২৩টা ২০, ৩১/৩/২০১৬
(পড়লে পুরোটা পড়ার অনুরোধ হইলো। ধন্যবাদ) আমার ফেসবুক নোট থেকে এখানে অনুলিপি দিলাম।
ক্লাস থ্রী । জামাল্পুর জিলা স্কুল। ২০০০ সালের জানুয়ারির কোন এক দিন। ক্লাস টিচার আজাহার স্যার সেকন্ড বয় এর জন্য ক্লাসের বাম কলামের ১ম সারির সর্ব ডানে একটা জায়গা ফিক্সড করে দিলেন। সেদিনই ৯৮ জন ছাত্রের মধ্যে সনাক্ত করতে পারলাম, ওর নাম মুহাইমিনুল ইসলাম সিয়াম।
আমার আম্মুর সাথে তার আম্মুর চাকরী সুবাদে বেশ ভালো পরিচয়। যতদূর মনে পড়ে, জিলা স্কুলে এডমিশন দেবার সময় একটা প্রশ্ন ছিল, "ইংরেজি ১২ মাসের নাম লিখ" । আমি জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি … এই ফরম্যাটেই লিখছিলাম। কারণ, প্রবেশ পত্রে লিখা ছিল যে, প্রশ্নপত্রে শুধু বাংলা এবং গণিত থাকবে। সিয়ামের আম্মুর সাথে এডমিশন টেস্ট এর পর কথোপকথনে আমার আম্মুর কথা হয়েছিল এই বিষয়ে। সিয়াম সেটা ইংলিশেই উত্তর করে আসছিল। মানে, january, february... এই ফরম্যাটে। সেটা নিয়ে আন্টি একটু আপসেট ছিলেন। কিন্তু দেখা যায়, তার ছেলে এডমিশন টেস্ট এ সেকন্ড হইছে!!
স্কুলে তখন স্টার টাইপের ছাত্র ছিলাম না। আমার ভর্তি রোল ছিল ১২। সিয়ামের সাথে রিমন,দীপন,মীম,বাঁধন এদের মারাত্নক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সিয়ামের মা'র সাথে আমার আমার মা'র ছিল দহরম মহরম সম্পর্ক। সম্ভবত প্রথম সাময়িক এক্সামের সময়, আন্টি একবার আম্মুকে বলেছিলেন, "আপা, আপনার আর আমার ছেলেটাই মনে হয় ইঁদুরের গর্ত থেকে উঠে আসছে। বাকি পোলাপানগুলা কত ফিটফাট। " কথাটা মনে থাকার কারণ, আম্মু অনেক বারই আমাকে এইটা বলছে। এমনকি শেষ বারের সময়ও বিলাপ করে কাঁদছে এটা মনে করেও। যাই হোক, দেখতে আমি ওর মতো লম্বা না হলেও ওর মতোই nigga ছিলাম ।
ক্লাস থ্রী এর ই কোন একদিনের ঘটনা। আমাদের গণিত বইয়ের পিছনে একটা ছবি ছিল।
নিচের চিত্রে কয়টি ত্রিভুজ?
https://scontent-sin1-1.xx.fbcdn.net/hphotos-xtp1/v/t1.0-9/12495103_10207726809346296_7380189977933590403_n.jpg?oh=78dffff1b1f92f638cf212042492d62b&oe=57ABA09A
দুঃখজনক হলেও সত্য, এ লিখা এই মুহুর্তে যারা পড়তেছে, তাদেরও গুটিকয়েক ভুল করে বসবে। উত্তর দিবে, চারটি।
সিয়ামই আমাকে ক্লাস থ্রিতে দেখিয়েছিল, বুঝিয়েছিল, এখানে আটটা ত্রিভুজ আছে। ছেলেটার সেন্স তখন থেকে যতদিন তার সাথে ক্লাস করছি, ততদিন আমাকে বিস্ময়াতিভূত করেছে!!
ক্লাস থ্রী থেকে ফোর কিংবা ফাইভ পর্যন্ত সে একটা সোয়েটার পড়ে আসতো শীতের সময়। সোয়েটারে লিখা ছিল SNOOPY. what is the meaning of snoopy?? I asked him very often and also got cold reply. He didn't give a fuck on his dress and so obviously there is no question regarding the word or statement written on it.
ক্লাস ফোরে উঠার পর পর তার সখ্যতা বাড়তে থাকে নিশাদ,ফুয়াদ, ওয়াকার সাকিফদের সাথে। সে সময়ে বরফ পানি থেকে শুরু করে চোর পুলিশ, কলম ক্রিকেট, ক্লাস রুমে কাগজ বা বোতল দিয়ে বানানো ফুটবল সহ কত কিছুই না আমরা খেলেছি। নিশাদ, ফুয়াদ, সাকিফ , ইসতিয়াক আনসারি এদের সবারই ছিল গল্পের বই পড়ার প্রচন্ড নেশা। তিন গোয়েন্দা কিংবা মাসুদ রানার বই এদের ব্যাগে এমন কোন দিন নাই যে তিন চারটা থাকতো না। বই পড়ার প্রতি প্রচন্ড নেশা ছিল ছেলেটার। স্কুলে সে তখন থেকেই "বিজ্ঞানী" ছদ্মনামে পরিচিত ছিল।
ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠার সময় তৌফিক আর সিয়াম যুগ্ন ভাবে পঞ্চম হয়। আমি ষষ্ঠ হয়েছিলাম। আমার মনে একটা অদ্ভুত আনন্দ থাকতো তখন এই ভেবে যে, স্যার এখন রোল কল করার সময় বলবে,
"রোল ৫ক , রোল ৫খ" । কিন্তু না। দু'জন পঞ্চম হবার জন্য এবং আগের রেজাল্ট গুলা তৌফিক এর ভালো থাকার জন্য সিয়ামের রোল ৬ হয়। এবং আমার থেকে শুরু করে বাকি সবার রোল ১ করে পিছিয়ে যায়। -_- ভালো কথা, অন্তর, পড়েছছ? তোর অর্নব ভাইরে বলিস, পেন্সিল বক্স এ করে নকল এনে ধরাটা উনারে সিয়ামই খাওয়াইছিল। -_- আমরা যে কোন এক্সাম এক বেঞ্চে তিন জন তিনটা ভিন্ন ক্লাসের ছেলে বসে দিতাম।
