আমি কোথায় থাকি জান? না না, যা ভাবছো তা না। স্বর্গে থাকি না। স্বর্গের গপ্পোও তোমাদের কাছে বলবো না। আমি আমাদের এ প্রিয় ব্যস্ত শহরের কোনো এক প্রান্তে থাকি। এখানেও ঠিক সেই একই রকম কোলাহল ঘুরে ফিরে। পুরো শহরটার মতো এখানেও ব্যস্ততা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় আমার অবসরের ক্ষণগুলোকে। তবু ঘর বলতে অন্যরকম একটা কিছু মনের মাঝে নাড়া দেয়...মানুষের ঘরে ফেরার টান এর শুরু বোধ হয় সেখানেই। দাঁত থাকতে যেমন দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না, তেমনি ঘরে থেকে ঘরের কথা ভাবতে ইচ্ছে করেনা...স্বর্গের কথা ভাবতে ইচ্ছে করে...স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। ধর্মগ্রন্থগুলোতে স্বর্গের কিছুটা আভাস দেয়া... আর তার পুরোটা আমি প্রতিদিন গড়ি আমার কল্পনাতে।
একটা টিনের ঘরের গল্প দিয়ে শুরু করি। এই ঢাকারই অভিজাত এলাকার নন-অভিজাত কোনো টুকরোতে সে ঘরটা ছিল। দুই কামরার ঘর, তাতে মা-বাবা আর আমরা দুই ভাই-বোন থাকতাম। দুই কামরার সাথে আরো এক কামরা বলা যায় সুবিশাল(!) রান্নাঘরটাকে। গুদাম ঘরের মতো ঘর ছিল, জানালা ছিল না বেডরুমে, গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। নীচতলা বলে মশা-মাছি পোকা-মাকড়েরও অভাব নেই। সেই ঘরের সামনের ছোট্ট হেঁটে চলার পথটুকুকে আমার সেই শৈশবে পীচঢালা রাজপথ বলে মনে হতো। "রিকশা-গাড়ির নিচে পড়বে, বের হয়ো না"--এতো সব হুমকি-ধামকিতে ভীতু আমি বড় রাস্তায় পা ফেলারও সাহস পেতাম না, তাই ঘরের সামনের ছোট্ট প্যাসেজটাকে আমার প্রিয় রাস্তা বলে মনে হতো। এরই মাঝে আমি আর আমার ছেলেবেলার বন্ধু , আমার জীবনের প্রথম বন্ধু অনি দুটো লাঠি নিয়ে টিপু সুলতান সেজে তলোয়ার-তলোয়ার খেলে যেতাম।
আমাদের ঘরের টিনের চালটা ছিল বেশ পুরোনো। জায়গায় জায়গায় জং ধরা , ফুটো হয়েছিল বেশ কিছু জায়গায়। বৃষ্টি দিন সে ফুটোগুলো তাদের অস্তিত্বের কথা সবাইকে জানান দিতো। রাত-বিরেতে কতো বৃষ্টিতে জেগে জেগে আমরা বিছানার ঠিক উপরের ফুটো দিয়ে চুইয়ে পড়া পানি ধরে রেখেছি ডেকচিতে... আমি খাবার টেবিলের উপরের ফুটোর পানি ধরছি তো বাবা-মা বিছানার উপরের ফুটো। বোন হয়তো ঠিক চুলার উপরের ফুটো বরাবর ডেকচি পেতে বসে বৃষ্টি শেষের প্রহর গুণছে। কতো রাত এরকম করে পেরিয়ে গেছে... কোনোদিন হয়তো সকালে আষাঢ় কালো মেঘের বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। দিনটা মনে হয় শুক্রবার ছিল...বাবা-মা বাসায়। বৃষ্টির ঝামেলা শেষ করতে করতে দুপুর প্রায়, রাত-জাগা আমাদের সকালের খাওয়াটাও হয় নাই। কোনোমতে খিচুড়ি রান্না হলো। বৃষ্টিদিন বলে বিলাসিতা করে ইলিশটাও ভাজা হলো। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়। যথাস্থানে বালতি রাখার পর আমাদের আর শুকনা কোনো বসার জায়গা নেই। কি আর করা...খাবার টেবিল টেনে নিয়ে সেই টেবিলের ওপরে সবাই মিলে বসেই খিচুড়ি-ইলিশ খেয়েছিলাম।
