কখনো নতুন হাঁটতে শেখা শিশু দেখেছ? কিরকম এলোমেলো পায়ে দুলে দুলে হাঁটে, বাবা-মার মনে ভয় জাগে, এই বুঝি পড়ে গেল! হাতটা তারা বাড়িয়েই রাখেন, পড়ে গেলেই ধরে ফেলবেন, তবু কাদামটির ছোঁয়া যেন তার শিশুটা না পায়...আমার ছেলেটার হাঁটা দেখেও আমার একই রকম মনে হতো। এমনিতেও অনেক দেরিতে হাঁটতে শিখেছে। একসময় তো ভয়ও পেয়েছিলাম, সারাজীবন কি ওরকম পা হিচড়ে হিচড়েই চলতে হবে? নিউমোনিয়ার হাই পাওয়ার ইঞ্জেকশনটা তো ওই পায়েই দিয়েছিল, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না তো? শেষ পর্যন্ত অবশ্য ও হাঁটতে শিখলো। বড়লোকেরা দেখি বাচ্চাদের হাঁটার জন্যে ওয়াকিং কার না কি যেন একটা কিনে দেয়। আমার ছেলেটা দেয়াল ধরে ধরেই হাঁটা শিখলো। ওর মা-র সে কি খুশি... আঁতুর ঘরেই তো মরে যাবার কথা ছিল ছেলেটার। গ্রামের অভিজ্ঞ দাইও আশা ছেড়ে দিয়েছিল...সেই ছেলে কিভাবে আজ হাঁটতে শিখে গেলো! মায়া মায়া চোখে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পৃথিবীটা যখন দেখতো, তখন কাঁদতেও ভুলে যেত।
ওর বয়স যখন ছয় হলো তখন প্রথম স্কুলে গেল, গ্রামেরই প্রাইমারী স্কুলে। সারাদিন দৌড়ঝাপ শেষে যখন বাড়ি ফিরতো, মেতে উঠতো ছোট্ট বোনটাকে নিয়ে। খেলাধুলার সে কি নেশা ছিল...নাড়া ক্ষেতে ফুটবল খেলতে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে যেত বিকেলবেলা, ভরদুপুরেও কাজীদের পুকুরে ঝাপাঝাপি করতে দেখতো এলাকার লোকে। মাঝে মাঝে বকাঝকাও করেছি...এতো খেললে কি বড় হওয়া যায়? অনেক পড়াশোনা করতে হয়, সেই কবিতা শুনিয়েছি...
পড়াশোনা করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে...
পড়াশোনাতেও খুব খারাপ ছিল না। ওর মা সারাদিন লেগে থাকতো ওদের দুই ভাই-বোনের পড়াশোনা নিয়ে। আমি আধাশিক্ষিত মানুষ, দূর থেকেই দেখতাম। দোকানটা চালাতে দিন পার হয়ে যেত, রাত-বিরেতে ওদের দুই ভাই-বোনের সুর করে পড়া শুনতাম...কখনো কখনো আড়ি পেতে দুজনার গল্পগুলোও শুনতাম। বেশ ভাব ছিল দুজনায়...
মেট্রিক পরীক্ষায় ছেলে আমার পুরো গ্রামকে অবাক করে দিল। স্টার মার্ক নিয়ে পাশ করলো, পুরো গ্রামে যেখানে আর সব ছেলেপেলেদের পাশ করতে জান খারাপ হয়ে যেত। সবাই বললো,"রহিমুদ্দী, ছেলেকে শহরে পাঠাও। ও অনেক বড় হবে। ওরে ভালো লেখাপড়া করাও।" গ্রামের এক সামান্য মুদী দোকানদার ছেলেকে শহরে পড়াবে ভাবতে কষ্ট হলেও আমি হাল ছাড়লাম না। পৈত্রিক জমিখানা বন্ধক রেখে দিলাম। জমি দিয়ে কি হয় বলো? ছেলে মেয়েরাই তো আমার সব... এই ছেলেটা মানুষের মতো মানুষ হলে মেয়ে নিয়ে আমার চিন্তা থাকবে না...
শহরের বড় কলেজে ভর্তি হতে গেলো ছেলেটা। নটরডেম কলেজ, দেশের সেরা কলেজ শুনেছি। যাবার আগে মেয়েটার সে কি কান্না...ভাইও বুঝি সে কান্না থামাতে পারে। ওদের মায়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। সেদিন শক্ত মুখে বিদায় জানালেও তারপরের দুটা বছর প্রতি রাতে ছেলেকে স্বপ্নে দেখে আর এটা-ওটা দিয়ে আমাকে শহরে পাঠায় ছেলেটা আমার ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা ঘুমাচ্ছে কিনা দেখতে। মেয়েটাও ভাইকে দেখবে বলে আমার সাথে তোমাদের এই ব্যস্ত শহরে আসে। মাঝে মাঝে ছেলেও বাড়ি আসে, তখন পুরো বাড়িতে যেন উৎসব বয়ে যায়। গোল হয়ে বসা মা- বোন আর পাড়ার সবাইকে শোনায় ঢাকার গল্প।
আমার ছেলেটা অনেক স্বপ্নবাজ ছিল। মুদি দোকানদারের ছেলে হয়ে ও ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন দেখতো...বোনকেও ডাক্তার হবার কথা বলতো। আমি মুখে কিছু বলতাম না, মনে মনে ভাবতাম শুধু... কিভাবে কি হবে? ছেলেটা কি স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বয়ে বেড়াবে? ইন্টার পরীক্ষায় সে পুরো দেশকে অবাক করে দিল, স্ট্যান্ড করে বসলো। বাড়িতে রিপোর্টারদের ভিড়, গ্রামের সব মানুষ দেখতে এলো রহিমুদ্দী দোকানদারের ছেলের কীর্তি। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, কি এমন যাদু ছেলেটার মাঝে...ও কি আমারই সন্তান? আমি তো যোগ-বিয়োগেও প্যাচ লাগিয়ে ফেলতাম, আর আমার ছেলে কিনা দেশ সেরা ছাত্র! ভাইয়ের সাফল্যে বোনের খুশি দেখে কে?
