১.
গম্ভীরমুখে বড়দের মতো করে পা নাচাতে লাগলো তপু। স্কুলের পেছনেই রায়বাহাদুরদের বাগানবাড়ি। সে বাগানবাড়ির এক কোণায় কিছুটা নির্জনমতো জায়গা। বাগানবাড়ির সে কোণার দেয়ালে আমরা বসে আছি। আমরা মানে তপু বসে আছে, তপুর পাশে আমিও বসে আছি। দুপা দুদিকে ঝুলিয়ে, হাতে ডাসা পেয়ারা। দেয়াল ঘেষেই আমগাছের মগডালটা। তাতে বসে আছে রঞ্জু, নির্বিকার মুখে ওর ভোতা ছুরিটা দিয়ে পেয়ারা কাটার চেষ্টা করে যাচ্ছে। গাছের গোড়ায় বসা নাহিন শুকনো মুখে ঘাস চিবুচ্ছিল।
এরকম এক সময়ে হঠাৎ করেই যেন বোমা ফাটালো তপু, “ আমি ঠিক করেছি বাড়ি ছেড়ে পালাবো”। আমি চমকে তপুর দিকে তাকালাম। কথাটা বাতাসে ছেড়ে দিয়েই তপু আবার নির্বিকার পা দোলাতে লাগলো। রঞ্জু নাহিন একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তপুর দিকে তাকালো, কিন্তু কিছু বললো না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সত্যি পালাবি?”
“নাহ, মিথ্যামিথ্যি পালাবো”, তড়িৎ জবাব তপুর।
আমি একটু ধাঁধায় পড়ে গেলাম, বুঝলাম না সলে সত্যিই পালাবে নাকি আমাকে বোকা বানাচ্ছে! তাই বোকার মতো আবার জিজ্ঞেস করে বসলাম, “সত্যি?”
তপু চোখ পাকিয়ে তাকালো, ও কিছু বলার আগেই রঞ্জু ঝাড়ি মেরে বললো, “চুপ থাক হাঁদারাম”।
নাহিন আগের চাইতেও গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ কবে পালাবি?”
“আজ রাতে”, তপু জবাব দিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “একা একা পালাবি, হারিয়ে যাবি নাতো?” নাহিন হতাশ দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তাকালো, একবার রঞ্জুর দিকে। রঞ্জু ভুরু কুঁচকে আমার দিকে দুপা এগিয়ে এলো। আমি একটু সরে বসলাম, বলা যায় না! ঘুষি বাগিয়ে বসতে পারে!
নাহিন জিজ্ঞেস করলো, “কই যাবি ঠিক করছস?”
“ঢাকা”।
উত্তেজিত স্বরে রঞ্জু জিজ্ঞেস করলো, “ঢাকা মানে! ঢাকায় কই যাবি? কি করবি?”
তপু একটু হাসলো, “ ভাবছি এখানে থেকে আর কি হবে? এইসব ইস্কুল-টিস্কুল আর আমাকে দিয়ে হবে না। যেটা ভালো পারি, সেটাই করবো”।
নাহিন জিজ্ঞেস করলো, “মানে ফুটবল খেলবি?”
“হুমম”।
“ঢাকায় তোকে কে দলে নিবে? জানিস ওখানে কতো ভালো ভালো খেলোয়াড়?”
আমি বাদ সাধলাম, “আমাদের তপু কি কম ভালো খেলে? তোদের মনে নাই গ্রীন বয়েজকে কিভাবে হারালো?”
তপু যেন আমার কথায় একটু আশা পেল, রঞ্জু সে আশায় জল ঢেলে দিল।
“গ্রীন বয়েজ আর ঢাকার কোনো দল এক কথা না”, বললো রঞ্জু, “গ্রীন বয়েজ এখানকার মামুলি এক দল, আর ঢাকায় কতো বড় বড় ক্লাব!”
রঞ্জুর কথায় তপু চুপ মেরে গেল, কিন্তু আমি কিছুতেই মানতে পারলাম না। আমাদের তপুর চাইতে কেউ ভালো খেলতে পারে সেটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। এই তো কয়েকদিন আগেরই কথা। আমাদের থানা সদরের গতবারের চ্যম্পিয়ন গ্রীন বয়েজকে ১-০তে হারালাম। সেই একটা গোল তপুর করা। আমরা তো বটেই, এই থানা সদরের কেউ এমনকি গ্রীন বয়েজের কোচও জীবনে কর্ণার থেকে সরাসরি গোল দেখেনি। এরকম গোল যে দিতে পারে, সে নিঃসন্দেহে ঢাকার সবার চাইতে ভালো খেলে, এমনটাই আমার বিশ্বাস।
আমার একটু মন খারাপও হল। তপু চলে গেলে আমাদের আগ্রবাদ স্পোর্টিং ক্লাবটা আবার আগের মতো হারু পার্টি হয়ে যাবে। সেই পুরানো দৃশ্য...প্রতি ম্যাচে হালি গোল, তারপর কলোনির এ বারান্দা ও বারান্দা থেকে টিটকারি। নচ্ছাড় মেয়েগুলো তো বলেই বসবে, “ফুটবল যেন কি দিয়ে খেলে রে? হাত দিয়ে?” তারপর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে। তপু কলোনিতে আসার পর সব পালটে গিয়েছিল। কলোনিতে আমরা সবাই মোটামুটি হিরো হয়ে গিয়েছিলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুই চলে গেলে আমাদের আগ্রাবাদ স্পোর্টিং এর কি হবে?”
