জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা ও ঠক ব্যবসার অভিযোগে ডেসটিনি, গ্রেট ইন্টারন্যাশনাল, নিউওয়েসহ দেশের সব মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) বন্ধের সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাকে নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুপারিশ করা হয়। এ খবরে দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। এমএলএম কোম্পানির নাম দিয়ে ঠকবাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে প্রতারণার শিকার মানুষ এ সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এর আগেও দেখা গেছে এমএলএম কোম্পানিতে কাজ করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বহু ছাত্র লেখাপড়া বিসর্জন দিয়েছে এসব কোম্পানিতে কাজ করে। আবার অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছে। তারপরও একের পর এক ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো এসব এমএলএম কোম্পানি গড়ে উঠছে। প্রতিনিয়ত মানুষ এসবে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া এমএলএম কোম্পানির নামে প্রতারণা ও ঠকবাজির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছে কমিটি।
সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি লুত্ফুল হাই। ওই সময় কমিটির সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, সংসদ সদস্য টিপু মুন্সী, শেখ আফিল উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণা নিয়ে সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ডেসটিনি ও গ্রেট ইন্টারন্যাশনাল, নিউওয়েসহ কয়েকটি কোম্পানির প্রতারণার বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন তারা।
কমিটির সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন বৈঠকে বলেন, ডেসটিনি নামে একটি এমএলএম কোম্পানি মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে গাছ বিক্রির নামে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পণ্য বিক্রির পরিবর্তে তারা ১০ হাজার টাকা দিলে ৬ বছর পর ২৫ হাজার টাকা ফেরত দেয়া হবে—এ ধরনের প্রতাণামূলক প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। খুলনা ও বরিশালে ডেসটিনির টাওয়ার নির্মাণের নামেও মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে বলে জানান তিনি। এই প্রতারণা বন্ধ এবং প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কমিটির সব সদস্য একমত হয়েছেন। কীভাবে এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা বন্ধ করা যায়, সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কমিটির সদস্যরা জানান, চাকরি দেয়ার নামে ডেসটিনি, নিউওয়েসহ এমএলএম কোম্পানিগুলো যুবসমাজকে প্রতারণা ও ঠকবাজির ব্যবসা শিক্ষা দিচ্ছে। বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি লুত্ফুল হাই জানান, এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
ডেসটিনির প্রতারণা সম্পর্কে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান গ্রাহকরা। ডেসটিনি সম্পর্কে একটি বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা মুরশিদুল ইসলাম জানান, কয়েকজনের কাছে শুনে তিনি ওখানে গিয়েছেন। তাকে জানানো হয়, এখন ৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি হিসাব খুললে ১২ বছর পর ৩৫ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। তারা আমার ৫ হাজার টাকা দিয়ে গাছ লাগাবে; ১২ বছর পর তার দাম হবে ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—তারা আমার ৫ হাজার টাকার পুরোটা গাছের পেছনে খরচ করতে পারবে না। কারণ আমি যার মাধ্যমে গাছ কিনব (অ্যাকাউন্ট খুলব), তাকে কমিশন দিতে হবে। সে যার মাধ্যমে ডেসটিনিতে এসেছে, তাকেও কমিশন দিতে হবে—এভাবে ছয় স্তরে ভাগ হবে আমার টাকা। ওই কমিশনের পর যা থাকবে, তা দিয়ে ডেসটিনির বিজ্ঞাপন, অফিস খরচ এবং উদ্যোক্তাদের লাভ ইত্যাদি মেটানোর পর গাছ লাগানোর জন্য খুব বেশি টাকা অবশিষ্ট থাকবে না। তিনি বলেন, ‘আপনিই চিন্তা করে দেখুন এত স্বল্প টাকায় যদি ৩৫ হাজার টাকা পাওয়া যেত, তাহলে কি বাংলাদেশের মানুষ এত গরিব থাকত?’
জাকারিয়া নামে অপর এক ভুক্তভোগী জানান, তাদের হিসাবটা বেশ সহজ। যেহেতু রিটার্ন দিতে হবে ১২ বছর পর, সেহেতু হিসাবে লাভ দেখাতে সমস্যা নেই। যখন ফেরত দেয়ার সময় হবে (এখনও কোনো অ্যাকাউন্টেরই ১২ বছর পূর্ণ হয়নি), তখন প্রথমে তারা কিছু অ্যাকাউন্টে পুরো ৩৫ হাজার টাকা ফেরত দেবে এবং সেটা ব্যাপক হারে প্রচার করবে যাতে গ্রাহকসংখ্যা গণহারে বৃদ্ধি পায়। ফলে একজনকে ৩৫ হাজার টাকা ফেরত দিয়ে অন্তত একশ’জন নতুন গ্রাহকের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা করে আদায় হবে। এভাবে তাদের মোট স্থিতি যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠবে, ঠিক তখনই এদের কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে যারা কর্মকর্তা পর্যায়ে আছেন, তারা বিপুলভাবে লাভবান হবেন। আর শেষেরদিকে যারা আসবেন, তারা সবাই প্রতারিত হবেন।
সূত্র