বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে কিভাবে পৌঁছায়ঃ
মুসা সাদিক : স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট ও বাংলাদেশ
সরকারের সাবেক সচিব।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুক্রবার দুপুর পৌনে ২টায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে শুরু করে আমি এই বেতারের একজন ওয়ার করেসপন্ডেন্ট ও সপ্তাহে দুবার 'রণাঙ্গন ঘুরে এলাম' ও 'মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম' দুটি কথিকার প্রচারক হিসেবে দেশবাসীর কাছে কিছু সত্য তুলে ধরতে চাই।
১৯৭১ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে রিলে করার সরকারি ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা রিলে না করায় সারা দেশের মতো চট্টগ্রামবাসীও বিক্ষোভে ফেটে পড়ল রাস্তায় রাস্তায়। সারা দিন ও সারা রাত চট্টগ্রামে গগনবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলল 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।' ৮ মার্চ আকস্মিকভাবে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের রেসকোর্সের ভাষণ প্রচার করা হলো।
২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে চট্টগ্রামের বীর জনগণ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ও চট্টগ্রাম পোর্ট পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ও অবরোধ করে ফেলে। ২৫ মার্চের দুপুরে চট্টগ্রামে ইপিআরের মেজর রফিক তাঁর সমন্বয়কারী ছাত্রনেতা বখতিয়ার নূর সিদ্দিকীর মাধ্যমে ছাত্রনেতাদের কাছে মেসেজ পাঠান যে সিআরবিসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাঁর ফোর্স সিক্রেট পজিশন নিয়ে ফেলেছে।
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরের ওপর যদি পাকিস্তানি সৈন্যরা আকস্মিক হামলা করে তা মোকাবিলার জন্য ২৫ মার্চ, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, জহুর আহম্মদ চৌধুরী প্রমুখ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও ছাত্রনেতা আবদুর রব ও ছাত্রলীগের অন্যান্য শীর্ষ নেতা গোপনে বৈঠকে বসেন। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করার বিষয়ে বৈঠকে বেশ কিছু গোপন সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
২৫ মার্চ সারা দিন ও সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে রাত ১১টার দিকে কাজেম আলী রোডের বাড়ি ফিরে কিছু খেয়ে আমার বড় ভাই ও আমি দৈনিক আজাদী অফিসে গেলাম রাত ১টার দিকে। আমাদের বাড়ি থেকে ১০-১২টা বাড়ি পরেই দৈনিক আজাদী অফিস। আমরা সেখানে হেঁটে গেলাম। দৈনিক আজাদী অফিসের দোতলায় আমরা সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমপির কাছে গেলে তিনি ঢাকা থেকে তৎক্ষণাৎ টেলিপ্রিন্টারে আসা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত ইংরেজি টেক্সট দেখালেন এবং বললেন : 'জাফর সাহেব, দেখুন ঢাকায় ম্যাসাকার (গণহত্যা) হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এখন আমাদের সামনে আলজিরিয়া-ভিয়েতনামের মতো দীর্ঘ স্বাধীনতার যুদ্ধ।' রাত তখন ১টা ১০ মিনিট। অর্থাৎ সেটা তখন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর। আমিও পড়লাম সেই টেলেক্স মেসেজ। টেলেক্স মেসেজটি আমি সঙ্গে সঙ্গে লিখে নিলাম। মেসেজটি ছিল নিম্নরূপ :
“This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. Sheikh Mujibur Rahman.”
২৬ মার্চ রাত ২টার দিকে বাসায় ফিরে এলাম। রাত ৪টায় মাইকের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আমাদের কাজেম আলী রোডের বাড়ির তিনতলা থেকে আমার বড় ভাই, আমি, আমার ছোট দুই ভাই ইসা ও মহীউদ্দিন নিচে নেমে এলাম মাইকে কী বলা হচ্ছে শোনার জন্য। আমি ও বড় ভাই দৈনিক আজাদী অফিসের দিকে পা বাড়ালাম, তখনো অন্ধকারের রেশ কাটেনি। সেখানে গিয়ে দেখলাম মিউনিসিপ্যালিটির সামনে আন্দরকিল্লায় মাইকিং হচ্ছে যে 'ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আপনারা স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালি ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্রদের হত্যা করেছে। ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাঙালি রুখে দাঁড়াও।' মাইকের এই ঘোষণা শুনে আমাদের মতো ঘর ছেড়ে বহু লোক দলে দলে আন্দরকিল্লার রাস্তায় নেমে আসে এবং গগনবিদারী 'জয়বাংলা' স্লোগান দিয়ে উল্লাস করতে থাকে। সকাল ৯টার দিকে আন্দরকিল্লা ও লালদীঘি মানুষে ভরে যায়। তাদের অনেকের হাতে বন্দুক, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, দেশি বল্লম ও লাঠিসোঁটা। ছাত্র-জনতার মধ্যে অনেক পুলিশ ও বাঙালি ইপিআরকেও দেখলাম। লালদীঘি থেকে আন্দরকিল্লায় সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফিরে দেখলাম অধ্যাপক ড. অনুপম সেনের শ্বশুরবাড়ির সামনের হোটেল ডি. সিটিতে প্রচণ্ড ভিড়। ভিড়ের মধ্যে দেখলাম সাইক্লোস্টাইল করা বাংলায় লেখা একটি কাগজ বিলি করা হচ্ছে। খুব কষ্ট করে একটা কাগজ নিলাম, দেখলাম, কাল রাতে দৈনিক আজাদী অফিসে দেখা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ইংরেজি টেক্সটের বঙ্গানুবাদ।
৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়া ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় স্বাধীন বাংলা বেতারে বঙ্গবন্ধুর নামে ও পক্ষে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন, এই তার পটভূমি। ওই ঘোষণার অনুষ্ঠানের চাক্ষুস সাক্ষীরা অনেকেই জীবিত আছেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহান বীর ও জেড ফোর্সের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালনকাল পর্যন্ত কখনো বিস্মরণেও উচ্চারণ করেননি যে তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা দিয়েছেন। বরং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁর চরম আনুগত্য ও সর্বোচ্চ আস্থা-শ্রদ্ধা প্রমাণ করে তিনি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় ও ১৯৭৪ সালের ২৬ মার্চ সাপ্তাহিক বিচিত্রার স্বাধীনতা সংখ্যায় স্বনামে নিবন্ধ লিখে দেশবাসীকে অবহিত করেন যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ও নামে তিনি ২৭ মার্চ কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ঘোষণা দেন। ১৯৭৪ সালে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদে চাকরিরত অবস্থায় স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে আমাকে জেনারেল জিয়াউর রহমান যে সাক্ষাৎকার দেন (তাঁর এডিসি ক্যাপ্টেন জিল্লুরের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নির্ধারিত হয়), তা দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলায় বহুবার ছাপা হয়েছে।
১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম টিঅ্যান্ডটির নন্দনকানন ওয়্যারলেস অপারেটর মাহতাব উদ্দিন আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর ওই মেসেজ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কিভাবে রিসিভ করলেন, তার বিবরণ দেন। তিনি বলেন, "আমার বড় ভাই মো. নুরুল আমিন ছিলেন ফৌজদারহাট ওয়্যারলেস অফিসের সুপারভাইজার। আমি ছিলাম নন্দনকানন ওয়্যারলেস অফিসের ওয়্যারলেস অপারেটর। আমার বড় ভাই নুরুল আমিন ২৫ মার্চের শেষ রাতে ফৌজদারহাট ওয়্যারলেস অফিসে ডিউটিরত অবস্থায় শেষ রাতে ঢাকার মগবাজার ওয়্যারলেস অফিস থেকে ইংরেজিতে ওই ওয়্যারলেস মেসেজ পান।' বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার এই ওয়্যারলেস মেসেজটি ছিল :
‘This may be my last mesasge, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of cocupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. Sheikh Mujibur Rahman.’ সে রাতে নন্দনকানন ওয়্যারলেস অফিসে আমি ডিউটিরত ছিলাম। আমাকে তিনি ভোরে মেসেজটি দেন ও বলেন, চট্টগ্রাম টিঅ্যান্ডটির স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের মহাসচিব হিসেবে সারা বাংলাদেশের ডিস্ট্রিক্ট ওয়্যারলেস অফিসগুলোয় আমি যেন মেসেজটি দ্রুত দিয়ে দিই।"
ঢাকার ইপিআর সিগন্যাল কোরের সুবেদার মেজর বীর শহীদ শওকত আলী দুঃসাহসিকভাবে ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় পিলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের Proclamation of Independence প্রেরণ করেন।
ঢাকার মগবাজারের টিঅ্যান্ডটিতে কর্মরত মহান দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ভাইদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এক রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচারের দ্বিতীয় আরেকটি কার্যক্রম নিশ্চিত করে রেখেছিলেন। তাঁরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনুগত ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক ও শেষ বর্ষের একজন বিশ্বস্ত ছাত্র। তাঁদের মাধ্যমে তিনি বলধা গার্ডেনে সবার অজান্তে অতি সঙ্গোপনে ২৩ মার্চ রাতে একটি Low frequency radio transmitter স্থাপন করে রেখেছিলেন। তাঁর দলের একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ ব্যতীত সম্পূর্ণ গোপন এই পদক্ষেপ আর সবার অজানা ছিল। পিএসসির সাবেক পরিচালক তবিবুর রহমানকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪ তারিখে জিজ্ঞেস করলাম সেই ২৬ মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুর ৩২নং বাসার ঘটনা। তবিবুর রহমান বললেন, 'আমাদের শত অনুনয়, বিনয়, অশ্রুজল বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি।' বঙ্গবন্ধু হিমালয়ের মতো দৃঢ় স্বরে বললেন, 'আমার ভয় কী? আমি স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছি। তোমরা যুদ্ধে নেমে পড়ো। বাঙালি জাতি আজ থেকে স্বাধীন হয়ে গেছে। বাঙালি জাতির শৃঙ্খল টুঁটে গেছে, আমার স্বপ্নসাধ পূরণ হয়ে গেছে। মৃত্যুকে আমার আর ভয় নেই।'