ছোটবেলায় খান মোহাম্মদ ফারাবীর ‘মামার বিয়ের বরযাত্রী’ বইতে পড়েছিলাম কামাল ভাই তার শাগরেদ ফোকলাকে ফরাসী ভাষায় জ্ঞান ঝাড়ছে “ওসে আতাশে ভিউ।” বলে।পরে যখন ফরাসী শিখলাম, জানলাম এটা কোন ফরাসী নয়। কিন্তু টেনি’দা যখন বলে সে জার্মান জানে আর বলে- “হিটলার, জার্মান, বার্লিন, নাৎসী, খটাখট।” সেগুলোকে জার্মান না বলি কি করে?
কৃষণ চন্দরের ‘নীলা হরিণের দেশে’ বইতে নায়িকা শিনা নায়ককে (নাম ভুলে গেছি)বলেছিল-“উশা বাশা তুশা।” নায়ক জবাবে বলেছিল-“মারব একটা ঘুষা।” তখন ছোট বলে ভেবেছিলাম এমন ভাষা সত্যি আছে। সিন্থেটিক ভাষা আছে, তেমনি এক ভাষার নাম এসপারেন্টো। এটার নাম প্রথম জানতে পারি টিনটিনের কমিক্স থেকে। কমিক্সগুলোতে লম্বা একটা তালিকা থাকত কি কি ভাষায় টিনটিন প্রকাশিত হয়, সেটাতে ছিল এসপারেন্টোর নাম।এই ভাষার আবিষ্কর্তা একজন বেলোরুশীয়ান চিকিৎসক, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে মেলবন্ধনের একটি ভাষার মাধ্যমে। আরেকটা ভাষার নাম পেয়েছিলাম প্রভাঙ্কসাল। এটা মূলতঃ দক্ষিণ ফ্রান্সের কিছু লোকের ভাষা। তবে ইতালী, স্পেন, মনাকো আর ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট একটা কমিউনিটিতে সব মিলিয়ে মোট ৩৬২,০০০ জন এই ভাষায় কথা বলে। ট্রিস্টান আর ইসল্টের প্রেম কাহিনী পড়ার সময় পটভূমি কর্নওয়াল নিয়ে আগ্রহ হয়, ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখি এই জায়গার নিজস্ব একটা ভাষাও আছে যেটার নাম কর্নিশ। কিন্তু মাত্র ২০০০ লোক তাতে ভাব বিনিময় করেন।
আইরিশ-গ্যালিক ভাষাভাষীদের প্রতি একটা সহমর্মিতা বোধ করি। ১৯শতকে ব্রিটিশ শাসনকালে তাদের ভাষা চর্চ্চা ছিল নিষিদ্ধ। এই ভাষাকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। যাঁরা স্কুলে এই ভাষা পড়াতেন, তাদের বাধ্য করা হয় দেশ ত্যাগে। শিক্ষকদের অনেকে জীবিকার প্রয়োজনে বেছে নেন অন্য পেশা।নিজ ভাষা চর্চ্চার অপরাধে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছেন আইরিশ মানুষরা এই ভাষায় যত রাস্তাঘাটের নাম ছিল সব পরিবর্তন করে ইংরেজী করা হয়। ১৯২২ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আইরিশ সরকার স্কুলগুলোতে আইরিশ-গ্যালিক শেখা বাধ্যতামূলক করেছেন। কিছুদিন আগে আইরিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাস্তা-ঘাটগুলোকে আবার আইরিশ-গ্যালিক নাম প্রত্যর্পণ করা হবে।
অনেকে জানেন হিব্রু বুঝি ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের ভাষা। এই ধারণা হয়েছে সম্ভবত ইজরায়েলের ইহুদী ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিতির কারণে। আমার যতদূর ধারণা ইহুদীদের নিজস্ব ভাষা হল ইদ্দিশ। আইজাক সিঙ্গারের লেখা পড়তে গিয়ে প্রথম এই ভাষার কথা জানতে পারি। সিঙ্গার নাকি প্রথমে লেখেন ইদ্দিশে, তারপর ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তবে সব লেখা নয়।ধর্মাচরণের সাথে অনেক সময় ভাষা গভীরভাবে যুক্ত থাকে। আমরা কেন আরবীতে নামাজ পড়ি? কেন বাংলাতে নয়? আল্লাহতো সব ভাষাই বোঝেন।
আমার দক্ষিণ আফ্রিকান বান্ধবী রোশেল আমাকে বলেছিল ওদের আফ্রিকানাস নাকি ডাচ ভাষা থেকে উদ্ভুত। আমি অবাক হয়ে যাই! পৃথিবীর এত দেশ থাকতে ডাচ কেন? প্রথম দিকের শ্বেতকায়রা সম্ভবত নেদারল্যান্ডের অধিবাসী ছিলেন। স্প্যানিশভাষী কিউবার লিলিয়ানা আমাকে বলেছিল ওরা নাকি ইতালীয় বোঝে। হতেই পারে, আমাদের যেমন অহমিয়া বুঝতে সমস্যা হয়না।হিন্দি পড়ে আমি মোটামুটি বুঝতে পারি, অথচ মারাঠি পড়ে কিছুই বুঝতে পারিনি। সুইডেনে বসবাসকালীন সময়ে দেখেছিলাম কোন কোন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, যাদের ভাষা সুইডিশ নয়, তাদের প্রচ্ছন্ন বিরক্তি আছে এই ভাষার প্রতি। কি ব্যপার? তাদের একজন আমাকে বলল তাজ্জব কথা। সুইডিশ জানা থাকলে নাকি কাজ পেতে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। মনে মনে হাসি আমি- মাত্র ৩টা দেশ, জনসংখ্যা এত্তটুকু, তাদের মধ্যে ভাষা নিয়ে রেশারেশি! ফিনল্যান্ডের হানা আমাকে একদিন মজার একটা প্রশ্ন করে- তোমাদের ভাষার কি বর্ণমালা আছে? আমি বেশ জোরে হেসে ফেলি এবং বাংলাভাষার কথা বলি। কথা প্রসঙ্গে আসে রবীন্দ্রনাথের কথা। ওকে আমি ছবি দেখাই। তখনও জানতাম না আমার জন্য একটি চমক অপেক্ষা করছে। একদিন কথায় কথায় ওকে বলি- I miss my language. ও কয়েকদিন পর আমাকে খবর দেয় পাব্লিক লাইব্রেরীর দোতলায় বাংলা বই আছে। আমি তো অবাক, “তুই বুঝলি কিভাবে?” “বাহ! ওখানে যে রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখলাম!”
