ছয়টা দশ বাজে। ঘরে ফেরার সময় পার হয়ে গেছে। এখন ঘরে ফিরলেই মা ক্যাটক্যাট শুরু করবে--"এতো দেরি ক্যান?কই গেছিলি? খুব লায়েক হইয়া গেছস?..."। এইসব আর ভালো লাগে না। কিছুক্ষণ বকবক করেই তারপর সুর নরম করে বলবে--"জানস না, তোর বাবা আইসা তোদের না দেখলে মাথা গরম করবে? ক্যান এরকম করস?" সব মুখস্ত হয়ে গেছে, আজ আমি ঘরে ফিরবো না। মা যত খুশি মাথা গরম করুক...বাবার ভয়ে কাঁপাকাঁপি করুক, আমার কি?
ঘড়িটা আবার এক পলক দেখলাম। সাতটা বাজে, এতোক্ষণে নিশ্চিত বাসায় এসে পড়েছে বাবা। মনের কোণায় যে ভাবনাটা খুটখুট করছিল যে ফিরে যাই ফিরে যাই, এখন সেটাও ঝেড়ে ফেললাম। কালকের কথাই চিন্তা করো... খেলা নিয়ে ওপাড়ার পোলাপানের সাথে যে মারামারি হলো, তা যে আমাদের দোষ না সে কথা যদি বাবা একটু বুঝতে চাইতো!! কখনোই বুঝতে চায় না, দুনিয়ার সব দোষ যেন আমার। আজ তো ঘরে ফেরার প্রশ্নই উঠে না, একে তো কালকের মারামারির রেশ যায়নি, তার মধ্যে স্কুলে আজই রেজাল্ট দিতে হবে!! ইংরেজীতে ফেল শুনলে বাবা বাসার সামনের নিম গাছের একটা ডালও আস্ত রাখবেন না।
কি হয় বাড়ি যদি ফিরে না যাই?? আমাকে ফিরে যেতেই হবে?? বাবা তো দিদিকে পেলেই খুশি, ওর রেজাল্ট যাই হোক, কোনো সমস্যা না। আমার বেলাতেই শুধু নিম গাছের ডাল। ডাক্তার আসার পূর্বেই রোগী মারা গেল নাকি পরে মারা গেল এই নিয়ে যেন বাবার জগৎ...ইংরেজীতে একটু কম পেলে কি হয়? আজ কেন, আমি আর কোনোদিনই বাড়ি ফিরবো না। অভিমানে আমার চোখ জলে ভরে উঠছে। যে বাড়িতে উঠতে বসতে আমার জন্যে নিমের ডাল বরাদ্দ, সে বাড়িতে না ফেরাই ভাল। ওই বাড়িতে দিদিরই থাকা উচিৎ।
কোথায় যাব এখন এইটাই একটা বড় চিন্তা। খেলার মাঠে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না, একটু পরেই এখানে খোঁজ পড়ে যাবে। হাঁটতে থাকলাম, ঘরে ফিরতেই হবে এমন কোনো কথাও তো নেই, তাই না? কতো মানুষ ঘরছাড়া থাকে, আমিও নাহয় থাকবো। কবি নজরুলের মতো বিখ্যাত হয়ে অনেকদিন পর ফিরে এসে বাবাকে বুঝিয়ে দেবো, ইংরেজীতে ফেল করলে কিছু যায় আসে না। আর নজরুল হলে তো অবশ্যই বাবার অত্যাচার নিয়ে একটা কবিতা লেখবো। এরকম বাবা পাওয়ার চেয়ে না পাওয়া ভালো ছিল। সাকিবের বাবাটাও কত্তো ভালো, ফেল করার পর ওকে failure is the...কি যেন একটা বলে খুব উৎসাহ দিল। রাস্তা ধরে হাটছি আর ভাবছি এইসব কথা, একটু ক্ষিধাও পেয়েছে, কিন্তু আজ রাতে কোনো ব্যবস্থা হবে না। কালকে দেখা যাবে কি হয়। স্কুলের কাছে বড় মসজিদটায় পৌছে গেলাম। মসজিদে তো কতো মানুষই থাকে, আজ রাতে এইখানেই থেকে যাবো।
মসজিদের পাশের মশলার দোকানীটা কেমন কেমন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, চিনতে পেরেছে নাকি? স্কুলের শার্টটা তো রাস্তাতেই খুলে ফেলেছি, ভিতরের টি-শার্টই এখন ভরসা, একটু শীত-শীতও লাগছে। কিছু করার নেই। বারান্দায় শুয়ে পড়লাম। খোলা আকাশ। আজ শীতটা একটু কম কম, আশা করি রাতটা পার করতে পারবো। কুয়াশা কম, তাই আকাশ ভরা অনেক অনেক তারা...যেন একটু পর বৃষ্টি হয়ে পড়বে। ঘরের জন্যে একটু একটু মন খারাপ লাগছে, মা নিশ্চয়ই কান্না-কাটি করছে, দিদিও মন খারাপ করবে...মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাবার কথা মনে হতেই আর ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না, গেলেই দেখা যাবে নিমের ডাল হাতে বারান্দায় পায়চারি করছে, আর দোকানের কালুকেও নিশ্চই পাঠিয়েছে আমাকে ধরে আনতে। ঠিক করলাম, কালকে বাবা দোকানের জন্যে সকালে বের হলেই মাকে দেখে আসব, আর বাড়ি ছেড়ে যাবার কথাটাও বলে আসবো। অনেক দূর যাব...অনেক অনেক দূর, অনেক দেশ ঘুরবো, আর মজার মজার কাহিনী লেখবো। আমার হাতে এখন অপার স্বাধীনতা...ঘর পালানোর মজাই আলাদা।
নানান কথা ভাবতে ভাবতে কাল রাতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবেই পাইনি। এখন ভোর, আমার আশেপাশে অনেক মানুষই ঘুমিয়ে আছে, বেশিরভাগই ভবঘুরে টাইপ। হাতের দিকে তাকাতেই বুঝলাম...হাতের ঘড়িটাও নেই, চুরি হয়ে গেছে। মেজাজটা যা খারাপ লাগছে না... সময় বোঝার উপায় নেই। যাই, দূর থেকে বাবার দোকান খুলছে কিনা দেখি, খুললে বাসায় যাওয়া যাবে, মার সাথে শেষ দেখাটাও সেরে ফেলা যাবে। হাঁটতে হাঁটতে তিনমাথার মোড়ে আসলাম, বাবার দোকান তো বন্ধই দেখা যাচ্ছে, দেখি... পুকুরপাড়ে গিয়ে বসি।
গত ২ ঘন্টায় সাতবার মোড় থেকে ঘুরে এলাম, এখনো দোকান খুলেনি। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে বাবা আমার খোঁজে বাইরে গেছে, তাহলে এই ফাঁকে মার সাথে দেখা করে আসা যায়। ধীরে ধীরে বাসার দিকে পা বাড়ালাম। বাসার সামনে এসে কান পাতলাম, বাবার হুংকার শুনতে পাচ্ছি না। পুরো বাসা ঠান্ডা, তার মানে বাবা বাসায় নেই। এই সুযোগ, বারান্দা দিয়ে ঢুকে পড়লাম। দরজা খোলা পেয়ে একটু অবাকও হলাম, কিন্তু এটা থেকে আরো বেশি নিশ্চিত হলাম ...বাবা বাসায় থাকতে কোনো অনিয়ম সহ্য করবে না। তার মানে বাবা সত্যিই নেই। কিন্তু এতো লোক কেন? মিজান মাম, ছোট খালা, বড় খালা, ফুফুকে দেখতে পাচ্ছি...সবাই কি আমার পালানোর খবর পেয়ে এসেছে? আমাকে দেখতে পেয়ে সবাই নির্বাক তাকিয়ে রইলো, মাও চোখ মেলে তাকালেন। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, ব্যাপার কি? দ্রুত ঘরের দিকে একবার চোখ বুলালাম, বাবা নেই তো!! বাবা সত্যিই নেই...ড্রুইংরুমের কোণায় শুয়ে আছেন, কাফন মোড়ানো...
ঘর পালানোর গল্প এটুকুই। এটুকুই বললে ভুল হবে... হয়তো সেদিনের সেই অবুঝ কিশোর আজও প্রতিনিয়ত পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কে জানে?