ক্লাস ফাইভে ও একটা পিকুলিয়ার টাইপের টিচারের কাছে পড়তো। যতদূর মনে পরে লোকটা "সত্যপীর" নামের একটা স্কুলের হেড টিচার ছিলেন। পড়াতেন মারাত্নক। সিয়ামের তখনকার যে কোন বিষয়ে কনসেপ্ট চমৎকার ছিল। টিচারটার কাছে আমারো পড়ার কথা ছিল। কিন্তু উনি রাজি হন নি। অন্য কাউকে পড়ানোর। সিয়াম এমন এক জন ছেলে ছিল, সে নিজে টিচারকে বলছিল যে, আমি যদি সিয়ামদের বাসায় এসে পড়ি, তাহলে কি স্যার পড়াবে নাকি। ও ক্লাসে এটা বলছিল পরে আমাকে। ওর চরিত্রের একটা বড় গুণ হলো, কেউ বলতে পারবে না যে সিয়াম কাউকে কোন কারণে মিথ্যা কথা বলছে। Oh, my merciful Creator, You have taught us "telling lie is a great sin". Won't You give him Jannah as a gift?? :'(
ক্লাস ফাইভের বৃত্তি এক্সামে সিয়াম লেটার লিখতে গিয়ে একটা গন্ডগোল পাকাইছিল। এটার জন্য তার দুঃখের কমতি ছিল না। পরবরতীতে ও যখন বৃত্তি পেয়ে গেল, ওর সাথে আমিও অবাক হইছিলাম এই ভেবে যে, এত হাড্ডাহাড্ডি কম্পিটীশনেও ১০ নাম্বার ভুল করে কিভাবে এই ছেলে বৃত্তি পায়! তাহলে বাকি সব কিছু কতই না নির্ভুল ভাবে আন্সার করেছিল।
ক্লাস ফাইভের বৃত্তি এক্সাম শেষে আমি আর সোহেল আর আমার এলাকার এক দুই জন পোলাপান আমাদের বাসার ভিতরেই ক্রিকেট খেলছিলাম। তখন সামনে মোটামুটি ভালই জায়গা ছিল। আমাদের টীন শেডের বাসা ছিল। হঠাৎ বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো গেটে নক করলো কে যেন। খুলে দেখি, আম্মু আসছে। সাথে সিয়ামকে ওদের দোকান থেকে ধরে নিয়ে আসছে। বলা যায়, সেদিন থেকে সে আমার ক্লোজ ফ্রেন্ডদের এক জন হয়ে গেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সে আমাকে বলতেছিল, "দোস্ত, দুপুরেই চলে যাবো। সিনেমা দেখবো। কাভি খুশি, কাভি গাম" । আমি বোকার বোকা তো আর এই সিনেমা চিনি না। হা করে শুনছিলাম খালি। আর ভাবছিলাম, কি এমন এই সিনেমা যে খেলার চেয়ে বেশি প্রিফারেন্স ওয়ালা? দেখতে চাই। কিন্তু অদ্যাবধি দেখা হয় নি আমার আর।
ক্লাস ফাইভের ফাইনালের রেজাল্ট দিল। সিয়াম থার্ড, আমি ফিফথ। সংগত কারণে, ক্লাস সিক্স এ সেকশনে ওর রোল ২, আমার ৩। সিক্স বি তে নিয়নের রোল ৩ ছিল। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক গভীরতর হলো। নাম বলতে চাই না, গীবতও করতে চাই না। তখন কয়েকজন ছিল খাচ্চড় টাইপ । মুডি টাইপ। কিন্তু আমরা? এমন কোন সাময়িক এক্সাম দেই নাই যে, আমাদের খাতা স্যারেরা নিয়ে না নিছে। এক জন আরেকজনকে অতিরিক্ত উত্তর পত্র থেকে শুরু করে মেইন উত্তর পত্র দিতেও কোন কার্পণ্য কিংবা ভয় পেতাম না। ক্লাস সিক্সে মনোয়ার ইমন মর্নিং শিফট চ্যাঞ্জ করে ডে শিফট এ আসে। তার লক্ষ্য ছিল দুইটাঃ
১। ক্যামনে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ক্যাডেট কোচিং করা যাবে
২। ক্যামনে কাদির স্যাররে ট্যাকা পয়সা দিয়ে আরবিতে পাশ করা যাবে
আমি, সিয়াম, ইমন, ইস্তিকার মাহমুদ, নিশাদ, ফুয়াদ -- আমরা এই কয়জন ক্লাস সিক্সে থার্ড কলামে অবস্থিত দুইটা ছোট ছোট বেঞ্চে বসতাম। অবশ্য এর একটা অন্যতম কারণ, সে সময়ের হার্ট থ্রবঃ বিপু ম্যাডাম। পোলাপান স্কুল পলানোতে তখন থেকে বেশ দক্ষ হয়ে উঠে। মনোয়ার ইমন নিজে পালাইতো। আর পালানোতে উৎসাহী করতো ছেলেপেলেদের। পরে লাইন ধরে মাইরো খাইতো। -_-
আমরা বোক ক্লাস ক্যাপ্টেনরা চেয়ে চেয়ে দেখতাম। কিন্তু এর স্বাদ নিতে পারতাম না। মোয়াজ্জেম স্যার ছিলেন তখন আমাদের ক্লাস টিচার। উনি সিয়ামকে মারাত্নক পছন্দ করতেন। ক্লাস সিক্সের জুলাই মাসের ২৬ তারিখে আমাদের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষ হয়। I repeat 26 তারিখ। সিয়াম আমাদের বাসায় আসছিল এক্সাম শেষে। আমরা পাশের বাসার এক এলাকার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে একটা সিডি প্লেয়ারে জুরাসিক পার্ক সিনেমা দেখছিলাম। ওকে বাসায় আনার পিছনে কারণ ছিল একটাই। আম্মুকে বলবে, আমাকে যেন আম্মু এই পরিক্ষার পর সাইকেলটা কিনে দেয়। তখন আমার ধ্যানে জ্ঞ্যানে সাইকেল ঢুকে গেছিল। স্বপ্নেও দেখতাম, আমি একটা সাইকেল কিনে ফেলছি। ইমন, নিয়ন, কিংবা মর্নিং শিফট এর শিশিরের মতো আমিও একটা গিয়ার ওয়ালা সাইকেল কিনার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। অবশ্য আম্মু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন যে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি মানেই সাইকেল কেনা। স্পষ্ট মনে আছে, আমার এক চাচি তখন অসুস্থ। বাসায় আসছে চিকিৎসার জন্য ।এদিকে সিয়ামকে আনছি আমার ওকালতি করার জন্য। আব্বু সিয়ামের সামনেই আমাকে ঝাড়ি দিয়েছিল। ব্যাপারটার জন্য অনেকদিন লজ্জিত হইছি নিজের কাছে। ওর সামনে ঝাড়িটা না দিলেও হয়তো পারতো! বেচারাও তো কষ্ট পাইলো!