রবীন্দ্রনাথ ও হেলেন কেলার
শুধু কি মুখের ভাষা? আছে ইশারার ভাষাও। প্রতিটা ভাষার আলাদা ইশারার ভাষা আছে কিনা জানিনা, তবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার ভাষা এক হলেও ইশারার ভাষা কিন্তু আলাদা। আছে আন্তর্জাতিক ইশারার ভাষাও। যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তারা মুখে বলেন আর কানে শোনেন। পড়েন ব্রেইল পদ্ধতিতে। কিন্তু যারা একই সাথে শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তাদের উপায় কি? কিংবদন্তীসমা হেলেন কেলারের শিক্ষা হয়েছিল অভিনব উপায়ে। তাঁর শিক্ষিকা এবং চিরবান্ধবী এ্যানি সুলিভান তাঁর এক হাত রাখতেন যে জিনিষটার নাম শেখাতে চান, অন্যহাতের ওপর সেই নাম লিখতেন। যেমন- একটা হাত পানির কলের নীচে রাখলেন, অন্যহাতে লিখলেন w-a-t-e-r. এভাবেই শুরু হয়েছিল শিক্ষাজীবন যা টিঁকে ছিল ৪৯ বছর।
ভাষা সততই প্রবহমান। এই ব্লগেই দেখুননা কত নতুন নতুন শব্দ শিখি। দেখবেন যারা বিদেশে থাকে বা বিদেশে জন্মেছেন, তাঁদের বাংলা একটু অন্য রকম। আবার কত ভাষা যে মরেও যায়। ২০০৮ সালের ২১ জানুয়ারি মারি স্মিথ জোন্সের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃত্যু ঘটে ঈঈক ভাষার। এই ভাষাটি প্রচলিত ছিল দক্ষিণ-মধ্য আলাস্কায়।এমনি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বিরাশিটির মত ভাষা আর মৃত্যুর মুখোমুখি আছে পাঁচশ’ ষোলটির মত ভাষা।
বাংলা শিখলে কি কি ভাষা বোঝা বা শেখা সহজ হয়? আমি হিন্দি বুঝি আর পরে পড়তে শিখেছি নিজের উদ্যোগে। মারাঠি আর নেপালি যদিও দেবনগরী অক্ষরে লেখা থাকে, পড়ে কিছু বুঝিনা। অহমিয়া (আসামের ভাষা) কিছু পত্রিকা পড়েছিলাম, কিছুটা বুঝেওছিলাম। অহমিয়া রেডিওর সংবাদ শুনে অল্প অল্প বোঝা যায়। গুজরাতি কেমছে, এমছে শুনে সবসময় বোঝা যায়না কিন্তু, আর অক্ষর এত প্যাঁচান! রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহ ঠাকুর নামে ব্রজবুলী ভাষায় একগুচ্ছ গান আর কবিতা লিখেছিলেন । ব্রজবুলী ভাষার মূল দু’টি ভাষা- অবহটঠ, মৈথিলী। তবে মৈথিলীর ভাগই বেশী। বিদ্যাপতি এই ভাষায় লিখেছেন, পরে স্টাইলটি অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সুকুমার সেনের কোন একটা লেখায় পড়েছিলাম যেন, ব্রজাওলি (ব্রজ সম্বন্ধীয়) থেকে ব্রজবুলী নাম এসেছে। কেননা এর পদ বা গানে রাধা-কৃষ্ণের কথা থাকে।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ তৈরী করেন ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড ১৭৭৮ সালে, বইয়ের নাম- A Grammar of the Bengal Language. মূলতঃ রাজার জাত যেন আমাদের আরও উৎকৃষ্টভাবে শাসন করতে পারে বাংলা শিখে সেটাই ছিল লক্ষ্য। একজন ইংরেজ আমাদের ব্যাকরণ তৈরী করেছেন বলে আমাদের ভাষার syntax ইংরেজির মত। বাংলা ব্যাকরণ প্রথম তৈরী করে ছিলেন মানোয়েল দা আসাম্পকাম নামে একজন পর্তুগিজ ধর্মযাজক ১৭৪৩ সালে। তবে সেটা ছিল অসম্পূর্ণ। তাছাড়া পর্তুগিজদের ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন কায়েমেও ব্যর্থতাও এই ব্যাকরণ বইয়ের হারিয়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ হতে পারে। আচ্ছা, যদি পর্তুগিজরা শাসন কায়েমে সফল হত, তাহলে কি আমরা পর্তুগিজ স্টাইলে বাংলা বলতাম? স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে পর্তুগিজ শিখতাম? জানতে ইচ্ছা করে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:৫২