ইশ্বরে তাদের অগাধ আস্থা। আমাদের সেনাবাহিনী ক্রমশ একটা ধর্মবাদী যোদ্ধা সংগঠন হয়ে উঠছে। কিংবা তাদের ক্ষমতার চর্চার নিরাপদ পদ্ধতি হলো মানুষের ধর্মীয় অনুভুতিকে কোমল পরিচর্যা। তাই আমাদের সেনাপ্রধানেরা ক্ষমতার কাছাকাছি আসলেই মসজিদের চত্তরে গিয়ে মৃদু হেসে বসেন।
মসজিদ হয়তো ক্ষমতা চর্চার কেন্দ্র হতে পারে, আমাদের সেনাপ্রধানদের সাথে ধর্মব্যবসায়ীদের দহরম-মহরমের প্রথা পুরোনো। সবাই এই জোব্বা সংস্কৃতিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বর্তমানের ছায়াসরকারের প্রধান মইন উ আহমেদও এটার বাইরে যেতে পারেন নি। তিনি মানুষের ধর্মীয় অনুভুতির তারে আঙ্গুল রেখে বাজাতে চাইছেন। বগুড়ায় তার চাষী বাজার উদ্বোধনের বক্তব্যে এটার প্রমাণ ছিলো।
তবে গত কাল জুম্মার পর পর যা হলো সরকারি নির্দেশে সেটাকে কি বলা যাবে। সরকার আসন্ন বোরো মৌসুমে নিরাপদ ফসলের কামনায় বিশেষ মোনাজাট পরিচালনা করেছে। এ মর্মে সরকারি নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছে সরকারের কোন অধিদপ্তর? এটা কি কোনো সামরিক সিদ্ধান্ত- মানে জলপাই কোনো উর্দিধারীর পবিত্র মস্তক থেকে নির্গত সিদ্ধান্ত এটা? না কি আমাদের সচিবালয়ের বিশিষ্ট আলেমদের প্ররোচনা।
বস্তুত ইশ্বরের অনুগ্রহের চেয়ে আমাদের আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়াটা ভালো হতো। বিশেষত যখন আমরা জানি তাপমাত্রা এবং চাপমানের তারতম্য এবং এ জনিত প্রতিক্রিয়ায় আমাদের কালবৈশাখী হয়, আমাদের অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি, টর্নেডো আর সাইক্লোন- সবই আসলে প্রাকৃতিক কারণেই ঘটে। এখানে ইশ্বরের মন্দ অভিপ্রায়-ক্ষোভ কিংবা বিরাগের অনুভুতির প্রকাশ নেই। ইশ্বর কুপিত হয়েছেন এমন সিদ্ধান্ত টেনে তাকে তুষ্ট করবার প্রক্রিয়াটাকে আদিবাসি সংস্কার বলা চলে বড়জোর। এর বেশী কিছু বলা যাচ্ছে না এই আচরণকে।
নারীরা একটা সময়ে বিশেষ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলো, তারাই কৃষিজমিতে বীজ বপন করতো, কুমারি মেয়েরা নেচে গেয়ে পৃথিবীর মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতো- এমন কি মদীনায় দেশি ইশতারের ক্ষমতা ছিলো প্রবল। এই যে কুমারী নারীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব, ফসলের লোভে কুমারীর যোনীর রক্ত জমিতে প্রদান, এই সব কুসংস্কারের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায় নি। এমন কি কলের লাঙল দিয়ে চাষ করলে অধিক ফসল ফলে, জেনেটিক্যালি মডিফাইড বীজ ফসলের উৎপাদন বাড়ায়- ইশ্বরের অনুগ্রহ লাভের নানাবিধ তরিকা অবলম্বন না করেও অনেক দেশেই চালের উৎপাদন বেড়েছে।
আমাদের ইশ্বরবিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী কৃষি গবেষকেরা এমন ধানের গাছ উদ্ভাবন করেছেন যারা পানির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে- বন্যায় তাদের কোনো ক্ষতি হয় না।
এইসব বৈজ্ঞানিক প্রথাগত গবেষণার ফসল। কোনো অলৌকিকত্ব নেই এখানে।