যাই হোক, সাইকেল আমি তার পরেরদিনই কিনে ফেলি। সিয়াম সাইকেল চালাইতে পারতো না। আমার পিছনে ওকে অনেক বার তুলছি । অনেকবার আমি বোষ পাড়ার প্রবেশ পথ লম্বাগাছের সামনে নামিয়ে দিছি। অথবা পাচ রাস্তা দিয়ে আসলে আজাদ ডাক্তারের বাসার সামনে নামিয়ে দিছি। আমি লম্বায় অনেক পিচ্চি ছিলাম। শুকনাও ছিলাম। আমার পিছনে ও উঠতে চাইতো না। কিন্তু তখন দু'হাত ছেড়ে এবং নানা ভংমায় এই জিনিস চালাইতে পারতাম বলে, আমার কনফিডেন্স এর সামনে ও আমার পিছনে উঠতে দ্বিধা বোধ করে নাই। কই, আমরা সেদিনগুলোতে তো কোন এক্সিডেন্ট করি নাই! আমি ঠিক মতো সাইকেলে নাগাল পেতাম না। ক্লাস সিক্সে আমার উচ্চতা ছিলে চার ফিট ৪ কিংবা ৫ । অনেক কষ্ট করে সাইকেল এর প্যাডেল নাগাল পেতাম। কখনো কখনো ব্রেক থাকতো না। আমি পা নামিয়ে দিয়ে স্যান্ডেল দিয়ে ব্রেক ধরতাম। কোন দিন আমি তাকে ফালায় দিই নাই। (লিখার এই সময়ে আমার অবস্থাটা ব্যক্ত করতে চাই না )
ক্লাস সিক্স এর বার্ষিক পরিক্ষার আরবি পরিক্ষায় আমি সাইকেল নিয়ে গেছিলাম। দুই জনে ৪০ মিনিটে ফুল আন্সার করে বেরিয়ে আসছিলাম। কত আনন্দ ছিল মনে! একদম নির্ভাবনাময় ছিলাম সেইদিন গুলোয়। সেদিনের পিচ্চি এই ছেলেটা ভাবে নাই, ১২ বছর পর এমন কিছুর জন্য তার অপেক্ষা করতে হবে!
ক্লাস সেভেনে সুইট ফার্স্ট, নিয়ন সেকন্ড, ওয়াকার থার্ড, আমি ফোর্থ, সিয়াম ফিফথ হলো। কিভাবে যেন ও একটু পিছায় গেল! কিন্তু এতেও ওর কোন ভ্রুক্ষেপ নাই! আমার খারাপ লাগতেছিল, আমার বি সেকশনে রোল ২, ওর এ সেকশনে রোল ৩ হলো। এক রুমে না থাকলে অনেকটা আউট অফ দ্যা সাইড, অলমোস্ট আউট অফ দ্যা মাইন্ড হয়ে গিয়েছিল। তারই মধ্যে সেভেনের এ সেকশন টা দুই তলায় । বি সেকশন তিন তলায়। সেভেনের দিন গুলা ওর নিশাদ,ফুয়াদ, তৌফিক, মীম,জিসান,সাকিফ, হারুনদের সাথে ভালোই কেটে গেছে। সেখানেও ক্লাস সিক্স এ এর মতো আলাদা কলামে রাখা ৩ টা বেঞ্চ ছিল। ওখানেই বেশির ভাগ সময় তারা বসতো। আমরা মনে হয় ফাযিল হইছি ক্লাস সেভেন থেকেই । কোন একদিন আমি ওকে সাইকেলে করে আনতেছিলাম, আর বলতেছিলাম," দোস্ত, আমিতো বোলিং শিখার ট্রাই করলাম। পারি না জোরে বল করে করতে। স্পিন করলেও বল টার্ন করে না। চিন্তা করছি, এই বার বৃত্তির টাকায় ভাল একটা ব্যাট কিনবো। ৫০০ টাকা দিয়ে।" তখন নিশাদ ফুয়াদ দের খুব সুন্দর একটা ব্যাট ছিল। অনেক হালকা। আমার মতো ধ্বজা প্লেয়ারো অইটা দিয়ে আনএক্সপেক্টেড মার দিছিল! ও আমাকে বলছিল, "কোন দরকার নাই। তুই আমার ব্যাটটা নে। বাসায় পড়ে আছে। খেলার টাইম পাই না।" এতে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল। আমি খেলার চিন্তায় মরতেছি। আর ওর তো কোন ভ্রুক্ষেপই নাই। ও একটা জিনিসে ফেড আপ হয়ে অইটা আমাকে দিতে চায়! যাহ, ব্যাটই কিনবো না। পরে আর কিনিও নাই। পরে এই শখটাও উবে গেছে। অথচ খেলা পারি বা না পারি, সোহেলদের এলাকায় খুব কম বিকালই যাই নি খেলতে।
ক্লাস এইটে আমি থার্ড হলাম। এ সেকশনে রোল ২ হলো। ও ফোর্থ হয়েছিল। বি সেকশনে পড়লো। রোল ২ । আমি প্রচেষ্টায় আর নিয়ন সিয়াম "দি লুতফর রহমান" এ পড়তো। উল্লেখ্য, নিয়ন বি সেকশনে ফার্স্ট বয় ছিল। যাই হোক, আমাদের সখ্যতাটা আগের মতো আর থাকতেছিল না। ও আমাকে ফার্স্ট স্যার জাফর ইকবালের একটা বই দেয়, নিউরনে অনুরণন নামে। বইটা ওর নাকি নিশাদের মনে করতে পারতেছি না। তবে ওদের সংগ্রহশালা ভালোই ছিল তখন। নিশাদের নিজের লিখা একটা মাসুদ রানার রেপ্লিকা টাইপ গল্প ছিল। গল্পটা আমাকে পড়তে দিছিল ও। "নিউরনে অনুরণন" "নিউরনে আবারো অনুরণন" বইয়ের অনেক ম্যাথ ই সিয়াম সল্ভ করেছিল!
