আমাদের দেশে দিন দিন অনলাইনে কেনাকাটা এর প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়ছে। দেশে ই-কমার্স বিজনেস জনপ্রিয় হয়ে ওঠার এটাই প্রধান কারণ। ক্রেতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিক্রেতার সংখ্যা। কিন্তু আমরা যারা মনের সুখে ঘরে বসে পন্য অর্ডার দিচ্ছি, হোম ডেলিভারি নিচ্ছি – তারা কি জানি যে এই ক্ষেত্রে কতটা ঝুঁকি বিদ্যমান? অনলাইনে কেনাকাটা করার সময় সামান্য একটা ভুল সিদ্ধান্তে অনেক ক্ষতি হতে পারে আপনার।
বাইরের ই-কমার্স ওয়েবসাইট থেকে কেনাকাটা করতে গেলে, পুরো প্রসেসটাই হয়ে থাকে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এখানে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে লেনেদেন করতে হয় বলে নিরাপত্তার দিকটি মাথায় রাখতে হয়। আর দেশিয় সাইট গুলির ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত বিকাশ কিংবা ডাচ-বাংলার মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেম ব্যবহার করে পেমেন্ট করে থাকি। কিন্তু এই সব ক্ষেত্রে সামান্য কিছু ভুলের জন্য হয়ে যেতে পারে অনেক বড় ক্ষতি। তাই সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই। নিরাপদে এ ধরনের লেনদেন করার কিছু টিপস থাকছে আমার আজকের আয়োজনেঃ
নিরাপদ ইন্টারনেট কানেকশন ব্যবহার করুন
অর্থনৈতিক যে কোনো কাজ যেমন ব্যাংকিং বা কেনাকাটার জন্য প্রাইভেট ওয়াই-ফাই বা ইন্টারনেট কানেকশন ব্যবহার করুন। ফ্রি ওয়াই-ফাই নেট ব্যবহার করলে এ ধরণের আর্থিক লেনদেন না করাই ভাল। অনেক সময় ওয়াই-ফাই নেটের মাধ্যমে কানেক্টেড ডিভাইসের ব্রাউজিং মনিটর করা হয়। সেক্ষেত্রে আপনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অন্যের হাতে চলে যেতে পারে।
কোন সাইটে মোবাইলে সব সময় লগ ইন হয়ে থাকবেন না
আমরা অনেক সময় বিভিন্ন সাইটে মোবাইল দিয়ে ভিজিট করি। কিন্তু মোবাইলটা আমার নিজের হাতে থাকে বলে সাধারণত লগ আউট না করে বেরিয়ে যাই। কিন্তু এটা ঠিক নয়! আপনি যদি মোবাইল দিয়ে অনলাইন কেনাকাটা করেন তাহলে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। লগ আউট করতে না চাইলে মোবাইল অবশ্যই লক স্ক্রিন পাসওয়ার্ড ও অন্যান্য সতর্কতা বজায় রাখুন। যদি কোনো কারণে আপনার মোবাইল চুরি হয় তাহলে পুরো ব্যাংক ব্যালেন্স চোরের হাতে দিয়ে দিলেন।
ই-কমার্স সাইট নিরাপদ কিনা যাচাই করুন
URL দেখেই সাইটটি বিশ্বস্ত কিনা তা জানা যায়। যদি সেখানে “https” থাকে তাহলে চোখ বন্ধ করে ধরে নিন এটা নিরাপদ সাইট। অন্যদিকে শুধু “http” থাকলে এই সাইট নিরাপদ কিনা তা URL দেখে বোঝা যাবে না।
অনলাইনে কেনাকাটা করুন শুধুমাত্র বিশ্বস্ত সাইট থেকে
দেশে এখন অনেক ধরণের কেনাকাটার সাইট তৈরি হয়েছে। সবগুলো যে বিশ্বস্ত তা বলা যায় না। আপনি বাগডুম, দারাজ কিংবা বাংলাদেশের প্রথম সারির ১০টা ইকমার্স সাইট থেকে পন্য ক্রয় করতে পারবেন স্বাচ্ছন্দ্যে। অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় সাইট গুলি থেকে পন্য কেনার সময় খুব সাবধান হউন। ভাল ভাবে যাচাই করে নিন। তবে নতুন মানেই খারাপ নয়! আমি নতুন হওয়া বাংলাদেশি টপ অল ব্র্যান্ড নামের একটা সাইট থেকে পন্য কিনে অনেক বিখ্যাত ই-কমার্স সাইটের চেয়ে ভাল সার্ভিস পেয়েছি। তবে নতুন কোন ইকমার্স ওয়েবসাইট থেকে পন্য কেনার আগে ভাল ভাবে যাচাই করে দেখে নিনঃ