তবে সরকার এমন একটা ইঙ্গিত দিলো এই আচরণে যে সব কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে এখন. অতিলৌকিক কোনো ঘটনাই আমাদের উদ্ধার হতে পারে।
নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রচারে নতুন মাত্রা যোগ করছে নিয়মিতই স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। ইসলামি টিভি আগমনের পরে এই নতুন উন্মাদনার সাথে পাল্লা দিতে ইসলামী অনুষ্ঠানের সময় বাড়ানো হয়েছে-
এমনই এক অনুষ্ঠানে আমার প্রাক্তন শিক্ষক শমসের আলী বলেছেন পহেলা বৈশাখ আসলে একটা ব্যঙ্গ- দরিদ্র মানুষের দারিদ্র নিয়ে ব্যঙ্গ- আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যে এটা নেই- সেখানে মানুষ প্রতিদিন পান্তা খায়, বছরে একদিন পান্তা খেয়ে আমরা বাঙ্গালী হয়ে যাবো না। তার এই কথার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। একদিন ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে আমরা বাঙ্গালি হয়ে যাবো না। আমাদের এই শেকড়ে ফেরবার টানটাকে অপমান করলো যে বক্তব্য সেটাকে মানতে আপত্তি আছে আমার।
মানুষ সংস্কৃতি নির্মাণ করে। সাংস্কৃতিক উৎসবে নিত্যনতুনত্ব- অভিনবত্ব আনবার প্রয়াসটা নিন্দনীয় নয় মোটেও।
এই একটা আনন্দ উৎসবে সবাই নিজের সংস্কৃতিকে স্মরণ করছে এটাতে দোষের কি আছে।
হালখাতার মতো পূঁজিবাদী কিংবা সামন্ততান্ত্রিক উৎসব তার কাছে ঐতিহ্যসংলগ্ন মনে হয়। শমসের আলীর ভাবনার জগতে প্রবেশ করবো কি না এটা নিয়ে ভাববার অবকাশ আসলে ভাববো। তবে এই একটা মানুষ বাজারের মলম বিক্রেতার মতো খুবই আকর্ষনীয় বাচনিক যোগ্যতার অধিকারি, এটা মেনে নিতেই হবে। তাই তিনি যখন বললেন-হালখাতার ভেতরে একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠে মহাজন আর খাতকের ভেতরে- মানুষের দেনা- পাওনার হিসাব নতুন বছরের খাতায় তুলে রাখা, মানুষের দারিদ্রের চিহ্ন তুলে রাখা ভালো অনুষ্ঠান- এটা ঋণদাতা এবং ঋণগ্রহীতার ভেতরে আত্মার বন্ধন তৈরি করে সেটা মানতেই হবে।
তুমি গত বছর আমার কাছে ৫০০ টাকা ঋণী ছিলে, এ বছর শুধেছো ২০০- হাল নাগাদ করে নতুন বছরের খাতায় তোমার নামে ৩০০ টাকা লিপিবদ্ধ হলো। এ বছরের খন্দের জন্য কত লাগবে- আসো মিস্টিমুখ করো- দুপুরে খেয়ে যাও।
এই পদ্ধতিতে অনেক সুবিধা আছে। এটা প্রতিষ্ঠানিক প্রয়োজন, বছরের প্রথম দিনেই নিজের অশোধিত ঋণের অঙ্ক জেনে নেওয়া ভালো।
তবে প্রতিদিন আমাদের কৃষকেরা পান্তা ভাত খায়- এই সহজ তথ্য বলে দিয়ে আমাকে রীতিমতো বিষন্ন করে ফেললেন শমসের আলী। চাষীরা পান্তা খাওয়ার সুযোগ পায়? মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে গেছে, এখন সকালে মুড়ি- গুড়- আটার রুটি গুড়, চিড়া কোঁচরে বেধে যাওয়া কৃষকেরা সবাই পান্তাজীবি হয়ে গেছে।
বিজ্ঞ মানুষেরা যাহাই বলেন সেটাই সঠিক।
এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শহুরে মানুষের নির্মমতার দলিল তুলে ধরে শমসের আলী আমাকেও ঋণী করে ফেললেন। যদি সুযোগ পাই এ বছর হালখাতায় এই ঋণের কথা তুলে আসবো আমি।