ক্লাস নাইনে এসে সিয়াম বি সেকশনে ফার্স্ট হলো, আমি সেকন্ড । হামিদা বানু ম্যাডাম ক্লাস টিচার ছিলেন। হাজার বছর ধরে উপন্যাস টা রিডিং পড়ার সময় সিয়ামের চাপা হাসির কথা মনে থাকবে সারাজিবন। ক্লাসে ভদ্রতায় অতুলনীয় যারা তারা হলো, শোভন, সুস্মিত, অন্তর, সাজিদ, দীপ্ত এরা … আর বাকিরাও হাসতোই। এই ক্লাস নাইনেই (সম্ভবত) দ্বিতীয় সাময়িক এক্সামে উপপাদ্যের এক্সট্রা সিয়াম নিজে বানিয়ে লিখছিল!! আমি জাস্ট কপি করছিলাম তার কাছ থেকে। ও বারবার বলছে, দোস্ত না হলে আমার দোষ নাই।আমি বলছি, আরে ব্যাটা লিখতে থাক। আমি ওকে ত্রিকোণমিতি, পাটিগণিতে সামান্য হেল্প করতাম মাঝে মাঝে। এর একটা কারণ হলো, ও নানাবিধ চিন্তা করতো। আমি নিজে দেখছি, পরিক্ষার হলে ও অন্যভাবে মিলানোর চেষ্টা করতো! সত্যি কথা বলতে কি জামালপুরের মতো জায়গায় কন্সেপ্ট এত ক্লিয়ার করে কিছু শিখানো হয় না যে, আপনি নিজে নিজে উপপাদ্যের এক্সট্রা বানাইতে পারবেন । তাও আবার পরীক্ষার হলের শেষ ২০ মিনিটে। অতিরিক্ত মেধাবি না হলে এটা এক কথায় অসম্ভব! ছেলেটা সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নের উত্তর নির্ভুলভাবে দিত! আর সোজা প্রশ্নগুলা খামখেয়ালি বা হেয়ালি করে মাঝে মাঝেই ভুল করে আসতো! ক্লাস নাইনের শুরুতে আমরা দুই মাসের মতো একদিন পর পর সন্ধ্যায় আমিনুল স্যারের কাছে পড়তে যেতাম। তখনকার সন্ধ্যাগুলো সত্যি অনেক উপভোগ্য ছিল। স্যারের বাসা ছিল আন্ডার কন্সট্রাকশন। স্যার দেড়ি করে পড়াতে আসতো। মাঝে মাঝে ৩০ মিনিট পর এসে বলতো, আজকে না। পরের দিন। আমরা সেখানে ভালোই হৈ হুল্লোড় আড্ডা দিতাম। সিয়াম ক্লাস এইটের শেষের দিকে CX70 নামে সিমেন্স একটা ফোন কিনছিল। তখন ক্লাসের যাদের ক্যামেরা ফোন আছে, তারা হলো হিরো। ক্লাস নাইনে ফোন ছিল সিয়াম, তীর্থ আর হাতে গোনা দু এক জনের । তীর্থ আমাদের মধ্যে সবার আগে ফোন কিনছিল। এবং একটা বিচিত্র(!) কারণে ওর ফোন সারা ক্লাস ঘুরাঘুরি করতো। ফিফথ পিরিয়ডের দিকে ওকে প্রায়ই বলতে শোনা যেত "দোস্ত, আমার ফোনটা কার কাছে? " তখন ভাবতাম, কবে যে একটাএরকম ফোন কিনবো!! শালার টাকা যাই পাই, তাই তো খরচ করে ফেলি! সারাদিন গেইম খেলতাম। যদি কিনতে পারতাম একটা ফোন!
ক্লাস টেনে উঠলাম। সিয়াম এ সেকশনের ফার্স্ট বয়। আমি বি সেকশনের। বি সেকশনে আমাদের ক্লাস টিচারের বিচক্ষণতা (!) , আজাইরা পেচালের নৈপুণ্যতার (!) জন্য এ সেকশনের পোলাপানদের কাজ থেকে সমবেদনা পেতাম। ওরা আমাদের কে বলতো, "কাজে কাজেই বলি, বাবারা। পড়ালিখা করে কোন লাভ বেশি হবে না । " ক্লাস টেনের দিন গুলা আমাদের ভালোই কাটছে। শেষ শেষ ব্যাপারটা আমাদের শেষ ক্লাসের দিনও একটুও লক্ষ্যণীয় হয় নাই। টেস্ট এর শেষে একুল কোচিং এর কোন দিনে সিয়ামের ফোনে থেকে একটা গান ব্লুটুথে আমার ফোন নিছিলাম। ও বলছিল, ওর নাকি সুমনের গান অনেক ভালো লাগে। আমি বলছিলাম, সুমন কে? -_- ও বলছিল, "সুমনের ভয়েস এক্সসেপশনাল" । "তুমি ভরেছো এই মন" আর "এপিটাফ" গানটা আমাকে শুনায় ও । আমি "এপিটাফ" গানটার প্রেমে পড়ে যাই।
"মনের ক্যানভাসে ভাসছে, তোমার ছবি
বহুদিন তোমায় দেখি না যে
...। ...। ...। …
...। ...। ...। …
যুদ্ধ শেষে আজ ঘরে ফিরে
দেখি তুমি নেই যে পাশে
ভেবেছিলাম তুমি থাকবে দাড়িয়ে কৃষ্ণচূঁড়া ফুল হাতে
তবে কি যুদ্ধে গেলাম তোমায় হারাতে?
এপিটাফের লেখাগুলো পড়ি ঝাপসা চোখে
"
দোস্ত, বিশ্বাস কর। আমি জানতাম না তখন যে, তোর এপিটাফের সামনে আমার দাঁড়াতে হবে। আমার চোখ ঝাপসা হবে ।
এস এস সি পরীক্ষা আমরা সামনে পিছনে বসে দিছি। একসাথে ইংলিশের ফিল ইন দ্যা গ্যাপ্স উইথ ক্লুস আর উইদ আউট ক্লুস আন্সার করছি। আমাদের সময় একটা rearrange আসছিল। ঐটা ঐদিন আমরাই একসাথে সবচেয়ে নির্ভুল আন্সারটা বের করে ইংলিশে এ প্লাসটা নিশ্চিত করছিলাম। চাপা না। একদম সত্যি কথা কথা। fill in the gaps without clues এ এই ছেলে তুখোড় ছিলো। যত কঠিন ই হোক না কেন্ বারবার কাটা ছিড়া করতে করতে সঠিক উত্তর গুলাই লিখতে পারতো! আমাদের ধর্ম এক্সামটা খুব ভয় দেখাইছিল। ও বলতেছিল, হাদিস আন্সার করার বদলে অন্য একটা ব্রড প্রশ্ন আন্সার করবে। আমি বলছিলা, উহু। হাদিস আন্সার করবো। সময় কম লাগবে। আর হয়ে গেলেই ১০ এ কমপক্ষে ৯। ও বলছিল বারবার, "সাকিব, তুই কি সিউর, এইটা ৯ (বইয়ের সিরিয়াল)নাম্বার হাদিসটাই আসছে? ৮(বইয়ের সিরিয়াল) নাম্বার হলে তো উত্তর ভুল । " আমি সিউর বলছি জাস্ট। এরপর সে কোন দ্বিধা না করে ঐটাই লিখছিল। আমরা রচনামূলকে বেঁচে গেলেও নৈব্যর্ত্তিক এ ধরা খাই। বেলটিয়া