েল আহম্মেদ জালাল ও স্টার লিংক প্রডাকশনের কর্মকর্তা রাসেল। সিনথিয়া সিন্ডিকেট ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শুটিং স্পটে পর্নো সিডির চিত্র ধারণ করে। পর্নো সিডির নায়িকা সিনথিয়া নিজেই! সিনথিয়ার সহযোগী নায়িকা হিসেবে রয়েছে সিলেটের কুলাউড়ার মেয়ে সুমী। ২০০৫ সালের ৭ মে সিলেটের বাদাম বাগিচার লন্ডনি মুহিব মিয়ার বাসায় পর্নো ছবি নির্মাণের সময় কোতোয়ালি থানা পুলিশ সিডির নায়িকা সিনথিয়াসহ সিন্ডিকেটের সদস্যদের পাকড়াও করে। তবে দুই মাসের মধ্যেই জামিনে বের হয়ে যায় চক্রটি।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের জুলাই-আগস্টের দিকে উত্তরার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুর রশিদের ছেলে নূরদ্দিন মোহাম্মদ ওরফে শাহিন ও এক শিল্পপতির স্ত্রী অলিভিয়া পর্নো সিডির আলোচিত চরিত্র। একটি আলোচিত পর্নো ছবিতে শাহিন ও অলিভিয়া ছাড়াও নায়ক ছিল দুজন। আলোচিত পাঁচ নায়িকার মধ্যে অমি ও বৃষ্টি ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মিতু নামের আরেক তরুণী ছিল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। পর্নো সিডিগুলো বাজারজাত করা হয়েছিল 'সাইবার জোন' নামে নীলক্ষেতের একটি দোকান থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র ছিল এ সাইবার জোনের মালিক। কেউ সিডির অর্ডার দিলে কম্পিউটার থেকে তা কপি করে দেওয়া হতো। ডিবি নীলক্ষেতের সাইবার জোনে অভিযান চালিয়ে কনকুজ্জামান নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের শাহিনের তৃতীয় তলা বাড়িতে অভিযান চালালে বের হয়ে আসে পর্নো সিডি চক্রের সিন্ডিকেটের পরিচয়।
তৎকালীন প্রশাসন কয়েক দিন তোলপাড় করলেও পরে ধামাচাপা পড়ে যায়। এদিকে বারিধারার রাজউক প্রজেক্টের ১০ নম্বর রোডের ৬২ নম্বর বাড়ির ষষ্ঠ তলার পূর্ব পাশের ফ্ল্যাটে পর্নো ছবির চিত্রনির্মাণ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। কথিত মডেল রিয়া হোসেনের তত্ত্বাবধানে চলে পর্নো ছবির শুটিং। নিজেকে মডেল ও অভিনেত্রী পরিচয় দিলেও সে কোনো বিজ্ঞাপনের মডেল হয়নি।
জানা গেছে, মিউজিক ভিডিও নির্মাণের নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান পর্নো ভিডিও সিডি নির্মাণ করে বাজারজাত করছে। মগবাজার, পল্টন, খিলগাঁও, তেজগাঁও, মহাখালী ও গুলশানের ভিসিডি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো জিপিও কোড ব্যবহার করে পত্রিকায় টিভি নাটক, মডেলিং ও চলচ্চিত্রে আগ্রহী মেয়েদের কাছে ছবি আহ্বান করে। এরপরই হয় প্রতারণা। কেউ ইচ্ছায় আবার কেউ অজান্তেই জড়িয়ে পরে দুষ্টচক্রে।
চলচ্চিত্রে সিন্ডিকেট : বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির নিষিদ্ধ ঘোষিত এবং সেন্সর বোর্ডের অনুমোদনহীন অশ্লীল চলচ্চিত্রের ব্যবসা করছে কিছু অসাধু চক্র। এসব চক্র চলচ্চিত্রের সঙ্গে অশ্লীল দৃশ্য সংযোজন করে। র্যাব কর্মকর্তারা জানান, অশ্লীলতা ও ভিডিও পাইরেসি প্রতিরোধ বিষয়ক টাস্কফোর্স ইতিমধ্যে প্রায় ৪০০ বাংলা সিনেমাকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই এসব চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এখনো গোপনে অভিযুক্ত সিনেমার প্রদর্শনী চলছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে কাকরাইলের ইস্টার্ন কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সে সেন্সর অনুমোদনহীন ও অশ্লীল সিনেমার ক্যান ও পোস্টারসহ বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক কালাম কায়সার ও ব্যবস্থাপক নূর মোহাম্মদ বাদলসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। অভিযানকালে ১৮টি অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ সিনেমার ৩৯০টি ক্যান এবং এক হাজার ২২১টি পোস্টার জব্দ করা হয়। র্যাব-২-এর কম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ এরশাদুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, অশ্লীলতা ও ভিডিও পাইরেসি প্রতিরোধ বিষয়ক টাস্কফোর্সের অভিযোগে এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালাচ্ছেন তাঁরা। অভিযানে দেখা গেছে, এখনো অনুমোদিত সিনেমার সঙ্গে অনুমোদনহীন (অশ্লীল) দৃশ্য যুক্ত করে দিচ্ছে একটি চক্র। এ ছাড়া কালো তালিকাভুক্ত বাংলা চলচিত্রগুলোরও গোপনে প্রদর্শনী চলছে।