নীল তেরপলের এলোমেলো ভাঁজে অল্প একটু বৃষ্টির পানি জমে আছে। পানি একটু বাড়লেই একপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। তারপর আবার কিছুক্ষণ জমতে থাকে। আবার গড়িয়ে পড়ে। তেরপলের উপর দীর্ঘ গ্রীষ্মের জমে থাকা ধুলো। বৃষ্টির পানির নাচনে তার কিছু কিছু ধুয়ে গিয়ে এক অদ্ভূত নকশা তৈরি করেছে। পরী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
হাতিরপুল বাজারের ঠিক পেছনে পরীদের ঘর। নীল তেরপলের ছাউনি, পেছনে পাওয়ারবোর্ডের ময়লাটে হলুদ দেয়াল। মা-মেয়ে মিলে মাথা গোজার ঠাঁইটুকু এখানেই। বৃষ্টিদিনে একটু কষ্ট হয়ে যায়। এই যেমন আজকে। পরীর মা সবে কাজে বের হয়েছিল। এমন সময় আকাশ আঁধার করে বৃষ্টি। সে কি বৃষ্টি! এক হাত দূরের সব ঝাপসা হয়ে গিয়েছে যেন। দ্রুতপায়ে হাসিনা বানু ঘরে ফেরত আসলো। মেয়েটার জ্বর বেশ কয়েকদিন ধরে। তার মধ্যে এরকম বৃষ্টি।
তেরপলের এদিকে সেদিকে ফুটো। ফুটো বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। বিছানা ভিজে যাচ্ছিল, তবে সেদিকে পরীর খেয়াল ছিল না, মুগ্ধ হয়ে সে বৃষ্টি দেখছিল। মনে মনে কবিতা আওড়াচ্ছিল,
আয় বৃষ্টি ঝেপে
ধান দেব মেপে,
লেবুর পাতা করমচা
যা বৃষ্টি ঝরে যা...
বৃষ্টি ঝরে যা... বলতে না বলতেই ত্রস্তপায়ে মা ফেরত এলো।
"হায় রে মরা, বৃষ্টিতে পুরা ঘর ভাইসা গেল আর তুই শুইয়া শুইয়া তামশা দেখতাছস? একটু ডেকচিটা পাইতা পানিটা ধরলে কি হাত ক্ষয় হইয়া যাইতো নি তোর? হাড়-কইলজা কালা করলি আমার"-- হড়বড় করে পরীকে ঝাড়তে ঝাড়তেই হাড়ি-পাতিল বের করে বৃষ্টির পানি ধরতে লাগলেন। তারপরে যেন নিজের অদৃষ্টকেই গাল দিতে বসলেন। পরী বড় বড় চোখ মেলে চুপ করে শুয়ে রইলো। কিছুই বললো না। আস্তে আস্তে হাসিনা বানুর গলার তেজ কমে এল। নিজ মনে শুধু বিড়বিড় করে চললো। বৃষ্টির তেজ তখনো কমেনি।
এমন সময় পরী বলে উঠলো,--মা, ভাত খামু।
হাসিনা বানু পরীর দিকে পিঠ দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিল, আর অপেক্ষায় ছিল কখন বৃষ্টি কমবে। আজও যদি কাজে যেতে দেরি হয়, তাহলে খাইসটা বেটীর হাউকাউয়ে টেকা যাবে না। তিন তিনটা বাসায় দৌড়ের উপর ছুটা বুয়ার কাজ করতে করতে হাড়-কইলজা এক হয়ে গেল। কতো আশা করছিল, মা-মেয়ে মিলে বাসায় বাসায় কাজ করে ঘর-দোরটা একটু ঠিক করবে, তা না! মেয়েটা সারাদিন জ্বর-জ্বারি বাঁধাইয়া বইসা থাকে। এইসব ভাবতে ভাবতে যখন নিজের অদৃষ্টকেই গাল দিচ্ছিল, তখনি পরী বলে উঠলো, "মা, ভাত খামু।"
ঘুরে চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো পরীর মা,"তোরে যেন ভাত খাওয়াই না?"
আস্তে আস্তে পরী জবাব দিল, "আরেকজনের আইডা ভাত না...গরম ভাত খামু।"
হঠাৎ রাগে যেন কান্ডজ্ঞান হারালো পরীর মা, ছুটে এসে অসুস্থ মেয়ের পিঠে ধুরুম ধারুম কিল বসিয়ে দিল, "ইহহ... নবাবের বেটি আইসে গরম ভাত খাইবো। কামে যাইবো না, ঘরে শুইয়া শুইয়া চান-তারা দেখবো আর হের লইগ্যা আমি আসমান থিকা গরম ভাত পাইড়া আনমু। কপালও আমার...এমুন মাইয়া জুটাইছে..." , বলতে বলতে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হাসিনা বানু। বৃষ্টির জোরকে পাত্তা না দিয়ে হনহনিয়ে হাঁটতে লাগলো। পরীর শান্ত চোখ দিয়ে শুধু কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়লো নীরবে...
আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছিল। তার মাঝে হনহনিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসিনা বানুর হঠাৎ ওঠা রাগটা আস্তে আস্তে পড়ে গেল। হু হু করে কাঁদতে লাগলো আঁচলে মুখে চেপে। আর নির্জন পথটা বেয়ে দ্রুতবেগে হেঁটে চললো। অসুস্থ মেয়েটা অনেকদিন ধরে ভাত খেতে চাইছে। চালের যা দাম...এই বাজারে গরম ভাত কি সোজা কথা? বাসায় বাসায় কাজ করে এঁটো-ঝুটা যা পারে নিয়ে আসে, তাই দিয়েই চলতে হয়। মাস শেষের বেতন তো পাড়ার ছোকরাদের চান্দা দিতেই চলে যায়। দুটা ভালো মন্দ খাবার সুযোগ কই? মেয়েটা এখনও এইসব বুঝতে চায় না...আর কবে বুঝবে? এতো বয়স হইছে...এখনো বোকার মতো গরম ভাতের আব্দার করে। বৃষ্টির সাথে সাথে হাসিনা বানুর কান্নার বেগও বাড়তে লাগলো। আর কেমন করে যেন ভুখা মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া হলো।
খুব খিদে পেলে আগে খুব কষ্ট হতো পরীর। এখন খিদে ভুলে থাকার বুদ্ধি বের করেছে। কখনো কখনো আকাশের মেঘ গণে। একেকটা মেঘ দেখতে একেক রকম। কোনোটা দেখতে যেন তিন ঠ্যাংওয়ালা মানুষের মতো, কোনোটা আবার যেন চার চাকার গাড়ি। মাঝে মাঝে পরী তেরপলের ফুটো দিয়ে উঁকি দেয়া আলোর নকশা দেখে। ফ্রি স্কুলে ছোটবেলা বেশ কয়েকটা ছড়া শিখেছিল...তার অল্প কিছুই মনে পড়ে ইদানিং। মাঝে মাঝে ভুলে যাওয়া ছড়াগুলো মনে করার চেষ্টা করে। এমনি করে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধ্যে হলে মা ঝুটা-বাসি খাবার নিয়ে আসে...এভাবেই দিনগুলো এক এক করে কেটে যায় পরীর।
আজ কতোদিন হলো... গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত চোখেই দেখে না পরী! দুপুরের এ ঝুম বৃষ্টিতে বেশ ঘুম ঘুম ভাব হতে লাগলো পরীর...কল্পনাতে ভাতের ঘ্রাণ নিতে নিতেই ঘুমিয়ে পড়লো।
বৃষ্টিতে ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে শাড়ি। ঠিক করতে করতে কলিংবেল চাপলো হাসিনা বানু। বৃষ্টির জন্য আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে। বেগম সাহেব চিল্লচিল্লি শুরু না করলেই হয় এখন। মেজাজ মর্জি ভাল থাকলে গরম ভাত হয়তো চাওয়া যেত...রান্নাঘরে সাহবেবাবুদের জন্য ভাত রান্না করতে গেলেই তার নিজের মেয়েটার কথা মনে পড়ে।
দরজা খুললো সাহেব। ঘোমটা মাথায় দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সাহেব বলে উঠলো, "তোমার বেগম সাহেব তো আজকে নাই। রাত হবে আসতে।"
মনে মনে হাসিনা বানু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। মুখে বললো, "কি রানতে হইবো কইয়া গেছে?"
"রাঁধো তোমার যা খুশি।"
দ্রুতপায়ে রান্নাঘরের দিকে গেল হাসিনা বানু আর পটু হাতে নিত্যিদিনের খুটখাট শুরু করে দিল। বেগম সাহেব আসার আগেই রান্না শেষ করে বাড়ি ফেরার চিন্তা করতে লাগলো। সাহেবকে বলে দেখবে, যদি গরম দুইটা ভাত দেয়। সাহেব হয়তো বেগম সাহেবের মতো খাইস্টা হবে না। এইসব ভাবতে ভাবতে হাত চালাচ্ছিল, হঠাৎ খুট শব্দে ঘুরে তাকালো। রান্নাঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে সাহেব ঘুরে দাঁড়ালো। পুরো ব্যাপারটা আঁচ করতে কয়েকটা মুহূর্ত লাগলো হাসিনা বানুর। চিৎকার করতে যাবে, ওমনি সাহেব ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর। মুখ জাবড়ে ধরে সাহেব ওর চোখের সামনে কয়েকটা লাল নোট দুলালো। কতো হবে? ৫০? ১০০? চোখ ফেটে পানি বের হলো হাসিনা বানুর। এক পলকের জন্য ভুখা মেয়েটার কথাও মনে হলো। তারপর আর জোরাজুরি করলো না, কোনো শব্দও করলো না। শব্দ করলো শুধু জানালার শার্শিতে আছড়ে পড়া রাগী বৃষ্টির ফোঁটা।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সত্যিকারের গন্ধে পরীর ঘুম ভাংলো ।