রঞ্জু, নাহিন সবারই একথায় একটু যেন মন খারাপ হলো। তপুও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর ধীর গলায় বললো, “তোরা আছিস না?”
আমি একটু হেসে বললাম, “আর আমরা!”
তারপর সবাই চুপ হয়ে গেলাম। কেউ যেন কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না।
নাহিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো, “তোর বাবা জানে? মা?”
মাথা নাড়লো তপু, কেউ জানে না।
“তোর নতুন মা-টা কি খুব খারাপ রে?”
তপু চুপ করে রইলো। কিছু বললো না। আমার কেন যেন মনে হল ওর গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি পড়লো। অন্ধকারে খুব ভালো বোঝা গেল না।
সেদিন সন্ধ্যায় তপুর খোঁজে আমাদের সবার বাসায় তপুর বাবা এল। সকাল হতেই কলোনির প্রতি বাসা জেনে গেল তপুর হারিয়ে যাওয়ার গল্প। দুপুরের মধ্যে পুরো থানা সদর। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তপুকে। ব্যস, তপু হারিয়ে গেল!
তপুর হারিয়ে যাবার পর কিছুদিন আমরা বেশ মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ালাম। মাঝে মাঝে আমি বাগানবাড়ির দেয়ালে বসে তপুর মতো করে পা দুলাতাম। রঞ্জুও মাঝে মাঝে আমার পাশে বসতো, কিসব যেন ভাবতো। আমাদের আর ফুটবল খেলা হলো না। কলোনির খালি মাঠটায় শুয়ে আমরা ঘাসের ডগা চিবুতাম, চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশে মেঘের খেলা দেখতাম। মাঝে মাঝে দুয়েকটা মেঘ দেখতে কেন যেন তপুর মতো মনে হতো, সেকথা বললে রঞ্জুও আর ঘুষি বাগিয়ে আসতো না। তপুর হারিয়ে যাবার পর আমাদের কারো আর হালি গোল খাবার শখ হলো না। আগ্রাবাদ স্পোর্টিং ক্লাব লেখা রঙ্গিন কাগজটাও আমাদের নাকের ডগায় ব্যঙ্গ হয়ে বেশিদিন টিকে থাকলো না। খুব কায়দা করে রঙ্গিন কালিতে নামটা লিখেছিল তপু, বৃষ্টিতে সে রঙ ধুয়ে গেল। এমনি করে তপুর সাথে সাথে আমাদের রঙচঙা শৈশবটাও বুঝি হারিয়ে গেল।
২.
নানা ছুতো করে অফিস থেকে আজ একটু আগেভাগেই বেরুলাম। তবু ফ্যাক্টরি থেকে ঢাকা পৌঁছতেই সন্ধ্যা নেমে এল। অহনার জন্মদিন, বেচারির কোনো জন্মদিনেই থাকতে পারি না। কতোবার রেগেমেগে ভেবেছি, ফ্যাক্টরির চাকরি ছেড়েই দিব! ছাড়া আর হলো কই? এই বাজারে আরেকটা চাকরি ধরা সোজা কথা না। এইসব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতেই অহনার জন্য খুব সুন্দর একটা মোবাইল কিনে ফেললাম। এই একটা গিফট দেব বলে তিন মাস ধরে টাকা জমাচ্ছিলাম। উপহার হাতে পেয়ে অহনার কিরকম খুশি হতে পারে ভাবতেই আমার সন্ধ্যাটা অন্যরকম মনে হতে লাগলো। এই জ্যাম, কালো ধোঁয়ার নগরী...কিছুই যেন আমাকে ছুঁতে পারছে না। সন্ধ্যে পেরিয়ে মাঝরাত্তিরের দিকে হেলে যাচ্ছে শহর...তবুও মনে হতে লাগলো, the night’s still young!
রিকশা সেগুনবাগিচার মোড় থেকে বাসার গলিতে ঢুকতেই হঠাৎ ব্রেক কষলো। আমিও যেন বাস্তবে ফিরে এলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার গলি, মিউনিসিপিলিটির বাতির কোনো খোঁজখবর নেই। অন্ধকার ফুড়ে দুজন মুশকো জোয়ান পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে! একজনের হাতে ধারালো একটা ফলা চিকচিক করে উঠলো। পেটের কাছে ঠেকিয়ে ধমকে উঠলো, “যা আছে বের করা শালা ***” । আমার মধ্যে কি ভর করলো কে জানে, আমিও হাত থেকে মোবাইলের প্যাকেটটা ছাড়লাম না। ওপাশ থেকে আরেকজন হ্যাচকা টানে প্যাকেটটা কেড়ে নিল। আমি চিৎকার করতে গেলাম, তা-ই দেখে ছুরি ঠেকানো গুন্ডাটা পাজর বরাবর সজোরে ফাঁসিয়ে দিল ছুরিটা। তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগলো। আমি ক্ষত বরাবর হাত চেপে ধরে কাতরাতে লাগলাম। এরকম সময়ে হঠাৎ বিদ্যুত চলে এল। রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠলো। মোবাইলের প্যাকেট হাতে গুন্ডাটা দৌড়ে পালালো। শুধু ছুরি হাতের গুন্ডা অদ্ভূত চোখে তাকিয়ে রইলো। আমিও অবাক হয়ে তাকালাম। সেই বিষাদমাখা চোখ... সেই তপু!