অন্য এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কথা শুনে আরও ভালো লাগলো। তিনি হাসানুজ্জামান। আমার প্রিয় এক ছোটো ভাই জগন্নাথ হল থেকে ফোন করে জানালো সেখানে বিক্ষোভ মিছিল চলছে এখন। তারা হাসানুজ্জামনের পদত্যাগ দাবি করছে-
হাসানুজ্জামান একজন দ্বীনে ইসলামের সেবক। তিনি পড়ান রাজনৈতিক সংস্কৃতি- প্রাচ্যের রাজনৈতিক দর্শণ -প্রথম আলোর আজকের শেষ পাতায় তার কীর্তি বর্নিত হয়েছে-
মানুষের ধর্মপালনের স্বাধীনতা- ধর্ম বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা এবং ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতার ভেতরে কোনটাকে নিয়ন্ত্রন করা উচিত - এই প্রশ্নের উত্তরে আমার বক্তব্য হবে। মানুষের অতিরিক্ত ধর্ম পরিচয়কে নিজের ঢাল করে তোলার প্রক্রিয়াটাকে নিষিদ্ধ করা উচিত। মানুষের ধর্ম প্রচারের বাতিক, এবং ধর্মীয় বিধি চাপিয়ে দেওয়ার বাতিককে নিয়ন্ত্রন করা উচিত।
হাসানুজ্জামামনের নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই- তার যা ইচ্ছা তিনি বিশ্বাস করতে পারেন। তার যদি মনে হয় মেয়েদের ঢেকে আব্রু মেনে পোশাক পড়া উচিত- সেটা তার নিজস্ব বিশ্বাসের স্বাধীনতা- এখানে আমি কোনো খবরদারির পক্ষপাতি নই- কিন্তু ক্লাশরুমে যখন তিনি শিক্ষক তখন পাঠ্যসূচিকে সম্মান করা তার পেশাগত দায়িত্ব। পেশাগত দায়িত্ব পালনে অনীহা কিংবা ছাত্রদের জিম্মি করে তাদের মনের বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্য করাটা রীতিমতো অন্যায়।
তিনি ক্লাশে ধর্ম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। অনুশোচনাবিহীন ভাবে বলছেন চাইলে বিধর্মীরা তার ক্লাশ নাও করতে পারে- তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সকল ছাত্রকে ধর্মীয় পরিচয়ে চিহ্নিত করছেন। তিনি বলেই দিচ্ছেন- ক্লাশে ঢুকবার প্রথম এবং অন্যতম যোগ্যতা তার ধর্ম পরিচয়। এই যে ধর্মবোধকে সামনে নিয়ে আসা -এটা শিক্ষক হিসেবে তার নির্দিষ্ট দায়িত্বের প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের পর্যায়ে পরবে কি না?
বাংলাদেশের দন্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় যে ফৌজদারি অপরাধ তিনি করলেন সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সংবাদের বিস্তারিত এখানে
Click This Link
তবে এটাতে আমার শুধুমাত্র বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিবর্তন নজরে আসলো। আমরা পুনরায় ধর্মীয় বিদ্বেষের নোংরা পথে চলাচল শুরু করেছি। আমাদের সাংস্কৃতিক নির্মাণের জায়গাটাতে এখন শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠছে। এই আত্মবিধ্বংসী পথ থেকে আমরা ফিরে আসবো কবে? আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এই প্রথার চর্চা চলছে এবং সাম্প্রতিক সময়ের খবরের কাগজে এবং আমাদের সরকারের বিভিন্ন আচরণ এবং উক্তিতেও এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আমরা সবাই দাড়ি- টুপির জঙ্গলে পথ হারাচ্ছি।