- তাদের ওয়েবসাইট পরিপূর্ণ কি না
- সোশ্যাল মিডিয়া পেইজে লাইক এবং ইউজারদের রিভিউ আছে কি না
- থার্ড পার্টি ওয়েবসাইট কিংবা নিউজ পোর্টালগুলোতে তাদের নিয়ে নিউজ ছাপা হচ্ছে কি না
- তাদের নির্দিষ্ট অফিস এড্রেস আছে কি না
- তারা বড় আঁকারে বিজনেস সেটআপ করে নিয়েছে কি না
এইসব দেখে পজিটিভ মনে হলে পন্য কিনতে পারেন।
ফেসবুক শপ থেকে পন্য কেনার সময় ১ লাখের বেশি লাইক আছে এমন পেইজ খুঁজে নিন। নতুন তৈরি হওয়া পেইজ থেকে কেনাকাটা নিরাপদ নাও হতে পারে। সাধারণত অনলাইনে কেনাকাটা করার সময় আমাদের অগ্রিম পে করতে হয়। কোন অসাধু ব্যবসায়ি হয়ে থাকলে, আপনার টাকা বুঝে নিয়ে পন্য নাও দিতে পারে।
তাছাড়া আপনি কোন পন্য কেনার সময় ঠিকানা, ফোন নম্বর সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সাইটকে দিতে হয়। তাই বিশ্বস্ত সাইট না হলে, তারা এইসমস্ত তথ্য থার্ড পার্টির কাছে বিক্রি কিংবা বাজে কাজে ব্যবহার করতে পারে। কোন ধরণের বোকামি করবেন না!
একাউন্ট করার সময় শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন
আপনি যে ওয়েবসাইট থেকেই কেনাকাটা করেন না কেন, সেখানে আপনার প্রথমে একটা একাউন্ট করতে হয়। এই একাউন্টটি করার সময় অবশ্যই শক্তিশালি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। অনলাইনে নিরাপদ থাকতে শক্তিশালী পাসওয়ার্ডের বিকল্প নেই। আমাদের অনেকের মধ্যে এক্তা টেন্ডেন্সি দেখা যায়- আমরা পাসওয়ার্ড হিসেবে জন্মদিন, মোবাইল নম্বর, নিজের নাম বা ১২৩৪৫ টাইপ করে সহজ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি। এটা খুব বেশি রিস্কি। এর কারণ হচ্ছে যে, এই ধরণের পাসওয়ার্ড গেস করা অনেক বেশি সহজ। তাই নিরাপদ থাকতে চাইলে আপনাকে অনেক কঠিন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে।
কোন প্রকার পপ আপ বিজ্ঞাপনে ক্লিক করবেন না
এটা একটা অবশ্য পালনীয় রুলস। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ভিজিট করার সময় মাঝে মাঝে বিভিন্ন পপ আপ বা পপ আন্ডার বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে। এ বিজ্ঞাপনগুলোতে ক্লিক করলে হয়ে যেতে পারে অনেক বড় সর্বনাশ। অনেক ধরণের পপ আপ বিজ্ঞাপন আছে যেখানে ক্লিক করলে আপনার সমস্ত ইনফরমেশন পেয়ে যাবে থার্ড পার্টি। ধরুন আপনি কোন পেমেন্ট করার সময় আপনার ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের ডিটেইলস দিয়েছেন। এ অবস্থায় একটা পপ আপ এড আপনার সমস্ত ইনফরমেশন আপনার অজান্তে কপি করে নিতে পারে। পরে সেটা ব্যবহার করে তারা আপনার ক্রেডিট কার্ড ইউজ করে পেমেন্ট করে দিতে পারে। তাই এগুলোতে ক্লিক করার আগে একটু সাবধান থাকবে হবে। ব্রাউজারে ad blocker ব্যবহার করলে এ সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যাবে।