স্কুলের এক পোলা আমাদের পাশের সিট পড়ছিল। ও বলছিল, ভাই। আপনার অনেক হেল করছেন। আপনাদের জন্য আমার একটা হেল্প। আমি জানি, এই আয়াত এই সূরার। আমরা দুইজন যেটা দিতাম, সেটাই ঠিক ছিল। ওই পোলার কথা শুনে এরকম দুইটা অব্জেক্টিভ ভুল করে সব মিলে ৫ টা ভুল করে ভালোই টেনশন করছি। সমাজ এক্সামের আগে ৫ দিন বন্ধ ছিল। তখন নোকিয়া ৩১১০সি এর একটা অফার ছিল। বৈশাখি অফার টাইপের। ও তো এই বন্ধের গ্যাপের মধ্যেই কম দাম দেখে এই ফোনটা কিনে ফেলে! পরীক্ষার মধ্যেও সারাদিন রাত কনফারেন্স কলে কথা বলতো তীর্থ, রবিন, মীম এদের সাথে। ওদের কয়েকটা মেয়ে বন্ধুও ছিল। কিন্তু তাদের নাম সম্পর্কে আমার আইডিয়া পরিষ্কার না বলে উল্লেখ করলাম না। এইচ এস সি শেষ হবার পর আর সবার মতো ট্রেন্ড এ তাল মিলিয়ে আমি আর সিয়াম একদিন হাজির হই আনিস স্যার এর বাসায়। ভদ্র লোক ফিজিক্স পড়ান। উনি বলছিলেন, আমি অনেক সময়ই ফার্স্ট বয় সেকন্ড বয় পড়াইছি। কিন্তু তাদের একটা আরেকটা নিজেদেরকে সহ্য করতে পারে না নরমালি। কিন্তু তোরা এমন কেন? তোদের তো কাউরে নিয়ে কোন মাথা ব্যথাই নাই। তোরা অনেক ভালো করবি। কথাটা সত্য। মর্নিং শিফটে তখন অনেক ভালো ভালো ছেলে ছিল। ওদের অনেকেই একটা আরেকটার সাথে ১ /২ নাম্বারের জন্য কি যে করতো !! এমনকি এরকম খবরও শুনছিলাম যে, এক ছেলে নাম্বার বেশি পাইছে বলে, আরেকজনের গার্ডিয়ান এসে ঐ ছেলের খাতা চ্যালেঞ্জ করছে। আমাদের কাছে এগুলা ছিল রীতিমত অবাক করা বিষয়! যাই হোক, এ প্রসঙ্গে বেশি কথা না বলাই ভালো। এরপর রেজাল্ট বের হলো এস এস সি এক্সামের। রেজাল্টের আগ দিকে সিয়াম, তীর্থ, নিয়ন, রবিন মিলে মনে হয় তোউফিকের দাদার বাড়িতের যায়। আমাকে জানাইছিল একমাত্র ও। কিন্তু আমার যেতে ছিল অনীহা। পরীক্ষার রেজাল্ট এরপর ও ভর্তি হলো সেন্ট জোসেফ এ । আমি রাইফেলস পাবলিক এ । কথা ছিল এক সাথে রাইফেলস পাবলিকে ভর্তি হবো। জিসানও হবে। যা হোক, এই কর্ম ব্যস্ত নগরীতে কোন একদিন একা একা বের হয়ে গেলাম অজানা এলাকা গ্রিন রোডের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে যাই বসুন্ধরা। ও গ্রিন রোডে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করতেছিল। বসুন্ধরায় সেদিনের আগের দিন নোকিয়ার ফার্স্ট টাচ ফোন ৫৮০০উদ্বোধন করে। আমরা হা করে ফোন টা দেখলাম। ধরলাম। আর ভাবলাম, এটা কিনা হবে না কখনো । এরপর বসুন্ধরায় ওর নোকিয়া ৩১১০সি তে দেখাইলো কাহাকে ফেসবুক বলে। এটা দিয়ে কি হয়! জিনিসটার গুরুত্ব(!) উপলব্ধি করে চপল ভাইয়ের ল্যাপটপ দিয়ে দুই দিন পরেই আমি ফেসবুক খানা খুলিয়া ইন্টারনেটে আশায় বুক পেতে বসি । আমার প্রথম ফেসবুক ফ্রেন্ড টাই আজকে চিরতরে ফেসবুক থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে।
শিপলু ভাইয়ের কল্যাণে নোকিয়ার একটা কনসার্টের ফ্রি টিকিট পাই বেশ কিছু। আমি সিয়ামকে ঐটা পাবার পর থেকেই গুতিয়ে গেছি, তুই বাসায় আসবি। আর একসাথে যাবো রেসিডেন্সিয়ালের মাঠে। আর্টসেল নামের এক ব্যান্ডের গান ওর নাকি ফেভারিট! আর্টসেল, কে কে , আইয়ুব বাচ্চু - কন্সার্টে গান গেয়েছিলেন। সেদিন যদিও আমরা লেট করে পৌঁছেছিলাম চপল ভাইয়ের কথায়। উনি বলছিলেন, আরে আয়, কার্ড খেলাটা শেষ করি। এসব কনসার্ট ৩ টা বললে ৪ টায় শুরু হয়। কিন্তু আসলে সেদিন ৩ টাতেই শুরু হইছিল। আমরা আর্টসেল এর পার্ট বলতে গেলে সবটুকুই মিস করি। ছেলেটা মন খারাপ করছিল। তখন আমার একটা ফোন ছিল স্যামসাং এফ ৪৯০। ওর ঐ ফোনটা অনেক পছন্দ হইছিল। আমাকে বলছিল, ৫ হাজার টাকা দিবে, আর ওর পুরানর ভাঙ্গা নোকিয়া ৩১১০ সি টা দিবে। আমি রাজি হইছিলাম। কারণ, ঐটা জাভা সাপোর্টেড ছিল না। আমার গেম খেলতে পারলেই হইছে। স্টাইল কিংবা ২০০৯ সালের ৫ মেগা পিক্সেল ক্যামেরা কোনটাই ভালো লাগে নাই । ও পরে যদিও আর আমার ফোনটা নেয় নাই। ও কাঠাল বাগানে থাকতো । পরে আবার যাত্রাবাড়িতে থাকা শুরু করছিল। এই ব্যাপারে একটু কনফিউজড আমি।
