রাতবিরেতে কুত্তার দলের ডাক রাতের শ্রী বৃদ্ধির উপাদান এহেন ধারণা খালেকুজ্জামানের চিরকালের। কুত্তার দল কী বলতে চায় তিনি কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করেন। আশপাশের কুত্তার দলের আদমসুরাত তার কাছে গৃহের চির সত্য সংগ্রাম হয়। মানবের লগে মিল খুঁজতে থাকেন। চিরকাল তাই করে গেছেন।
তার মনে পড়ে আশ্বিনের এক দিনের কথা; খোলা আকাশ, পদতলে নানা রঙের মাটি, নিখুঁত পেখম উড়িয়ে চলে যায় বাজপাখি। রৌদ্রের ঝংকারে ভ্রূ তটে জমা হওয়া এক ফোটা ঘামের বিন্দু ভস্ম হয়ে মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। আকাশ পানে তাকানোর পরে যে গঞ্জনা খিখি'র ন্যায় বেরিয়ে আসে তিনি তাতে সন্তুষ্টি পান। বুঝতে পারেন ক্ষমতার ত্রিসুর হাতে যে ঈশ্বর বসে আছেন সেই ক্ষমতাবলে তিনি মানব যন্ত্রনা মধুমক্ষির মত কুড়িয়ে নেন। অনতিকাল পরে হাটা ধরেন ধান খেতের মাঝ বরাবর।
যেদিকে চোখ যায় কাঁচা ধানের অনন্ত সবুজ প্রান্তর। “ঐদিকে গেলে রাক্ষস আছে, কখনো যাস নে বাবা” ; তার মায়ের কথা তখন মাথায় ঘুরতে থাকে। “রাক্ষস বাচ্চাদের খেয়ে ফেলে” তখন খালেক্কুজ্জামান জিগেস করেন বাচ্চা খেয়ে ফেলার কারণ। উত্তরে মা বলেন বাচ্চারা সাহসী কম।
জেদ ধরে খালেকুজ্জামানের। কে বলেছে সে ভীতু? তার হুংকারে সেদিন হাঁসের ছানা কেমন ভয়ে দিশেহারা হয়ে যায়। তাও নিজেকে বীর প্রমাণের এই চেষ্টা তার।
আশ্বিনের সেই দুপুরে খালেকুজ্জামানের রাক্ষস ধরা হয়নি ঈশ্বরের ত্রিসুরে আঘাত হানা বৈশ্বানরের অভিশাপে। ফিরে এসে গ্রামে অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে চেনা রাস্তায় তার অচেনা পদপক্ষেপে হলুদ বালিকণা বিকীর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী হতে লাগল। তার এই লৌকিক যাত্রার কদমে কদমে, তালে তালে বেলা বইতে থাকল। সময়ের বুনন জাল ক্রমশ দিবালোক’কে গ্রাস করতে লাগলে এক প্রান্তে এসে পৌঁছুলেন খালেকুজ্জামান। গ্রামের শেষ মাথায় বেঁদের দলের ভ্রাম্যমাণ নিবাস। বেঁদে বালক দল দুটো কুত্তাকে তড়িয়ে আসলে খালেকুজ্জামানকে দেখে স্থির হল। স্থির তাদের হলুদ চোখ, ওমন ভাবুক আগন্তুক দেখে চমকিত বালক দল থেমে খানিক বাদে দূর থেকে কুত্তা দুটো'কে পাথর ছুড়তে লাগল। কুত্তা দুটো শত বাধা পাওয়ার পরেও মিলনের তাগিদে আবার জট লাগল। সাথে অদ্ভুত শীৎকারে বালক দল বুঝতে পারে না এ কেমনতর লড়াই।
খালেকুজ্জামানের আগ্রহ জাগে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলে দৃশ্য পরিষ্কার হয়। ঘোর লাগা মিলনের স্তব্ধতার হিরণ্ময় মুহূর্তে দূরের আকাশে তখন উড়ে যায় শ্বেত কৈতরের দল।
