দুই পর্বের প্রথম পর্ব এখানে-
Click This Link
আজ শেষ পর্ব:
০৪
এখন যা করতে হবে তা হল দুটি মোবাইল কেনা। প্রায় সাত মাস হয়ে গেল সে মাকে দেখেনা। মা গত চিঠিতে লিখেছেন 'তার নাকি শরীরটা ভাল না। রাতে ঘুমুতে গেলে দু:স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন। তারপর গায়ে জ্বর আসে। প্রচন্ড জ্বর। ফজরের আযান দেয়ার সাথে সাথে জ্বর সেরে যায়। রেহানের খুব টেনশন হয়। এবার বাড়িতে গেলে মাকে ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে। তাদের গ্রামের আশেপাশে তেমন ভাল ডাক্তার নেই। গ্রাম থেকে প্রায় ন'মাইল দূরে মিজু হাটে এম.বি.বি.এস ডাক্তার বসেন। আগামী মাসের ০৩ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তির টাকা পাবে সে। টিউশনি থেকে পাওয়া কিছু টাকা জমানো আছে। এসব দিয়ে মার জন্য মোবাইল আর ডাক্তার দেখানোর খরচটা হয়ে যাবে। মা চিঠিতে লিখেছে 'তার নাকি শরীরটা আরো খারাপ করেছে। আগে শুধু রাতের বেলায় জ্বর আসত, এখন দিনের বেলাতেও আসে'। রেহানের আর দেড়ি সয়না। কখন সে তার মায়ের প্রিয়মুখ টি দেখতে পাবে?
০৫
আজ পাঁচ তারিখ। রেহান রাতের ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছে। এখন শীত বেশি পড়েছে। মার জন্য একটা চাদর কিনেছে সে। কেনার সময় দোকানি বলল- 'ভাই ভেড়ার পশম দিয়ে তৈরী। তাই দামটা একটু বেশি'। ভেড়ার পশম দিয়ে তৈরী না হলেও চাদরটা যে অনেক ভাল, তা গায়ে দিয়েই বোঝা যায়। চাদরটা গায়ে জড়ানোর সাথে সাথে এক ধরনের উষ্ঞতা তৈরী হয়। মা এটা পেলে খুবই খুশী হবে। আর মাকে কালই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তার শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চিঠিতে লিখেছেন 'তিনি নাকি শুনতে পান বাবা তাকে ডাকছে। কবরে একা থাকতে তার ভাল লাগেনা'। এসব কথা যে মা কেন লেখে! রেহানের বুক ফেঁটে কান্না আসে। এত সহজেই সে মাকে মরতে দেবে? আরো অনেকদিন মা বেঁচে থাকবেন। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে মায়ের মুখে কখনো হাসি দেখেনি। কি পরিমান কষ্ট আর সংগ্রাম করে সংসার চালাচ্ছেন তা মনে হলে রেহান ফুঁপে ফুঁপে কাঁদে। যিনি এত কষ্ট করলেন তার মুখে হাসি না ফুটিয়ে মরতে দেবে সে? কখনোই না। মা চায় রেহান নামাজ পড়ুক, আল্লাহর ইবাদাত ঠিকমত করুক। রেহানও ঠিক করে বাড়িতে গিয়ে নামাজ শুরু করে দেবে। মুনাজাতে সে আল্লাহর কাছে চাইবে- 'হে আল্লাহ, মাকে তুমি আরো অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখো'।
ষ্টশন থেকে গ্রামে আসতে সকাল নয়টা বেজে গেল। মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। কতদিন মাকে দেখিনা। মায়ের মুখে 'বাবা' ডাক শুনিনা। 'আজ পথ শেষ হতে এত সময় লাগছে কেন? উফ, আর যে ধৈর্য্য বাঁধ মানছে না। কখন বাড়িতে যাব? কখন মায়ের মুখটি দেখতে পাবো? এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির উঠোনে চলে আসে রেহান।
আজ বাড়িতে এত মানুষ দেখা যাচ্ছে কেন? আর ঘরের ভিতর থেকেই বা মহিলাদের কান্নার শব্দ আসছে কেন? কি হয়েছে আমার মায়ের? আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর যায় সে। দেখে পর্দার আড়ালে কাকে যেন খালি চকিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা কাপর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। রেহান ডেকে ওঠে- 'মা, মাগো'। কে যেন পিছন থেকে এসে রেহানকে জাপটে ধরে। তোর মা আর নাইরে...... ।
০৬
এশার আযান দিয়েছে। রেহান পুকুর পাড়ে বসে আছে। বাদ জোহর মায়ের মাটি হয়েছে। তখন থেকেই এখানে বসে আছে সে। সন্ধ্যার দিকে আতিক ভাই এসে বাড়ির ভিতর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। রেহান যায়নি। সে আকাশে তারা ওঠার অপেক্ষায় আছে। সে শুনেছে 'মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়'। রেহান বসে আছে 'মা-তারা' দেখার জন্য। আকাশে অনেক তারা উঠেছে। এগুলোর মধ্যে নিশ্চই তার মা আছে। আতিক ভাই বলেছে- 'যে চলে যায়, সে আর ফিরে আসেনা'। রেহানের বিশ্বাস হয়না কথাটি। মা কোথায় যাবে তাকে ছেড়ে? কাল রাতেও তো ভাল ছিলেন। নিজে রান্না করেছেন, খেয়েছেন, নামাজ পড়েছেন। ঘুমুতে গিয়ে আর উঠবেন না, এ হতে পারেনা। মার জন্য নিয়ে আসা মোবাইল আর চাদর যে এখনো দেয়া হয়নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্র ও হাজারো তারার মাঝে সে তার মাকে খোঁজে। মনে মনে বলে- 'মা, তোমার মোবাইল আর চাদর নিয়ে যাও.......'।।