এই এস সি শেষে ভর্তি এক্সামের সময় ওর সাথে তেমন কথা বার্তা হতো না। ওর সাথে তারেক রবিন, নিয়ন, তীর্থ, জিসান দের অনেক সখ্যতা ছিল। আমার সাথে নরমালি ওর সিরিয়াস কথা বার্তাই হতো। সম্পর্কে ভাটা পড়লে যা হয় আর কি! ২০১০ সাল। চুয়েট এক্সাম দিতে যাবার সময় ট্রেনে আংকেল সহ সিয়ামের সাথে দেখা হইলো।আমি ছিলাম অয়ন ও তার বাবার সাথে। ও আমাকে দুই ট্রেনের মাঝে নিয়া সিগারেট খেতে খেতে গল্প বলা শুরু করলো। কাল যে পরিক্ষা এটা নিয়ে আমাদের কোন চিন্তাই নাই যেন! এদিকে আমি মেডিক্যাল পরিক্ষায় বাঁশ খেয়ে উদ্দেশ্যবিহীন এর মতো ! ওর গার্ল ফ্রেন্ড হইছে । আমাকে দেখাইলো । আমি বান্দা হা করে ভোদাই এর মতো দেখলাম। আর চিন্তা করলাম, আমার দ্বারা কিছুই হবে না। পড়ালিখা তো আর হলোই না। তখন ঢাকায় মীম এর বাসার অপোজিটে কয়েকটা ফাতড়া রিলেটিভ এর সাথে থাকতাম। আর আড্ডাবাজিই চলতো নাইলে গেইম খেলা আর চ্যাট করা। সকালে চুয়েট এক্সাম দিয়ে পরের দিনে ঢাকায় এক সাথে ফিরি না আমরা। ও আর আংকেল বাসে আসে সম্ভবত। আমি ট্রেনে। ঢাকা ভার্সিটি এক্সাম দেবার পর পরই চুয়েট এক্সামের রেজাল্ট পাবলিশ হয়। আই মিন, ৫ নভেম্বার। ওর ইচ্ছা ছিল CSE পড়বে। কিন্তু তখন সবচেয়ে ভালো মেরিট পজিশন ওয়ালা হলে ঈঈঈ পড়তে হবে- এমন একটা রুলের মতোন ছিল :/ সিয়ামের পজিশন চুয়েটে অনেক ভালো ছিল। কিন্তু আবার পাকনামি করে ইইই আগে দিছে । এরপর আর্কি । এরপর সি এস ই। কিন্তু তার প্রথম কলেই আর্কিতে হয়ে যাবার কারণে, সে CSE তে আর যেতে পারে নাই। আমারে বলতো, দোস্ত আর ৪/৫ টা সিট আগাইলেই আমি EEE তে চলে যাবো। দুয়া করিস ।
আমিও সেলফ চয়েচে SUST এর chemical, civil, petrol বাদ দিয়ে পাকনামি করে ভর্তি হলাম genetic engr. And biotech এ । যদিও অল্প কয়েকদিনেই বুঝছিলাম, সবার জন্য সব কিছু না। এত পড়া, আমার দ্বারা হবে না -_- যাই হোক, হঠাত করে একদিন ও ভর্তির পর বাসায় এসে আমাকে বলে ল্যাপ্টপ কিনতে হবে। ল্যাপ্টপ ছাড়া ভার্সিটি যাওয়া যাবে না। আমি বললাম, ওকে। বাসায় কথা বলি। বাসায় ঝামেলা করে ঐ সময় দুই জনে একই ল্যাপ্টপ কিনি। ৬২৯০০ টাকা সেই সময়ে অনেক টাকা। আমার মা, এবং আন্টি দু জনেই এটা নিয়ে আমাদেরকে ঝাড়ছিল। আমাদের মতো মিডিল ক্লাস ফ্যামিলিতে সে সময় এই টাকা মানে অনেক কিছু। আর এ ল্যাপটপ কিন্তু তখনো ৩৫ দিয়ে ভালোই পাওয়া যাইতো। এত টাকা একটা বাহুল্যতা ছাড়া আর কিছুই না।
সিয়ামের এক বান্ধবি ছিল। জারিন তাসনিম জয়ীতা। সাস্টে জেনেটিক্স এ এডমিশন নিছিল। যতদুর মনে পড়ে, ২০১১ এর জানুয়ারির একবারে প্রথমে অথবা ২০১০ এর ডিসেম্বারের শেষে Tom & Jerry এর প্রোফাইল পিকচার খচিত এই মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় করায় দেয়। অচেনা অপরিচিত জায়গায় ডিপার্টমেন্ট এর প্রথম পরিচিত মুখ! এরপর নতুন ভার্সিটি। যাইতাম আর র্যাগ খাইতাম। সেইম টু হিম অলসো। চিটাগং, সিলেট অনেক ডিস্ট্যান্স রে ভাই। কে কখন আসতো, তারো ইয়ত্তা নাই। আমার ফ্রেন্ড বাঁধন, সিয়াম, আমি ভর্তির পর বাসার সামনে দিয়ে হাটতেছি। আব্বু হেসে হেসে বলতেছিল, ভালোই হইছে। চিটাগং , সিলেট , রাজশাহী । বন্ধুত্ব এবার দেখা যাবে!
সিয়ামের একটা ছবি দেখলাম। চুল বড়। পিছনে ঝুটির মতো করছে। ছবিটা আমার ভালো লাগতো। আমার ল্যাপ্টপে সেইভ করে রাখছিলাম। একদিন ও জানালো, ও একটা ডি এস এল আর কিনবে। আমি জিজ্ঞাস করলাম, এইডা কি? ও কয় , আরে ! এইডা ক্যামেরা। আমারও মনে পড়ছিল তখন আমি SLR মানে পড়ছি ফিজিক্স এর "চোখ" চ্যাপ্টার এ । ও ক্যামেরা নিয়ে একবার বাসায় আসছিল। তখন আমি ভার্সিটি ছেড়েছুড়ে বাসায় এসে ডিম দিচ্ছিলাম। প্রথম ওর ক্যামেরায় হাঁসের ছবি তুলি। নাইকন ডি৩১০০। চপল ভাইয়ের ক্যামেরার আপডেটেড ফর্ম। যদিও তখন আমি সিয়াম ছাড়া কারো ক্যামেরা টাচ করার চিন্তাই করতাম না। এমনকি চপল ভাইয়েরটা (তখন অইটা উনার এক খালাতো ভাইয়ের ছিল) সেটাও না। আই ইউ টি সেকন্ড টাইম রি এড দেওয়ার অপশন থাকলে আমার চাঞ্চ হব- ওই প্রথম বলছিল এ কথা। আমারে নিয়ে সারা জীবন পজিটিভ আর আশাবাদি কথা ওই খালি বলছে সে সময়। আমার বাবা মাও এত পজিটিভ কথা বলেন নাই। চাঞ্চ পাবার পর ওকে ফোন দিছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে, ও তখন কার্ড খেলতেছিল। ও আমার কাছ থেকে নিউজটা পেয়েই ওর সামনের ফ্রেন্ড গুলাকে বলছিল। সবাই "জোস"বলছিল।
আই ইউ টিতে উঠে ফার্স্ট ইয়ারে ওর সাথে হালকা পাতলা কথা হইতো। জামালপুরেরও সেই বছরের বিশেষ কোন স্মৃতি মনে পড়ে না। এটুকু মনে পড়ে, ঈদের দিনে মার্কেট এর পিছনে আমরা অনেকেই গেট টুগেদার করতাম।
পরের বছরের মার্চে আমি ওকে ফোন দিলাম। জানাইলাম ক্যামেরা কিনবো। ডি৭০০০। প্রথমে রাজি হলেও পরে মানা করছে ও আমাকে। বলছে, আমার ক্যামেরা পরেই থাকে। কিনিস না। টাকা নষ্ট। আমি ওকে পালটা যুক্তি দিলাম, ওয়েডিং কাভার করে মানুষ হাজার হাজার টাকা কামাইতেছে। আমিও কামাবো। এই জন্য ভালো গিয়ার লাগবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে দেখলাম, সব কিছু সবার জন্যে না। ওর কথাই ঠিক হলো। আমার ক্যামেরা এখন বলতে গেলে বিছানায় বা বিছানার নিচে গড়াগড়ি খায়!