স্বপ্নের পথে আরো এগিয়ে গেলো ছেলে। বুয়েটে ভর্তি হলো, সত্যিই বুঝি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাচ্ছে...মেয়েটাও আমার আরো বেশি স্বপ্ন দেখতে লাগলো। ভাই যে বলেছে ডাক্তার হতেই হবে...ভাইয়ের কথা ফেলবে কি করে? কিন্তু সময় কি সবসময় একইরকম যায়? যেমন মানুষ চায় তেমনই কি সবসময় হয়? সিডরের ধাক্কা যেবার দেশে লাগলো, সেবারের কথা। দোকান থেকে ফেরার পথে মাথায় কি যেন একটা এসে পড়ল। জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি সদর হাসপাতালে। ছেলে ঢাকা থেকে ছুটে এলো, শহরে আরো বড় চিকিৎসার জন্যে নিয়ে গেল। ফিরে এলাম পুরো অবশ একটা শরীর নিয়ে...কথা বলতে পারি না, চলতে পারি না, এক জড় মাংসপিন্ড হয়ে বেঁচে থাকা। আমার মনের কথাগুলো কাউকে বলতে পারি না...হিসাব মেলাতে পারতাম না কিভাবে কি হবে? দোকান তো গেছে...কিভাবে সংসার চলবে?
ছেলে আমার সব কেমন করে সামলে নিল...শুনেছি ঢাকায় রাত-দিন টিউশনি করেছে। বোনটাকেও সে পার করে নিয়ে গেল...মেট্রিক পরীক্ষায় অনেক ভালো রেজাল্ট করলো মেয়ে। মফঃস্বলের কলেজেই ভর্তি হলো। ছুটি-ছাটায় ভাই এসে পড়িয়েও যায়, বোনকে সে ডাক্তার বানাবেই। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি আর ভাবি, এমন ছেলে আমার ঘরে কেমন করে এল? শহর থেকে চিঠি লিখতো ছেলেটা মার কাছে, বোনের কাছে, আমার কাছে। ওদের মা আমাকে পড়িয়ে শোনাতো...
বাড়ি আসছি বাবা, সামনে ফারিয়ার ইন্টার পরীক্ষা। ওকে আমি ডাক্তার বানাবোই। আমাদের পরীক্ষার দেরি আছে... এই পরীক্ষাই শেষ পরীক্ষা। এই পরীক্ষার পরেই আমি পুরো ইঞ্জিনিয়ার। জানো, এর পরে আমাদের আর এতো দুঃখ থাকবে না...
আমি অপেক্ষার দিন গুনতাম, ছেলে বুঝি এই বাড়ি ফিরলো।
এখনো আমি দিন গুনছি, ছেলে আমার ফিরে আসবেই... ওর বোনটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, কিছু বলে না। ওর মাও আমার মতো নির্বাক হয়ে গেছে। পুরো নীরব বাসার আশেপাশে শুধু স্মৃতিরা ঘোরাফেরা করে। মাঝে মাঝে মনে হয় এভাবে মরে যাওয়ার চাইতে আতুড়ঘরেই মরে যেত, তাহলে এলোমেলো পায়ে হাঁটা দেখে হাত বাড়াতে ইচ্ছে হতো না, ভরদুপুরের পুকুরে ঝাপাঝাপির জন্যে বকাঝকা করতে হতো না। আতুড়ঘরেই মরে গেলে এভাবে জ্বলে পুড়ে যন্ত্রণায় মরতে হতো না। পাশের ঘর থেকেও ডুকরে ডুকরে কাঁদা মেয়েটার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ভাই যে তার সবটুকু ছিল...
তোমরা পথ করে দাও, ছেলে আমার ঘরে ফিরছে। অনেক পড়াশোনা করেছে...এবার গাড়ি চড়ে সে ঘরে ফিরছে।
--------------------------------------------------------------------------
সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় ফয়সাল ভাইয়ের মারা যাওয়াটা আমাকে খুব ভাবিয়েছে। উনার সম্পর্কে কিছুই জানি না, যা জানি তার সাথে আমার কল্পনা মিলিয়ে দিলাম। কতো মায়ের কোল খালি হয়...কতো বাবার স্বপ্নভঙ্গ হয়, সে হিসাব কি আমরা রাখি? মৃত্যুটা আমাকে এতোই ভাবিয়েছে যে যতো কথা বলার ছিল ভেবেছিলাম, তার কিছুই বলতে পারি নি। লেখা সব এলোমেলো হয়ে গেছে...