কুত্তারা শত মার খেয়েও মিলিত হয় এখন আবার তাদের রাত কাঁপানো বিবাদের মানে বুঝতে বাকী থাকে না খালেকুজ্জামানের। তার ঘুম ধরতে থাকে। বিছানায় গিয়ে স্ত্রী'র স্পর্শের চরম অভাব বোধ করেন। গতকাল তুমুল ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যান সালেহা। ঘৃণা'র বুদবুদ ফুটন্ত পানির মত উৎরে পড়ছিল তখন। এখন তবে তীব্র মিলনের ইচ্ছা জাগানিয়া তার এই মানব সত্তা তবে কেন সকল কিছুর শ্রেষ্ঠ ভাবতে ভাবতে তার চৈতন্য বিক্ষোভে আলোড়িত হতে থাকে।
২
ঘুমন্ত ব্যক্তির উপর চাবুক পেটা করলে যেমন কেঁপে উঠে শহর তেমনি কেঁপে উঠছে ক্ষণিক বাদ বাদ; দেহ থেকে নির্গত গলদশ্রু'র পিচ্ছিল রাস্তায় বন্ধ্যা আন্দোলন চালিয়ে যায় বিম্পি। দিগ্বিজয়ীর মত ঘুরছে সময় দিগন্তের পয়গম্বর হয়ে; বেহেড মাতাল, বমি করা কুত্তা ভেবে খালেকুজ্জামান বারান্দায় বসে সিগ্রেট ফুঁকবেন কিনা দোটানায় ভুগেন। সালেহা বাপের বাড়ি থেকে ফিরেছে কিন্তু গতরাত থেকে একসাথে ঘুমায়নি। নিষিদ্ধ ইস্তেহারের মত শুধু দূর থেকে পাঠ করছেন; দেহের নিগূঢ় লোম চঞ্চল হয়ে উঠে, রক্ষিত; পরিভ্রষ্ট আদ্র আবেগ জানান দেয় তাহেরার কথা।
তাহেরা হটবাজারের গণিকা। একসাথে হাতে হাত রেখে, নয়নে নয়ন ঢেলে, মুখের মিষ্টি খিলী পানের সুবাসে ভর করে কত রাত পার করেছেন গুনতে থাকেন। হটবাজারের গণিকালয় কী আছে? তাহেরা কী তবে বৃদ্ধ হয়ে গেল?
মনে পড়ে যায় তার প্রথম রাতের কথা; সন্ধ্যা থেকে প্রত্যুষের মরমী সময়; মুখে তার এক খিলী সুবাসিত পান ঢুকিয়ে তাহেরা বলেছিল, "ওরে আমার কচি সোনা পারবি তো কোলে তুলতে?"
উদ্দম কৈশোর, বিদ্রোহী মন, রসিক চৈতন্যে বলেছিলেন, "খাট শক্ত আছে তো?"
পান চাবানো থামায় তাহেরা, গোল হয়ে যাওয়া চোখে বিপুলা বিস্ময় নিয়ে হাসতে হাসতে গাল টিপে দিয়ে বলে, "ওরে শেয়ানা ঢ্যামনা রে..."
ভাবতেই হাসি পায় খালেকুজ্জামানের। বিগত সেই নারী কী এখন বার্ধক্যে নত, বিবাহিত সংসারী? গণিকাদের বিয়ে হয়? হলেও হবে হয়ত।
বড় ভাল মন ছিল তাহেরার। একবার বলেছিল, "মাগীগো শরিল যতটা নষ্ট মন তাগো ততটাই পবিত্র।"
কুসুমিত দেহে ঝিম খায় খালেকুজ্জামানের।
"ট্যারা চোখে চেয়ে মুচকি হাসছো কার কথা ভেবে?" আচমকা সালেহা চলে আসে। খানিক অপ্রস্তুত ক্লেশ হাসি দিয়ে তাকান সালেহার দিকে। বারান্দায় দাহ নেই, শোণিমা'র আভায় হাতের তালু ঘেমে উঠে খালেকুজ্জামানের।
"তোমার না টনসিলে ডাক দিছে, ডাক্তারের এপয়ন্টমেন্ট ছিল। যাবা না?"