বাসার পিছনটাতে ছিলো ছোট্ট একটু নীচু জায়গা, সামান্য বৃষ্টিতেই সেখানে পানি জমে যেত। স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল বেয়ে হাঁটাহাঁটি করতো শামুক। আমি আর বোন মিলে কতো শামুক যে ধরতাম আর পানিতে ছেড়ে দিতাম! ওই ছোট্ট জায়গাতেই ছেড়ে দিতাম আমাদের দুজনের বানানো কাগজের নৌকা...কয়েক রঙ্গা নৌকা গুলোর মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা হতো, বৃষ্টির তোড়ে কে কতোক্ষণ টিকে থাকতে পারবে! একসময় ধুয়ে পাটিসাপটা হয়ে যেত! নৌকা ভিজতো...আর নৌকার সাথে নৌকার এ ক্ষুদে মাঝিরাও ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে বসতো। আপু একবার স্কুলের মাঠের পাশের ছোট্ট মতো চৌবাচ্চা থেকে পলিথিনে করে ধরে আনলো কিছু মাছের পোনা, আমাদের এ ছোট্ট দীঘিতে(!) ছাড়বে বলে। পরে দেখি ওইগুলা মাছের পোনা না, ব্যাঙ্গাচি। সেদিনই প্রথম আমরা ব্যাঙ্গাচি চিনেছিলাম, সাথে বোনাস হিসেবে আপু চিনেছিলো মায়ের মারটুকুও...
একটা সময় বাবার প্রমোশন হলো, বেতনও বাড়লো। আমরাও দালানবাড়ির মানুষ হলাম। ফেলে রেখে এলাম প্রথম জীবনের দারিদ্রের যত চিহ্ণ। ভুলেও আর ভূতের গলির ওই গুদামের মতো ছোট্ট টিনের ঘরমুখো হলাম না। বহুদিন পরে একবার গিয়েছিলাম। যে ঘর ছেলেবেলাতেই ছোট্ট বলে মনে হতো, এখন আর কি মনে হবে!! এখন মনে হয় কিভাবে এ ঘরময় ছুটোছুটি করতাম? এ ঘরে তো পা ফেলতেই পথ শেষ হয়ে যায়! পিছনের সেই কাগজের নৌকার দীঘিটা? ঐটা তো নোংরা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা...ময়লা পানি জমে আছে... ওইখানে আমি খেলতাম?! যে প্রিয় পথ জুড়ে তলোয়ার তলোয়ার খেলতাম, আজ সে পথে পাশাপাশি দুজনের হাঁটতেও কষ্ট হয় এতো সরু। সব কেমন যেন অন্যরকম, কিন্তু কিছুই তো বদলায়নি। একেবারেই কি কিছু বদলায়নি?
ঘর বদলায়নি, তাতে কি... আমি যে বদলে গেছি! অনেক বড় হয়েছি, ভালো-মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে...তাই কাগজের নৌকা ভাসানো পয়সা নষ্ট বলে মনে হয়, শামুক দেখে ঘেন্নায় লোম দাঁড়িয়ে যায়, ঘুপচি ঘরে দম ফেলতেও কষ্ট হয়। এখন আমাদের বিশাল দালান-বাড়ি...দুই ফ্ল্যাট নিয়ে থাকি। আমার রুমটাই আমাদের পুরানো বাসাটার সমান হবে। তবু স্বর্গের কথা ভাবতে গেলেই সেই টিনের ঘরের কথা মনে হয় কেন...যেখানে ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেত আর রাতের পর রাত ডেকচি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে পানি ধরতে হতো? আজ মা-বাবা-আপু-আমি যে যার রুমে, খাওয়া আর টিভি দেখা ছাড়া আমদের দেখাও যেন হতে চায় না। আজো বৃষ্টি হলে সেদিনের সেই খিচুড়ির ঘ্রাণ পাওয়া যায় কেন? টিনের ঘরের পেছনের পানিটুকুতে সেই রঙচঙে কাগুজে নৌকাগুলো আজও এ শৌখিন জীবনের সবটুকু রঙকে ছাপিয়ে কল্পনায় ভেসে ওঠে কেন?
স্মৃতির পাতায় পাতায় লেখা আছে আমার স্বর্গের বর্ণনা।
ক্ষমা চাই তোমদের কাছে,
যাদের বলেছিলাম স্বর্গের গপ্পো বলবো না... ... ...