ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে ল্যাম্প পোস্টের কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অ্যাকশনঃ এএফপি
টিপাইমুখ বাঁধবিরোধী সংগ্রাম সফল হোক
মন্তব্য প্রতিবেদনঃ ফরহাদ মজহার
[আজ আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিশাবে প্রতিবাদ জানাবার জন্য এই দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত লেখাটি লিখছি।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে, এটা খুবই স্পষ্ট। ফারাক্কা বাঁধের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। এই দেশের জনগণ ‘কারবালা’ কথাটির অর্থ শুধু আক্ষরিক বা ঐতিহাসিক অর্থে বোঝে না। কেউ কাউকে পানিতে মারবার প্রচেষ্টার মধ্যে যে বীভৎস মানসিকতা কাজ করে তাকে বাংলাদেশের মানুষ কারবালার করুণ ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে ঘৃণা করতে শিখেছে। ফারাক্কা বাংলাদেশকে কারবালায় পরিণত করেছে। এই উপমহাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের ইমাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যখন ফারাক্কার লংমার্চ করেছিলেন তখন তিনি এই বীভৎসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। তিনি ভারত কিম্বা ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান নি, তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সেই সকল অপরিণামদর্শী নৃশংস মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে যারা মানুষ শুধু নয়, গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গসহ যা কিছু প্রাণ ও প্রাণ রক্ষার শর্ত তাকেই ধ্বংস করে ফেলতে উদ্যত। এই ধরনের মানবতাবিরোধী ভারতের শাসক শ্রেণীর মধ্যে যেমন আছে, তেমনি আছে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর মধ্যেও। উভয়েই পরস্পরের দোসর। এই ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে দুনিয়ার কোনো প্রাণেরই অস্তিত্ব থাকবে না। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষেও বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে।
ফারাক্কার অভিজ্ঞতা থাকার কারণে টিপাইমুখের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ক্ষোভ তীব্র হয়েছে। সেই ক্ষোভ আরো উত্যক্ত করেছে ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক চক্রবর্তীর উন্নাসিক মন্তব্য। তিনি শুধু কূটনৈতিক শিষ্টাচারই লঙ্ঘন করেন নি, উজান ও ভাটির দেশের জনগণের মধ্যে আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহ সংক্রান্ত নীতির প্রতি কটাক্ষ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, জোর যার মুল্লুক তার। ভারত বড় দেশ, ভারতের ক্ষমতা আছে, অতএব ভারত নদীর উজানে যা খুশি তাই করবে। কারণ তাচ্ছিল্যের ভাষায় বলেছেন, নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত কোনো আন্তর্জাতিক বিধান নাই। পিনাক চক্রবর্তীর ভাষা ব্যবহার ও অঙ্গভঙ্গির মধ্যে এই দেশের জনগণ সেই প্রাচীন চেহারাটাই দেখেছে ইতিহাসে যাকে তারা ‘এজিদ’ নামে চেনে।
গতকাল টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য ‘ল্যাম্প পোস্ট’ নামের একটি সংগঠন ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেছে। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। কারণ টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলে যারা ফেনা তুলছে তাদের কাউকে আমরা দেখলাম না, দেখলাম সেই সব তরুণদের যাদের আমরা চিনি না। বিরোধী দলের বিস্তর হৈ চৈ শুনেছি, কিন্তু অতি গর্জনে বর্ষা নামে না। বাংলাদেশকে পানিশূন্য করবার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার অধিকার যে কোন নাগরিকের রয়েছে। এই অখ্যাত ক্ষুদ্র তরুণদের দল প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছাই প্রকাশ করেছে মাত্র। অথচ টেলিভিশনে আমরা দেখেছি পুলিশ পিটিয়ে একজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। রক্তাক্ত ও ভয়ানক আহত সেই তরুণকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য ধস্তাধস্তি করছে কয়েকজন পুলিশ। একজন তরুণকে খালি গা করে ফেলেছে তারা, তার প্যান্ট নিয়ে কুৎসিত ভাবে টানাটানি চলছে।
মেয়েদের সঙ্গে হাতাহাতি করছে পুলিশ। তাদের ওপর নির্যাতনের যে ধরন দেখলাম তাতে লজ্জিত না হয়ে পারা যায় না। দেখে মনে হয়েছে আমরা একটি অসভ্য দেশে বাস করছি। আমার প্রতিবাদ এই অসভ্যতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ অচিরেই পানিশূন্য মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। যাদের এই বছরের গরম ও উত্তরবঙ্গের খরার অভিজ্ঞতা হয়েছে তারা জানেন আমরা সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যাচ্ছি। এর বিরুদ্ধে আমরা বিক্ষোভ জানাতে পারবো না? প্রতিবাদ করতে পারবো না? এটা কী?
টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের ওপর এই নৃশংস হামলার চরিত্র দেখে আমরা ক্ষমতাসীনদের চরিত্রও আঁচ করতে পারি। সরকার ভারতীয় হাইকমিশনারের নির্দেশে চলে কিনা জানি না, কিন্তু এই ঘটনার মধ্য দিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ ও সামগ্রিক ভাবে উজানের দেশ ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা প্রায় প্রতিটি নদীর বাঁধ দিয়ে ভারতের শাসক শ্রেণী বাংলাদেশের জনগণকে পানি থেকে বঞ্চিত করবার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তার বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন নতুন মাত্রা পাবে।
এর আগে বিডিআরের ঘটনায় ভারতীয়দের ভূমিকা আছে বলে লিফলেট দেওয়ায় একটি রাজনৈতিক দলে বিপুলসংখ্যক তরুণদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা এখনো কারাগারে। এদের অধিকাংশ মেধাবী ছাত্র। ভারত বন্ধু দেশ, তার নাকি সমালোচনা করা যাবে না। তাহলে তো এক শ’ জনের মধ্যে ৯০ জন বাংলাদেশীকেই কারাগারে আটক রাখাত হয়। যে কোন দল বা গোষ্ঠির রাজনীতি বা বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের বিরোধ থাকতে পারে, আমরা একমত না থাকতে পারি। কিন্তু নিজের মত প্রকাশের ও চিন্তা জানান দেবার স্বাধীনতা আছে প্রত্যেকেরই। কিন্তু ভারতের নোংরা দালালি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে পাঠক ভেবে দেখুন যে আমরা এখন ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বললে জেলে যেতে হবে? জেলে পচতে হবে। কোন জামিন ছাড়া। প্রতিবাদ জানালে পিটিয়ে আমাদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হবে। মেয়েদের নিয়ে পুলিশ টানাটানি করবে? বাংলাদেশের জনগণকে আজ এইসব সহ্য করতে হচ্ছে।
এই ক্ষেত্রে একটি বিষয় আমি পরিষ্কার করতে চাই। অতি সংকীর্ণ এবং সাম্প্রদায়িক ভারতবিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। ভারত কোন একাট্টা, শ্রেণীহীন জাত পাত বর্ণহীন দেশ নয়। বাংলাদেশে যেমন গরিব মানুষ আছে, ভারতেও আছে। বাংলাদেশে যেমন শ্রমিক আছে ভারতেও আছে। ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী বাংলাদেশের শাসক ও শোষক শ্রেণীর মতোই সমান মাত্রায় মুনাফাখোর, পরিবেশ ও জীবন বিরোধী এবং জনগণের শত্রু। শুধু একাত্তর সালেই বাংলাদেশের জনগণকে ভারতের জনগণ আশ্রয় দেয় নি, জীবিকার সন্ধানে দেশ ছেড়ে যারা ভারতে পাড়ি দিয়েছে এখনো মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতার গরিব জনগণ ও মজলুম শ্রমিকেরা বাংলাদেশের গরিবদের ঠাঁই দিতে কুণ্ঠা করে না। ভারতের নিপীড়িত ও শোষিত জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের অমিল খুব কম বরং মিলই বেশি। পাকিস্তানি শাসকরা যেমন আমাদের জাতিগত নিপীড়ন চালিয়েছে ভারতও কাশ্মির ও আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে আরো নৃশংস ও রক্তাক্ত কায়দায় ১৯৪৭ সাল থেকে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে আসছে। আজ যেখানে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করবার কথা উঠেছে সেই মনিপুরের জনগণই স্বাধীনতার জন্য ভারতের সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। মণিপুর, মিজোরাম, আসামের জনগণও টিপাইমুখের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ভারতের শোষক ও শাসক শ্রেণীর ভূমিকা রুখে দিতে হবে অবশ্যই, কিন্তু ভারতবিরোধিতার আড়ালে ভারতের শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের মৈত্রীর সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে দেবার রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে। ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী বাংলাদেশকে তাদের অধীনস্থ রাখতে পারছে বাংলাদেশের শাসক ও শোষকদের সহযোগিতায়। ফলে লড়াই উভয় দেশের শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে। শুধু ভারতের বিরুদ্ধে নয়। বাংলাদেশে ভারতের শাসক ও শোষকদের দালালদের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে বাংলাদেশকে কী করে রক্ষা করব আমরা? ফলে যাঁরা অতি সংকীর্ণ ভাবে ফারাক্কা বা টিপাইমুখের বিরোধিতা করতে গিয়ে ভারতবিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পাঁকে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে পতিত হচ্ছেন তাঁদের ঠিক পথ দেখানো আমাদের কাজ। মনে রাখা দরকার ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী ঠিক যে অর্থে আমাদের বন্ধু নয়, বাংলাদেশের শাসক ও শোষক শ্রেণীও ঠিক সেই অর্থেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের রক্ষক নয়।
যে সংগঠনটি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করেছে তারা সস্তা ভারতবিরোধিতার রাজনীতি করছে না সেটা তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট। তারা বলছে, ভারতরাষ্ট্রের সম্প্রসারণবাদী নীতি যে শুধু আমাদের দেশের জনগণের জীবন নিয়ে খেলছে তা নয়, খেলছে ভারতের জনগণকে নিয়েও। খোদ টিপাইমুখ বাঁধ-ই তার প্রমাণ। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে মনিপুরের জনগণের আন্দোলনকেও দমন নিপীড়নের মাধ্যমে খামোশ করে দেবার চেষ্টা চলছে। আর আমরা তো চোখের সামনেই দেখছি লালগড়ে নিজ দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ভারত কিভাবে নিজের পুলিশ বাহিনী ও সশস্ত্র ব্যাটালিয়ান লেলিয়ে দিয়েছে।
সম্ভবত টিপাইমুখ ও পানির ওপর জনগণ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, জলজ প্রাণীর অধিকার আদায়ের লড়াই উপমহাদেশে নতুন বিপ্লবী রাজনীতির সূচনা করবে। যার খানিক ইশারা আমরা মওলানা ভাসানীর ফারাক্কার বিরুদ্ধে লংমার্চে দেখেছিলাম। মওলানার পরিবেশ আন্দোলনকে নিছকই ‘আধুনিক’ পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। তিনি জানতেন ‘আধুনিকতা’ ও ‘সাম্রাজ্যবাদ’ সমার্থক। তিনি তাঁর আন্দোলনকে বরং আরো গভীর আন্তরিক তাগিদ ও সৃষ্টির প্রতি গভীর মমতা ও ভালবাসার ওপর প্রতিষ্ঠিত করবার শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন। তাঁর ভাষায় এর নাম ‘রবুবিয়াত’ বা বিশ্বপালনকর্তার স্বভাব আয়ত্ত করে প্রাণ, প্রাণের শর্ত ও পরিবেশ রক্ষা করা। পানির ওপর শুধু মানুষের ‘হক’ নাই প্রতিটি প্রাণীর প্রতিটি তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রাণীটিরও ‘হক’ আছে। সেই হক আদায় করার মধ্যদিয়েই মানুষ দীন বা ধর্মের পথে কামিয়াব হয়।
টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে যাঁরা আহত ও নির্যাতিত হয়েছে, তাঁদের প্রতি আমার সংহতি ও সমবেদনা। নিন্দা করি জালিমদের এবং একই সঙ্গে তাদের করুণাও করি বটে কারণ বধির তারা। তাদের ধ্বংসের ঘণ্টা বেজে উঠেছে যার আওয়াজ তাদের কানে এখনো প্রবেশ করে নি।
২২ আষাঢ় ১৪১৬। ৬ জুলাই ২০০৯।