একটা সময় আমি ওর সাথে কথা বলায় ফ্রাস্ট্রেশন পাচ্ছিলাম। বলতেছিল, থিওরিতে নাকি ওর অবস্থা খারাপ। কিন্তু ল্যাব গুলায় অনেক ভালো। তখন আসলে আমরা সবাই অনেক বড় হয়ে গেছি। হিদায়াতের বাণী কারো দেবার মতো অবস্থা নেই, শোনারও নেই। দেখা হলে, আমরা ধর্ম, সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনা করা, কার্ড খেলা এগুলা করেই সময় পার করতাম।
ফোর্থ ইয়ারে উঠার পর একটা প্রজেক্ট এর কাজ ছিল। ছোট একটা গেইম ডেভেলপের। কাজটা করতে পারলে নাকি জব সিউর হবে একটা কোম্পানিতে । এমনি গুজবে কান দিয়ে শুরু করছিলাম কাজ করা। কাজ করতে করতেই ঈদ চলে আসে। বাড়িতে যাই। যথারীতি সিয়াম, তীর্থ, সাকিব এর সাথে দেখাও হয়। আমরা প্রচুর কার্ড খেলতাম তখন তীর্থের বাসায়। সিয়াম-সাকিব এক দলে। আমি আর তীর্থ এক দলে। সিয়ামকে কোন ভাবে উত্তেজিত করে দিতাম আমরা। আর কিভাবে যেন তীর্থ এর কাছে প্রায় ম্যাচেও ভালো কার্ড পড়তো। আমরা টানা তিনটা করে গেইম জিতছি এমন রেকর্ডও আছে! তীর্থের বাসায় আমার৫/৭ বারের বেশি যাওয়া না পড়লেও সিয়াম সাকিব এদের ৫০০-৭০০ বার অন্ততপক্ষে যাওয়া হয়ে গেছে। নভেম্বারে HUAWEI এর জব টা সিউর হবার পর জামালপুর গেছিলাম। সিয়ামের সাথে দেখা। ও HUAWEI এর ফোনের খুব প্রশংসা করলো! আমাকে বলছিল, আমি যদি কোন ফোন ডিস্কাউন্টে বা ফ্রি পাই, তাহলে যেন ওকে দেই। আমি বলছি, আচ্ছা,দিমু যা। এই সময় ওর পাসপোর্ট বানানোর জন্য অফিসেও আমি তীর্থ গিয়েছিলাম। প্রথমদিন ঘুষ হিসেবে কিছু দেই নাই এবং নেতার জোরও নাই বলে আমরা ব্যর্থ হই। পরের দিন জোর পুর্বক পাসপোর্টের ফর্ম জমা দিতে পারি। দুই জনেই আসছিলাম সেদিন। ওর পাসপোর্টার এখন মালিক নেই। শুণ্য পড়ে আছে।
আমার জানাশোনা ছিল পাঠ্য বই গুলার মধেই। ও আমাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে কনসেপ্ট দিয়ে আমার ভিতরে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। ও আগে আমাকে ওর পর্যায়ে নিয়ে আসছে। এরপর আমি প্রায়শই যে কোন ব্যাপারে তার সম্পুর্ণ বা পার্শিয়াল এগেইন্সট এ থেকে আমার লজিক তুলে ধরতে পারতাম। A wise man doesn’t do fight by body rather he loves to fight by word. 2015 এর ইফতারির টাকা তোলার সময় রিয়ন সিয়ামের বাসায় গিয়েছিল। সে সেদিন কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল এই ছেলের পোটেনশিয়াল এবং তাকে কিভাবে ডিফেন্ড দেওয়া হয়েছিল সেটা। সিয়ামের ক্যারেক্টারের একটা চমৎকার দিক হচ্ছে, ওকে কিছু বুঝালে সে বুঝতো। যত যাই হোক, তাল গাছ আমার- এই স্বভাব ওর ছিল না।
আমার আর ওর সাথে এই বছর জীবিত দেখা হলো না। আমি ২৬ মার্চ ওদের বাসার পিছনের দিকে শারমিন জাহানের বিয়েতে আসছিলাম। দৌলত ভাই অনেক মাইন্ড করতো যদি না যেতাম। তাই ১৭,১৮,১৯ বন্ধ পেয়ে হুদাই ঢাকায় থাকি। ডিসিশন নিছি ২৪ তারিখ যাবো। যাই হোক, শারমিনের বিয়ের খাবার খেয়ে বের হয়েই আমার মতো শর্ট টাইম মেমরি লুজার ফোন দেয় সিয়ামকে।
-হ্যালো, সিয়াম।
-হ্যালো, সাকিব। কি অবস্থা? চাকরী কেমন চলতেছে?
-এইতো দোস্ত। আমি তোর বাসার পাশেই। তুই কই? বাসায় আসছছ?
-না দোস্ত। আমি তো চুয়েটে।
-অহ,
-দোস্ত, হুয়াওয়ের ফোনে ডিস্কাউন্ট পাবি না তুই?
