আমি বিছানায় বেশ আরাম করে আধশুয়া হয়ে আছি। বিছানা সিংহাসনের মত। দেয়ালে হেলান দিয়ে আধ শুয়া হয়ে বসার মাঝে রাজার হাল রাজার হালের মত লাগে। আমার কিছু টাকা ঋণ আছে তাই সম্পূর্ণ রাজা ভাবতে বিবেকে লাগে,ছোটকাল থেকে আমার বিবেক অনেক বড়। বড় বিবেকবান ব্যক্তিরা সামান্য জিনিসের জন্য নিচু হোন না,তাই সামান্য জিনিসের জন্য রাজা আর ভাবি না নিজেকে।
দেয়ালের দিকে চেয়ে থাকি। আমার মুখ হা হয়ে যায়। আম্মা আমাকে হাবলা বলতেন। বুদ্ধি কম!!
আমি নিজেকে দার্শনিক ভাবতাম তখন। নিজের এমন অপমান গায়ে মাখতাম না,সক্রেটিসকেও একসময় লোকে পাগল আর হাবলা ভাবত। নিজেকে সক্রেটিসের সাথে তুলনা করতে গিয়ে শরম লাগছে!
দেয়ালে একটি টিকটিকি দৌড়াদৌড়ি করছে। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য। আমি উপভোগ করতে থাকি।
আমার রুমমেট বেশ চিৎকার করে রম্বসের সংজ্ঞা মুখস্ত করছে। আমার মনযোগে তা বিরাট বাধা ফেলছে। বিরক্তিবোধ করে তার দিকে একবার তাকাই দেয়ালের দিকে একবার তাকাই। তার দিকে একবার। দেয়ালের দিকে একবার। এভাবেই চলে। আমি আবার দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রই; একযোগে। সব সাদাকালো লাগে। একটা পিঁপড়া আমায় কামড় দিল। জ্বালা অনুভব করে তাকে সুধালামা,"কামড় দিলি কেন ভাই?"
পিঁপড়া জবাব দেয়,"ওমন এক দৃষ্টিতে শয়তান টিকটিকির দিকে না চেয়ে পাশের বাসার রাশেদারে দেখলে ফল পেতে।"
আমার ইচ্ছা হল টিপে মেরে ফেলি। চেষ্টা দমিয়ে রাখলাম। জীব জগতের অতি তুচ্ছ প্রাণী হত্যার এখতিয়ারও আমার নেই।
পিঁপড়া ফেলে আবার টিকটিকির দিকে মন সংযোগ দিই। কিন্তু আমার রাশেদার কথা মনে পড়ে যায়। সেদিন শাড়ির ফাঁকে তার ফর্সা পেট দেখেছিলাম। ভাল লাগে ভাবতে আমার। তার পেটের রঙ টিকটিকির লেজের মত।
হায় যিশু!
টিকটিকি কোথায় যেন চলে গেল?
এদিক ওদিক তাকাতে ইচ্ছে করে না টিকটিকির খুঁজ করতে।
আমার ছোটকালের কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের মাঝে রেওয়ান ছিল টিকটিকির লেজ কাটা মানে তার মুসলমানি করানো। কে বা কারা সে প্রচলন করেছিল তা আবিস্কারে না গিয়ে আমরা মহা ধুমধামে লেজ কাটতে গিয়ে অশেষ নেকি হাসিলে লেগে পড়তাম।
অনেক পাপ করেছি। এবার নেকি লাভে টিকটিকির খুঁজ দরকার। আমি উঠে পড়তে গিয়ে দেখি রুমমেট তার লুঙ্গীর নিচে হাত ঢুকিয়ে কচলাচ্ছে। ঘন ঘন। সে তার ইচ্ছে হচ্ছে করুক।
আমাকে এসে আউয়াল ডাক দেয়। সে বুদ্ধিজীবী ধরণের মানুষ। তাকে দেখলে আমার বাংলাদেশের অসহায় বুদ্ধিজীবীদের কথা মনে পড়ে যায়। এখন বুদ্ধিজীবী বানান নিয়ে ভাবছি। আচ্ছা বুদ্ধিজীবী বানানে কয়টা দীর্ঘ-ঈ কার?
আউয়াল আমায় ডাকে।
'চলো মিয়া সিগারেট টানি। আজ দিনে কয়টা সিগারেট খাইলামই মাত্র।"
আমি বলি,"কয়টা খেলে?"
সে হাসে। আমি তার দাঁতের হলদে ভাব দেখি।
"মিয়া তুমি দেখি সাধারণ কথা বুঝো না,তোমার এই হইল দোষ। নরমাল জিনিসে প্যাচাল মারো।"
সে আবার হাসে। উদম গিতরে দুই হাত দিয়ে ঘষামাজা করে খালি যেন তৈল মর্দন করছে।
আমরা ছাতে যাই। সিড়িতে আধার। আউয়াল উষ্টা খায়। গালি দেয় বাড়িওয়ালারে। আমিও তারে খুশি করতে দুইটা গালি দিই। সে খুশি হয়। আউয়াল হাসে। তার হলদে দাঁত দেখা যায় না অন্ধকারে। আমি কল্পনা করে নিই।
"সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে ভিতরের কষ্টগুলা বেরিয়ে যায়" আউয়াল সিগারেট টানতে টানতে বলে।
আমার কোন কষ্ট নাই। বেরুবে কি করে?
"বুঝলা মিয়া জীবন হইল সিগারেটের মত। বাপ মা জন্ম দিয়া সেই সিগারেটে আগুন জ্বালায় দেয়। মাঝে মাঝে সেই জীবন থেকে কিছুটা পুড়ে ছাই হয়ে পড়ে। একসময় পুরোটাই ছাই হয়ে যায়। কেউ সেটকে নিয়ে বাঁচে কেউ না ছাড়াই বাঁচে।"
আউয়াল তার দর্শন আমারে দর্শায়। তার সিগারেটের আগুন নিভে গেছে, বেখেয়ালি হয়ে চেয়ে আছে অন্য দিকে। মুখে সিগারেট। তাকে দেখে আমার ভাল লাগে। মুগ্ধ হই।
তাকে জাগাতে ইচ্ছা হয় না।
আমি আস্তে আস্তে পা বাড়াই নিচের দিকে। অন্ধকারে উষ্টা খাই। গালি দিই বাড়িওয়ালাকে। তৃপ্তি বোধ করি। মেসে বুয়া দুই দিন বাদে এল। তার সাক্ষাতকার নেয়া উচিৎ। কি কি প্রশ্ন করব এবার খাতা কলমে লিখে ফেলতে হবে!
আজকাল কাজেরও এত চাপ!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৮