ইমেইল বিজ্ঞাপন থেকে দূরে থাকুন
ইমেইল বিজ্ঞাপন এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই ক্ষেত্রে অনেক ধরনের স্পামিং শুরু হয়েছে। আপনারা হয়ত দেখে থাকবেন যে ই-মেইলে অনেক ধরনের বিজ্ঞাপনের মেইল আসে। অনেক লোভনীয় অফার বা ফ্রি পন্য দেওয়ার নিউজ দেয়। কিন্তু এই গুলা বেশির ভাগ ভুয়া হয়ে থাকে। তবে এমনও হতে পারে যে সেটা অতি পরিচিত এবং বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট। কিন্তু আপনি সরাসরি সেই বিজ্ঞাপন লিঙ্ক থেকে কিনবেন না। এই সব লিংক বেশির ভাগই অনিরাপদ হয়ার সম্ভাবনা আছে। আপনি দরকার হলে সেই ওয়েবসাইট আলাদা করে এড্রেস টাইপ করে প্রবেশ করুন। তাহলে ফিশিং থেকে নিরাপদ থাকতে পারবেন।
ডেবিট কার্ড নয়! কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করুন
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে কিছু নিয়মকানুন থাকে। তাই চাইলেই যে কেউ ব্যবহার করতে পারে না। অন্য দিকে ডেবিট কার্ড দিয়ে অনেক সহজেই অনলাইনে কেনাকাটা করা যায়। পাসওয়ার্ড জানা থাকলে যে কেউ এ দুর্বলতা কাজে লাগাতে পারে।
লোকেশন ট্রেস এবং প্রাইভেসি সেটিংস ঠিক করুন
স্মার্টফোনের এই যুগে এখন অনেক অ্যাপস রয়েছে যেগুলো অটোমেটিক GPS লোকেশন ট্যাক করে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা প্রকাশ্যে শেয়ার করে দেয়। ধরুণ আপনার পুরো পরিবার বাইরে বেড়াতে গিয়েছেন। এখন সেই স্থান সবাইকে জানানো নিশ্চয়ই ভাল কথা না। তাই প্রাইভেসি সেটিংস ব্যবহারে সতর্ক থাকুন।
সব সফটওয়্যার আপ টু ডেট রাখুন
প্রতিনিয়ত আপনার ব্যবহার করা বিভিন্ন সফটওয়্যারের নতুন নতুন আপডেট রিলিজ করা হয়। হতে পারে সেটা অ্যান্টি ভাইরাস বা ফায়ার ওয়াল। এমনকি সেটা সেটা সাধারণ সফটওয়্যারও হতে পারে। সকল ক্ষেত্রে সফটওয়্যার আপডেটেড রাখা জরুরী। তাহলে অনেক সিকিউরিটি হোল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
পিসিতে শক্তিশালী অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করুন
আমরা অনেকেই ইদানিং অ্যান্টি ভাইরাস ব্যবহার করতে চাই না। আপনি কোন কোন সাইট ভিজিট করছেন তা নিশ্চয়ই কাউকে জানাতে চান না? অথচ এটা ট্র্যাক করা সম্ভব। ফলে অনেক অনাকাংখিত ঘটনার জন্ম হতে পারে। তাই নিরাপদ থাকতে অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করুন। পারলে কিনে ব্যবহার করুন।
নিরাপদ ব্রাউজার ব্যবহার করুন
অনলাইনে নিরাপদ থাকতে শক্তিশালী ব্রাউজের বিকল্প নেই। অনেকে এখনও ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্যবহার করে থাকে। অথচ এ ব্রাউজারে প্রচুর সিকিউরিটি হোল রয়েছে। তাই মজিলা বা গুগল ক্রোম ব্রাউজারের সাথে ভালো এড অন্সও ব্যবহার করুন।
এছাড়াও আরও অনেক ধরণের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। আজকের মত এ পর্যন্তই, আগামী কোন পোস্টে অনলাইনে কেনাকাটার অন্যান্য দিক গুলো নিয়ে আলোচনা করব। পোষ্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪৭