১.
রোদ্দুর! উফফ...কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এই একটা শব্দ মাথায় বেশ বাজেভাবে আটকে গেছে। রাগে যেন গা কাঁপছে। এটাকেই কি রাইটার্স ব্লক বলে নাকি? বিরক্ত হয়ে সামনের খাতাটা এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে দিলেন জামাল সাহেব।
খাতা কলম ছুড়ে ফেলার আওয়াজ এমন ভয়াবহ কিছু না যে নার্গিস আরাকে রান্নাঘর হতে হুড়মুড় করে ছুটে আসতে হবে। কিন্তু ছুড়ে ফেলা খাতার উপরে যদি পেপারওয়েট নামক বস্তুটা থাকে, তা অবশ্যই আওয়াজের হিসাবে কম কিছু নয়। জামাল সাহেবের লেখার ঘরে ঢুকে এক পলকে আশপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিলেন। স্ত্রীর চাহনি অনুসরণ করে জামাল সাহেবও তার সাম্প্রতিক কীর্তির উপর নজর বুলিয়ে নিলেন। অতঃপর শুরু হলো বাজখাঁই কন্ঠে স্ত্রীর নিত্যদিনের সা-রে-গা-মা, “কি হয়েছে তোমার? তোমার জ্বালাতে তো ঘরে থাকা যাবে না! দুই মিনিট আগেই না তোমার ঘর পরিষ্কার করে গেলাম? এর মধ্যেই কাগজ-কলম ছিড়ে-ছুঁড়ে দোযখ বানায় রাখছো?”
দুই মিনিট না ছাই! দুই ঘন্টা ধরে এই এক রোদ্দুরের গল্প লেখবো ভেবে একদিস্তা কাগজ শেষ করলাম, আর উনি এখনো দুই মিনিটেই পড়ে আছেন--মনে মনে ভাবলেন জামাল সাহেব। মুখে অবশ্য কিছু বলার সাহস করলেন না। গিন্নির সা-রে-গা-মা তখনো চলছিলো, “বলো! আমি কি শুধু তোমার ঘরই গুছাবো, নাকি রান্না-বান্নাও কিছু করবো?” জামাল সাহেব চুপ করেই রইলেন। দুই নম্বর সতর্কীকরণ সংকেত চলছে, মুখ খুললে তা বারো নম্বর মহাবিপদ সংকেতে রূপ নিতে পারে। এদিকে উনার চুপ করে থাকাতে স্ত্রী যেন আরো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, “কি হলো? এখন চুপ কেন? বলো...ঘর ভর্তি করে কাগজ ছিড়েছো কেন?” কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে উত্তরের অপেক্ষায়। মিনমিনে কন্ঠে জামাল সাহেব জবাব দিলেন, “ইয়ে মানে, হয়েছে কি... একটা শব্দ আছে,মানে আর কি... ওই রোদ্দুর শব্দটা মাথায় আটকে গেছে। আর কিছু ভাবতেও পারছি না! রোদ্দুর নিয়েও লেখা আগাতে পারছি না।” বলেই বোকার মত হাসি দিলেন, যদি তাতে স্ত্রীর রাগ গলে। নার্গিস আরা রাগ ধরে রাখার চেষ্টা করেও খুব একটা পারলেন না, আস্তে আস্তে বললেন, “ঘরের দরজা-জানলা লাগিয়ে, পর্দা টাঙ্গিয়ে ঘর আন্ধার করে তুমি রোদ্দুরের গল্প লেখবা? ছাদে যেয়ে রোদ্দুরের গল্প লেখ”, একটু বিরতি দিয়ে কৃত্তিম ঝাঁঝের সাথে বললো, “আর আমাকেও একটু শান্তি দাও।” কথাগুলো বলতে যা দেরি, জামাল সাহেব সাথে সাথে হাঁটা দিলেন ছাদের দিকে...
২.
গিন্নি অবশ্য বুদ্ধি খারাপ দেননি, ভাবলেন জামাল সাহেব, ছাদে গিয়ে যদি রোদ্দুরের গল্প লেখার আইডিয়া পাওয়া যায় তো মন্দ কি! অবশ্য মূর্খ মেয়েলোকের এই এক সমস্যা...রোদ্দুরের গল্প লেখতে কি লেখককে রৌদ্রের মধ্যে বসে থাকা লাগবে? কেন, সে কি বিয়ের আগেই বিয়ের গল্প লেখে নাই? নারী জাতির বুদ্ধির কমতি নিয়েও কিছু একটা লেখতে হবে, কমসে কম এই টপিকে লেখতে তার আইডিয়ার অভাব হবে না, এইসব ভেবে বেশ খুশি খুশি লাগতে লাগলো।
লেখালেখির বেলায় এই বাজে স্বভাবটা আছে জামাল সাহেবের, একবার কোনো একটা শব্দ অথবা কথা মাথায় বিঁধে গেলে আর কিছু লেখতে পারেন না, যতোক্ষণ না ওই শব্দ নিয়ে একটা লেখা নামাতে পারেন। চব্বিশ ঘন্টা দিন-রাত ঐ এক শব্দ মাথায় ঘুরে। এখন যেমন রোদ্দুর দশা চলছে। সেদিন গাড়ি চালাতে চালাতে এফ.এম. রেডিও অন করেছিলেন, কোন এক গানের লিরিকসে রোদ্দুর শব্দটা ছিল। তার মাথায় যেন ঝংকারের মতো বেজে উঠলো শব্দটা, নিজের মনেই ভাবলেন, বাহ! বেশ কাব্যিক ভাব আছে শব্দটায়! রোদ্দুরের একটা গল্প লেখতে হবে। তার পর থেকে গত দুইদিন ধরে এই এক শব্দ তার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।
ছাদে অবশ্য বেজায় রোদ, চৈত্রের "ঠাডা রোদ" যাকে বলে। মাথার খুলি ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে। খুলির কড়াইয়ে যেন মগজ সিদ্ধ হচ্ছে। তবে যার জন্য এতো সাধনা সেই প্লট আর ধরা দিচ্ছে কই! উত্তর দিকের হলুদ বাড়িটার পাশের চুনকাম ছাড়া তিনতলা বাড়িটা রহমান সাহেবের না? হুমম, তাই তো। নিজের মনেই ভাবলেন জামাল সাহেব। ছাদের পানির ট্যাংকির চিপায় বেশ রঙ্গলীলা চলছে, রহমান সাহেবের মেয়েটা কোন এক ছেলের সাথে বেশ লুকোচুরি ভাব নিয়ে কথা বলছে, হাতে হাত রেখেছে নাকি? নিজের যৌবনকালের কথাও বেশ মনে পড়লো দেখতে দেখতে ... আচ্ছা! এইটা নিয়ে কি রোদ্দুরের গল্প হতে পারে? নাহ...এই মেয়ে নিশ্চয়ই বিকাল বেলা আরেক ছেলের সাথে প্রেম করবে, রাত্রে বেলা অন্য কারো সাথে প্রেমালাপ করবে। ডিজুস জেনারেশন বলে কথা! এদের নিয়ে রোদ্দুরের গল্প লেখবো না। অন্য কিছু ভাবি।
আচ্ছা, চৌধুরীদের বাড়ির আমগাছের ফাঁকে ফাঁকে আগে না কতো টিয়া উড়তে দেখা যেত? নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করলেন তিনি। মানুষ বাড়তে বাড়তে আস্তে আস্তে টিয়াগুলা পুরা নাই হয়ে গেল! এইটা নিয়ে কি রোদ্দুরের গল্পটা লেখা যায়? এক মুহূর্ত ভেবেই বাদ দিয়ে দিলেন আইডিয়া, ধুরর...রোদ্দুরের সাথে টিয়ার কোনো সম্পর্ক নাই। আমের বোল নিয়ে অবশ্য লেখা যায়। রোদ্দুরের সাথে আমের বোল এর বেশ একটা সম্পর্ক আছে। নাহ, আম খেতেও ততো ভালো লাগে না। যা ভালো লাগে না তা নিয়ে লেখার কোন মানে হয় না। অন্য কিছু ভাবতে হবে।
নিজের মনে এমনি করে একটার পর একটা আইডিয়া চষে বেড়াতে লাগলেন জামাল সাহেব।
৩.
চৈত্র মাসের আকাশে হঠাৎ দুই একটা কালো মেঘ দেখে ভড়কে গেলেন নার্গিস আরা। কালবোশেখী না তো? এইবার কি আগেই এসে পড়লো নাকি? ছাদে বরইয়ের আচার রোদে দিয়েছেন, কাপড়ও ছুটা বুয়াটা একটু আগেই মেলে দিয়ে আসলো। ক্লিপ লাগিয়েছে কিনা কে জানে! বাতাস দিলে উড়ে যেতে পারে। অসময়ের ঝড়ের আশংকায় চৌধুরীদের আমবাগানের আমগুলোর জন্যও একটু খারাপ খারাপ লাগলো, এবার আম ভালো হবে না মনে হয়, ঝড়ে বোল পড়ে গেলে হবে কোত্থেকে! ভাবতে ভাবতেই দেখলেন তখনকার দুই একটা কালো মেঘ এতোক্ষণে বিশাল দল পাকিয়ে ফেলেছে, ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টিও বুঝি এই পড়তে শুরু করলো। রান্না ফেলে ছাদের দিকে দৌড় দিলেন...এতো শখের আচারগুলো! সিড়ি বেয়ে চারতলার ছাদে আসতে আসতে বৃষ্টি পুরোদমে নেমে গেল। তাড়াহুড়ো করে আচার গুলো আগে সরালেন, তারপর ভেজা কাপড়গুলোই বালতিতে ভরে দ্রুত পায়ে হাঁটা দিলেন সিড়িঘরের দিকে। হঠাৎ মনে হলো স্বামীর কথা! আরে!! ছাদেই তো থাকার কথা, গেল কই? এদিক ওদিকে তাকিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন। সিড়িঘর থেকে বের হয়ে ঘুরে তাকাতেই ট্যাংকির উপরে তার চোখ চলে গেল।
ট্যাংকির উপরে বসে জামাল সাহেব বেশ আরাম করেই লিখছেন। রোদ্দুরের গল্পটা এতোক্ষণে যেন পুরোদমে ছুটতে শুরু করেছে। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় এখন কালি ধুয়ে না গেলেই হয়!