১.
ভীষণ ভার ভার লাগছিল মাথাটা। এলিয়ে পড়াতেই শান্তি, তবু মাথাটা তুলতেই হলো। শরীরের সব শক্তি এক করে মাথাটা তুললাম। অচেনা কোনো জায়গায় আছি, তবে কোথায় বুঝতে পারছি না। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরটা। শুধু ময়লাটে একটা হলদে বাল্ব জ্বলছিল মাথার উপর। আলোর চাইতে তা অন্ধকারই বেশি ছড়াচ্ছিল, ঘোলা ঘোলা চোখে অন্তত তা-ই মনে হলো। কাঠের চেয়ার, তার আবার একটা হাতল ভাঙ্গা। পায়াটাও নড়বড়ে, একটু নড়তেই ক্যাঁচকোঁচ করে উঠলো। ভীষণ ভারভার মাথাটা একটু ঘুরিয়ে পুরো ঘরটা দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। বন করে মাথাটা আরেকবার চক্কর মেরে উঠলো। মনে হলো যেন আবার জ্ঞান হারাচ্ছি। টেবিলে ঢলে পড়লাম। ঢলে পড়ার আগে শেষ মুহূর্তের হঠাৎ ঝলকে জিনিসটা চোখে পড়লো। একটা তর্জনী! একলা পড়ে আছে ধূলোমাখা টেবিলে। সাথে মধ্যমা নেই। অনামিকাটাও নেই। কেনে আঙুলটাই বা কোথায় কে জানে! জ্ঞান হারালাম ... ... তার আগে নিজের আঙুলগুলো গুনে দেখার অবসর হলো না।
২.
ইছামতি নদী। সে নদীর ধারেই গ্রামটা। ইছামতি মরে গেছে তাও বহুত দিন হলো। বর্ষায়ও এখন আর এর রক্তচক্ষু দেখা যায় না। ভীষণ রকম স্রোত নেই। শান্ত ঢেউ খেলা করে মাঝে সাঝে। তাই তেলকালি ছড়িয়ে ইছামতির বুক চিরে লঞ্চ স্টিমার আর চলে না। শান্ত নদীটার ধারেই তার চাইতেও শান্ত গ্রামটা। হলুদে হলুদ একটা গ্রাম। অবারিত সর্ষে ক্ষেত। দুচোখ যতোদূরে যায় শুধুই হলুদ। তার মাঝে মাঝে হঠাৎ এক ফালি সবুজ যেন মানুষের বসতির কথা মনে করিয়ে দেয়। বিকেলের যে মিঠেল হাওয়া নদীতে একটু স্রোত খেলিয়ে যায়, সে হাওয়ায় একটা বিশাল হলুদ ঘুড়ি ভাসছিল একদিন। মনে হয়েছিল যেন সর্ষের হলুদ আকাশে ছড়িয়ে গেছে। এগার-বার বছরের কিশোর একটা ছেলে নাটাই হাতে ছুটে চলছিল সর্ষে ক্ষেতের আল বেয়ে। আঙুলে তার সুতো প্যাঁচানো। কখনো কখনো দুএকবার আলপটকা টানে ঘুড়িটাকে তেড়িয়া করে ছুটাচ্ছিল, মেঘেদের সাথে কাটাকুটি খেলছিল।
সেই বিকেলে হঠাৎ করেই সর্ষে ক্ষেতের মাঝের সবুজ মনুষ্যবসতি সর্ষের রঙে হলুদ হয়ে উঠলো। আগুন জ্বলে উঠেছিল ...সর্ষে রঙ্গা হলুদের আগুনে ক্ষেত আর শান্ত সে ঘরগুলো একরঙা হয়ে গিয়েছিল...বিধাতারই কৌতুক বোধহয়। দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল ছাড়াছাড়া গুলির আওয়াজ। আল বেয়ে ছুটে চলা কিশোরটা হঠাৎ গুলি খেয়ে উপুড় হয়ে পড়লো। তার হলদে ঘুড়িটা তখনো মেঘেদের সাথে উড়ছিল।
৩.
আতংকের একটা পর্যায়ে মানুষ তার স্রষ্টাকে ডাকতেও ভুলে যায়। মেজর খুরশীদ সেরকম আতংকে বিহ্বল হয়ে গেল। বিস্ময়ে হাঁ করা মুখটা বন্ধ করার কথা মনে রইলো না। ঘরের উপস্থিত সৈন্যরাও বিস্ফারিত নয়নে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ আগেও তারা বিজাতীয় ভাষায় প্রার্থনা করছিল। আস্তে আস্তে তাদের সব গুঞ্জন বন্ধ হয়ে এল। অস্বস্তিকর নীরব সে ঘরে টেবিলে মাথা এলিয়ে পড়ে আছে কিশোর ছেলেটা। হাতের কাটা অংশ থেকে তখনো রক্ত ঝরছিল, আঙ্গুল কাটা সে রক্তে টেবিল লাল। সে রক্তের মাঝেই কাটা তর্জনীটা টেবিলে একটু একটু করে লাফিয়ে উঠলো। নাচের ভঙ্গিমায় কড়া বাঁকিয়ে নড়তে লাগলো... ... ধীরে ধীরে যেন নাটাইয়ের সুতা ছাড়ছে। আতংকে দুড়দাড় করে সেনারা ঘর ছেড়ে পালাতে লাগলো। মেজর খুরশীদ শুধু ফ্যাকাশে মুখে বিস্ফারিত নয়নে বসে রইলেন.........
একাত্তরে ইছামতি পাড়ের বিনোদপুর গ্রামে এক অদ্ভূত ঘটনা ঘটেছিল। পুরো গ্রাম পরিকল্পনামাফিক দখলে নেবার পর হঠাৎ করেই ৩৫ খানসেনা নিখোঁজ হয়ে যায়। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৬