-১০% থাকে। আমার মতে GR5 এর চেয়ে দামি কোন ফোন কিনা উচিত না। তোর বাজেট ২৫ বা এর বেশি থাকলে হুয়াও কিনার দরকার নাই।
-হুম।
-দোস্ত। ঠিক আছে। ভালো থাক । রাখি। ভাবছিলাম, তুই থাকবি বাসায়
-হা হা। ওকে বাই তাহলে
-হুম, বাই।
২৯ মার্চ। অফিস থেকে এসে একটা মোজা খুলছি মাত্র। ফোনের চার্জ কুড়িল ফ্লাইওভারের উপর শেষ হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, ফোন অন করে দেখি, ইমনের টেক্সট। সিয়াম ডেড , কাচ মিক কুইক।
আমি ওকে ফোন দিয়ে বারবার বললাম, কোন সিয়াম। কি হইছে? ওর ফেসবুকের ওয়ালে রুহি নামের এক ভদ্র মহিলার নাম্বার ছিল। কল দিলাম। একটা বাচ্চা রিসিভ করে। বারবার বললাম, সিয়ামের কি হইছে? তুমি সিউর কি না। যখন একটা মধ্যবয়সী লোক ধরলো ফোনটা এবং নিশ্চিত করলো, তখন ফোনটা কেটে দিলাম।
আমরা মাইক্রো ভাড়া করে আসলাম জামালপুর। ওর লাশ দেখলাম। যতক্ষণ পারছি, আমি সুরা আর রাহমান, ইয়াসিন পড়ে পড়ে তার কপালে হাত রাখছিলাম। তার চুল গুলা হাত দিয়ে আচড়ে দিচ্ছিলাম। মনে ছিল এক নির্লিপ্ত পাপি অধম বান্দার যতসামান্য প্রার্থনা মিশ্রিত এক রাশ আকুতি মিনতি। বিশ্বাস করেন, আমি অনেকবার চিন্তা করছি, কেমন হবে, যদি এখন সে চোখ খুলে বসে! নাহ, মিরাকল হয় নি। আমি চাই নি ওর আব্বা আম্মার সামনে যেতে । কিন্তু ভিতর থেকে আমাকে ডাকা হইছিল। গেলাম কাছে। আন্টি- আংকেল আমাকে জড়ায় ধরে চিল্লায় কাঁদছে। সিয়ামের বাবা-মা এক কথা চমৎকার মানুষ। সহজ-সরল। আমাকে অনেক ভালবাসেন তারা। আমি দুঃখিত, আন্টি আংকেল। আপনাদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে উলটা নিজে জোরে জোরে কাঁদছি। আমাকে মাফ করে দিবেন, ফেইক সান্ত্বনা আমার কাছে হিপোক্রেসি মনে হয়। আমি হিপোক্রিট হতে চাই নি। আমার বন্ধুর লাশ আমার সামনেই পড়ে ছিল। আমি দেখেছি চুয়েটের ছেলে গুলাকে। আহ, ওদের মনে না জানি কত কষ্ট ছিল। ওদের সামনেই এই বয়সী একটা ছেলে কথা বলতে বলতে মারা গেছে! আমার বন্ধু, প্রায় দুই ঘন্টার মতো কথা বলতে পারছে। বাঁচার জন্য আকুতি মিনতি করছে। আল্লাহ আল্লাহ করছে। আফসোস, আমরা তাকে মেডিক্যালে নিয়েও বাঁচাতে পারি নি। লাশ খাটিয়ায় তোলার সময় আমি ওর ডান হাতের পাশটা ধরছিলাম। তখনো ভাবছি, ও যদি আমার হাতটা আকড়ে ধরতো! নাহ, হয় নি সেসবের কোন কিছুই।
“মহাকালে মিলিয়ে গেলি হঠাত কখন.....................”
জানাজার নামাজ পড়ে ওকে নিয়ে গেলাম গোরস্থানে। আমির বাবু কবরের বাজে অবস্থা দেখে লাফ দিয়ে ওটায় নেমে কবর ঠিক করে। আমরা সিয়ামকে উপর থেকে সাবধানে কবরের ভিতরের দিন জনের হাতে দেই। ওরা ওকে রেখে কাটা বাঁশ আড়াআড়ি ভাবে রেখে একে একে সবাই কবর থেকে উঠে আসে। একটা সময় পুরোটা বাঁশে ছেয়ে যায়। আমরা উপর থেকে "মিনহা খালাকনাকুম, ওয়া ফিহা নুইদিকুম, ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম, তারাতান উখড়া" বলতে বলতে মাটি দিয়ে দিই। এভাবেই একটা জীবন হারিয়ে গেল। এভাবেই একটা ভালোবাসার পরিসমাপ্তি হলো সকল বাঁধন ছিন্ন করে। আল্লাহর ডাকে মানুষ বাধ্য হয়ে যে কোন অবস্থাতেই সাড়া দিতে পারে!
আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করে দেন, ক্ষমা করে দেন, হিদায়াত দিন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, সিয়ামকে জান্নাত পাইয়ে দিন। তার কবরকে অনুগ্রহ পুর্বক জান্নাতের টুকরা বানিয়ে দিন।
আমার মুনাজাতে রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরার পর চিরস্থায়ী ভাবে স্থান করে নিলো, আল্লাহ আপনি সিয়ামকে জান্নাত পাইয়ে দিন। তার কবরের আযাব দূর করে দিন।
এদিকে এখন চুয়েট উত্তাল। শিক্ষার্থীর কেউ চায় না এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। তাই তারা ৯ দফা আন্দোলন শুরু করেছে। ভিসি(পড়ুন বিচি) তাদেরকে সাপোর্ট তো দেয়ই নাই উলটা ভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য অফ করে স্টুডেন্ট এর ক্ষতি করতেছে। We don’t expect more than a so called বিচি!
অফিসে চুয়েটের কলিগ আছে ৩জন। আনিকা আর কিশোয়ার এর সাথে দেখা হয় বেশি। এদের কে যে কোন দিনে প্রথম দেখলেই মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা লাগে। আমার বন্ধুও ওদের মতো আর কয়দিন পরে পাশ করে বেরিয়ে রঙ্গিন জীবন যাপন করতে পারতো। বাবা মা তথা নিজের স্বপ্ন একটু একটু করে বাস্তবে আনতো নিয়ত।
Footnote: আমি জানি না, আমার অনুভূতি বেশি কি না। “মনের ভিতর যুদ্ধ চলে আমার সারাক্ষণ, নেশার মতো ডুবে থাকে ক্লান্ত এ জীবন। ” তবে আমি মারাত্নক স্মৃতিকাতর। সহজে কোন কিছু ভুলতে পারি না। অতীত স্মৃতি মনে করায় হুটহাট করে লিখেছি টানা ৪ ঘন্টা ২৫ মিনিটের মতো।২০০০-২০১৬ পর্যত্ন ক্রমান্বয়ে প্রত্যেকটা বছর তুলে ধরছি। বাহুল্য কিছু থাকলে ক্ষমা প্রার্থী। মাঝে মাঝে ২০-৩০ সেকন্ড লিখা থামাইছি কারণ, চোখ blur হয়ে আসতেছিল । চেষ্টা করছি, যথা সম্ভব কম বানান ভুলের। পরে আর রি চেক করি নি। থাকলে নিজ উপলব্ধিতে বুঝে নিবেন।
এস, এম জোবায়েদ
রাত ৩ঃ৫১ । ৪/১/২০১৬
ভার্সনঃ 1.2.1
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:১২