মহাদেব সাহা(জন্ম: ৫ আগস্ট ১৯৪৪) স্বাধীন বাংলাদেশের একজন অন্যতম প্রধান কবি। প্রথম কবিতার বই প্রকাশ পায় ১৯৭২ সালে- "এই গৃহ এই সন্ন্যাস"। এরপর একে একে প্রকাশ পায় ৫৪ টি কাব্যগ্রন্থসহ প্রায় ৯৩ টি গ্রন্থ।তিনি ১৯৮৩ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন।
জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর
যে-কোনো বিষয় নিয়েই হয়তো এই কবিতাটি লেখা যেতো
পিকনিক, মর্নিং স্কুলের মিসট্রেস
কিংবা স্বর্নচাঁপার কাহিনী; হয়তো পাখির প্রসঙ্গ
গত কয়েকদিন ধরে টেলিফোনে তোমার কথা না শুনতে
পেয়ে জমে থাকা মেঘ,
মন ভালো নেই তাই নিয়েও ভরে উঠতে পারতো এই
পঙ্ক্তিগুলো
অর্কিড কিংবা উইপিঙ উইলোও হয়ে উঠতে পারতো
স্বচ্ছন্দে এই কবিতাটির বিষয়;
কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রমত দেশের একজন কবির
মনু মিয়ার হাঁড়ির খবর ভুললে চলে না,
আমি তাই চোয়াল ভাঙা হারু শেখের দিকে তাকিয়ে
আন্তর্জাতিক শোষণের কথাই ভাবি,
পেটে খিদে এখন বুঝি কবিতার জন্য কি অপরিহার্য
জুঁইফুলের চেয়ে কবিতার বিষয় হিসেবে আমার কাছে
তাই
শাদা ভাতই অধিক জীবন্ত- আর এই ধুলোমাটির মানুষ;
এই কবিতাটি তাই হেঁটে যায় অন্ধ গলির নোংরা বস্তিতে
হোটেলের নাচঘরের দিকে তার কোনো আকর্ষণ নেই,
তাকে দেখি ভূমিহীন কৃষকের কুঁড়েঘরে বসে আছে
একটি নগ্ন শিশুর ধুলোমাখা গালে অনবরত চুমো খাচ্ছে
আমার কবিতা,
এই কবিতাটি কখনো একা-একাই চলে যায় অনাহারী
কৃষকের সঙ্গে
জরুরী আলাপ করার জন্য,
তার সঙ্গে কী তার এমন কথা হয় জানি না
পর মুহূর্তেই দেখি সেই ক্ষুধার্ত কৃষক
শোষকের শস্যের গোলা লুট করতে জোট বেঁধে দাঁড়িয়েছে;
এই কবিতাটির যদি কোনো সাফল্য থাকে তা এখানেই।
তাই এই কবিতার অক্ষরগুলো লাল, সঙ্গত কারণেই লাল
আর কোনো রঙ তার হতেই পারে না-
অন্য কোনো বিষয়ও নয়
তাই আর কতোবার বলবো জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই
অধিক সুন্দর।
আমার সজল চোখ বুঝলে না
তোমরা কেউ আমার সজল চোখ বুঝলে না, বুঝলে পেরেক
বুঝলে ডলার-পাউণ্ড, বিমানবন্দুর, যুদ্ধজাহাজ
তোমরা কেউ একটি খোঁপা-খোলা মেঘ বুঝলে না, বুঝলে রক্ত
বুঝলে ছুরি, বুঝলে দংশন,
তোমরা কেউ বন্ধুর পবিত্র মুখ বুঝলে না, বুঝলে হিংসা
বুঝলে রাত্রি, বুঝলে অন্ধকার, বুঝলে ছোবল;
তোমরা কেউ আমার সজল চোখ বুঝলে না, বুঝলে আঘাত
তোমরা কেউ বন্ধুর কোমল বুক বুঝলে না, বুকে মাটির
ঘ্রাণ বুঝলে না, বুঝলে অস্ত্র;
তোমরা কেউ বুঝলে না, বুঝলে না, বুঝলে না।
তোমরা একটি বকুলফুল বুঝলে না, কেনইবা কাঁদবে?
তোমরা একটি শস্যক্ষেত্র বুঝলে না, কেনইবা দাঁড়াবে?
তোমরা একটি মানুষ বুঝলে না, কেনইবা নত হবে?
তোমরা বুঝলে না মায়ের চোখের অশ্রু, পিতার বুকের দুঃখ
বুঝলে না শৈশব, বাউল, ভাটিয়ালি
তোমরা বুঝলে না, এসব কিছুই বুঝলে না।
গ্রামের মেঠো পথ, ফুলের গন্ধ, ঝিঁঝির ডাক
তোমরা কোনোদিন বুঝলে না, বুঝলে না নদরি গান, পাতার শব্দ
বুঝলে না সজনে ডাঁটা, পুঁইশাক, কুমড়োলতা
তোমরা হৃদয় বুঝলে না, বুঝলে লোহার আড়ত,
তোমরা কিছু বুঝলে না, কিছু বুঝলে না, কিছু বুঝলে না
শুধু বুঝলে চোরাগোপ্তা, বুঝলে রক্তপাত।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:১২