শ্রাগ করেন খালেকুজ্জামান।
রাগ দেখিয়ে চলে যায় সালেহা। নির্লিপ্ত নয়ন দ্রোণাচার্যের মত বিদ্ধ হয় সালেহার ঘামে ভেজা পেটের নিচে। শাড়ি পরেছে সালেহা। আজ রাতে কী তবে আসবে তার কাছে? সালেহার মন ভাল করার জন্য আর কতটা দ্বাপরযুগ পার করতে হবে ভেবে অকূলদরিয়ায় খেয়া চালাতে থাকেন খালেকুজ্জামান।
প্রস্তুত হন ডাক্তারের কাছে যাবার। পাঞ্জাবি পরেন। কলারে লেগে আছে সেদিনের মাছের ঝোল; গন্ধ শুঁকে দেখেন। আমুদি হয়ে কল্পনা করেন ঐদিনের কথা। ঐদিনই শেষ সালেহার খুব নিকটে এসেছিলেন।
৩
"ভাই এই যে এইখানে আমার বয়েস কমাইয়া লেখাইছি। সমস্যা নাই তো?" খালেকুজ্জামানকে টিকেট দেখিয়ে প্রশ্ন করল লোকটা। পান খেয়ে ঠোঁট লাল, উজ্জ্বল ফর্সা। কর্কশ কণ্ঠে বার বার গলা খাকারি দিচ্ছে। চোখ দুটি নিঃস্ব কুম্ভের মত স্থির হয়ে আছে।
একটু পরেই খালেকুজ্জামানের সিরিয়াল। ওয়েইটিং রুমে বসে আছেন। ভাবার কিছু না পেয়ে পাশের লোককে মনযোগ দিলেন।
"বয়স কত আপনার?"
লোকটি ব্যস্ত হয়ে যায় প্রশ্নে। দুই পকেট হাতড়ায়। আতরের গন্ধ এসে নাকে লাগে। সুগন্ধের তারিফ করেন মনে মনে। তখনই এনার্জি লাইটের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠে লোকটার মুখ।
আইডি কার্ড এগিয়ে দেয়। জন্মসন দেখে হিসাব কষেন খালেকুজ্জামান।
"আপনার বয়স তেত্রিশ। অনেক কমিয়ে লেখিয়েছেন।" খালেকুজ্জামান বলেন।
"এখন?" লোকটার মুখ পাংশু হয়ে যায়।
কি বলবেন ভেবে পান না খালেকুজ্জামান। এই লোকটার বয়স তেত্রিশ মানতে পারছেন না তিনি।
"আপনি বিবাহিত?" এতক্ষণে যেন ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন খালেকুজ্জামান। এক গাল হেসে যেন গলে পড়ছে লোকটা। সাদা সাদা ফাঁকা দাঁত খুব বেরিয়ে আছে-- আস্ত পাঠা জবাই করে ঠেসে গুঁজে দেয়া যাবে দাঁতের ফাঁকে। লজ্জায় নীরব থেকে ক্ষণিক পরেই সে পকেট থেক সুদর্শন মোবাইল বের করে সে খালেকুজ্জামানকে ছবি দেখায়।
"এই আমার বউ, এই ছুডু মাইয়া আর এই বড় পোলা। মুসলমানি হইছে।" লোকটি হাসে।
খালেকুজ্জামান দেখতে থাকেন। যুবতি এক মেয়ে তাও দুই বাচ্চার মা। সালেহাকে যখন বিয়ে করেন তখন তার বয়স কত ছিল?
"বুড়িগঙ্গার পাশে আমার বিজনেস আছে। তিনটা লঞ্চ, ছয়টা বাস, একখানা করোল্লা,...."