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর পরিচালক কালাম কায়সার অশ্লীল চলচ্চিত্র রাখার অভিযোগ স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওয়ান-ইলেভেনের আগে এসব কমার্শিয়াল ছবি চলত। এখনকার হিসেবে এগুলো অশ্লীল।' তিনি আরো জানান, গ্রামে-গঞ্জে অশ্লীল দৃশ্য জুড়ে দেওয়া সিনেমার চাহিদা রয়েছে। এক ধরনের সিনেমা হল মালিক আছেন যাঁরা এ ধরনের সিনেমা খোঁজেন। তাই অনেক সিনেমা ব্যবসায়ী গোপনে এসব কাজ করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক প্রতিষ্ঠানের অনেকেই জড়িত চলচ্চিত্রে জুড়ে দেওয়া কাটপিস বা পর্নো ছবি তৈরি ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে। শরীফ ও দিলীপের নিয়ন্ত্রণে আছে পর্নো সিডি বাজারজাতকরণের একটি সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট সদস্যদের মধ্যে আছে এনামুল হক, পলাশ, শাহিন ও কালাম। নীলছবির হোতা এ সিন্ডিকেট। মামুন শাহ নামে আরেক চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য একটি সিন্ডিকেট। ২০০৬ সালের আগস্টে মতিঝিল থানা পুলিশ পর্নো সিডি বাজারজাতকরণের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করে। কিছুদিন পরই ছাড়া পায় মামুন শাহ। কলেজের এক মেয়েকে ভালোবেসে একটি হোটেলে নিয়ে গোপনে ভিডিও রেকর্ড করে সে তা বাজারজাত করে। পুরনো ঢাকার পাটুয়াটুলীর বাংলা প্রডাকশনের মালিক শরীফ নিয়ন্ত্রণ করে আরেকটি সিন্ডিকেট। জানা গেছে, চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত পরিচালক শরফুদ্দিন আহমেদ দিপু, শাহীন সুমন, বাদশা ভাই, রাজু চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী, কালাম কায়সার, শাহাদাৎ হোসেন লিটন, জেএস কথাচিত্রের প্রযোজক জসিম উদ্দিনসহ কয়েকজনের পৃষ্ঠপোষকতায় অশ্লীল দৃশ্য তৈরি হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ও পাইরেসি বিষয়ক টাস্কফোর্সের তালিকা অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে প্রযোজক সুমন দে, সাজ্জাদ হোসেন ও আবু আহমেদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় পরে মুক্তি পায় তারা।
'নগ্নতার অস্ত্রে' ব্লাকমেইলিং : সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শেষ বর্ষের ছাত্র শাকিল আহমেদ। ফেইসবুকে এক কলেজছাত্রীর অশালীন ছবি আপলোড করার অভিযোগে গত ১৮ মার্চ তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। র্যাব-১-এর সহকারী পরিচালক আবদুল বাতেন কালের কণ্ঠকে জানান, পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে ওই মেয়েটির সঙ্গে শাকিলের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর সম্পর্ক ভেঙে গেলে অশ্লীল মেসেজ পাঠায় ও ফেইসবুকে মেয়েটির নামে অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে তার অশ্লীল ছবি আপলোড করে শাকিল। শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলিং। শাকিলের কথা মতো না চললে আরো ছবি আপলোড করা হবে বলে হুমকি দেয়। উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডের ১৭ নম্বর বাসায় অভিযান চালানোর সময় ওই তরুণী ছাড়াও দুটি মেয়ের সঙ্গে শাকিলের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও পাওয়া যায়।
সূত্র জানায়, গত বছরের ১৪ অক্টোবর র্যাব-৩-এর একটি দল সবুজবাগ এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর আলম নামের এক মোবাইল প্রতারককে গ্রেপ্তার করে। জাহাঙ্গীর এক শিল্পপতির মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে আপত্তিকর কিছু ছবি সংগ্রহের পর মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। ভুক্তভোগী ওই শিল্পপতি মানসম্মানের কথা ভেবে ওই যুবককে ৫০ হাজার টাকাও দেয়। আরো বেশি টাকা দাবি করায় ওই শিল্পপতি র্যাব সদস্যদের শরণাপন্ন হন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে দেশে ৮৪টি পর্নো সাইটকে শনাক্ত করা হয়, যেসব সাইটে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীদের অশ্লীল ছবি আপলোড করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম শাখা ওই সাইটগুলো শনাক্ত করে।
পর্নো সাইটগুলো বিটিআরসি বন্ধের নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সমন্বয়হীনতায় তা এখনো কার্যকর হয়নি।
লিনক=
Click This Link
ও আইচ্ছা।