লোকটি বলতে থাকে কিন্তু তার কানে বাজে প্রতিপাদ্য স্বপ্ন। ছেদ পড়ে ভাবনায়। ডাক পড়ে তার।
এই ডাক্তার কেমন ডাক্তার তিনি বুঝতে পারেন না। চেম্বারে প্রবেশের পর নাম জিগেস করল, সমস্যা জানল তারপর মুখে টর্চ জ্বেলে কীসব দেখে প্রেসক্রাইব করে দিল। এখন সেই প্রেসক্রিপশন নিয়ে ম্যারাথন ছুটছেন তিনি। বিপন্ন আরোহী হয়ে প্রেসক্রিপশন দেখেন, কিছু বুঝেন না। হতাশার পোঁটলা বেধে আবার ছুটেন। হাসপাতালে এলেই দুনিয়াটা অসুস্থ মনে হয়। সাদা এপ্রোনের দৃশ্য তার মন থেকে সুপ্ত আফসোস কুণ্ডলী পাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে। বড়ই ইচ্ছা ছিল তার ডাক্তার হবার। ডাক্তার দেখলেই মনে প্রশ্ন জাগে, 'কেন যে সাইন্স নিলাম না'।
অংকে দুর্বল, কাটাছেড়া ভয় পান ইত্যাদি দিয়ে নিজেকে তোষিত করে ফার্মেসিতে যান।
"ভাইসাব আপনে। দেখলেন দেখা হইয়া গেল।"
সেই লোকটি।
"দেখি কী ওষুধ দিল" বলে হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বিজ্ঞের মত চোখ বুলায়। ইংরাজিতে নিজের নাম লেখতে জানে কিনা সন্দিহান মনে প্রেসক্রিপশন নিয়ে কথা না বাড়িয়ে ছুট লাগান।
রাস্তাঘাট ফাঁকা। জনমনে আতঙ্ক। থেঁবড়ানো সাহস নিয়ে কেউ কেউ কাজে বেরিয়েছে। বিম্পি হরতাল বিক্ষোভ উৎসবের সাথে পালন করছে। তাতেই নীরবে যোগ দিয়েছে তথাকথিত ধর্মীয় কিছু দল। আম্লীগ অবৈধ সরকার এই মর্মে তাদের প্রতিবাদ।
একটি বাস পুড়ছে। অর্ধেক পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। উৎসুক কিছু জনতা আয়েসি নজরে দাঁড়িয়ে দেখছে। দুই সাংবাদিক লাইভ টেলিকাস্টে আছে। পুলিশ এসে পৌঁছায়নি তাই পাশের রাস্তায় সমাবেশ করছে একটি তথাকথিত ধর্মীয় রাজনৈতিক দল। কী অবলীলায় মানুষ হত্যার হুমকি দিচ্ছে তারা; দণ্ডনায়কের বাণী পাশে রেখে ভয়ার্ত মনে বাসায় ফিরলেন। পানি খেয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকেন। বারান্দায় গোলাপ ফুলের গন্ধ।
৪
শৈশবের কথা মনে পড়ে যায় তার। মুসলমানির জন্য ইমামসাব আর আযম এসেছেন। ধরে মেরে মুসলমানি হল তার। খেলাধুলা সব বন্ধ, হাটাচলা করতে কষ্ট তার। তখনকার এক রাতে মা'কে জিগেস করেন, "আম্মা মুসলমানি না করালে কি হিন্দু থেকে যেতাম?"
ঐ প্রশ্নের পর ঠাস করে যে চড় খান তার শব্দ এখনো কানে বাজে। প্রশ্নের উত্তর দেয় বাল্যবন্ধু শফিক।
যাদের মুসলমানি হয় না তারা হিন্দু থেকে যায়। সরল বিশ্বাস নিয়ে বড় হওয়া খালেকুজ্জামানের আজকে দেখা ক্রোধী ওই জনগোষ্ঠী কী তবে সাচ্চা মুসলমান নয়? সাম্প্রদায়িকতা দানা বাধে মনে।
"কী গো তোমার ধ্যান করা শেষ হল?" মিষ্টি কণ্ঠে সুর আসে সালেহার।
ধড়ফড়িয়ে উঠে খালেকুজ্জামানের বুক। রাগ নেমেছে তবে সালেহার। পরম সুখি পুরুষ মনে হয় নিজেকে। মুহূর্তেই পৃথিবীর তাবৎ সাম্প্রদায়িকতা ছুড়ে ফেলে ছুটে যান প্রেমের ডাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৮ রাত ১০:৫৫