গত কয়েকটা দিন ধরে মার শরীরটা খুব একটা ভাল নেই। মা অসুস্থ আর আমরাও কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেছি এই কদিনেই। মার শূন্যতা আমরা কতটা অনুভব করেছি সেটা জানিনা কিন্তু এই সংসারের প্রতিটি ধূলিকণা মার শূন্যতা অনুভব করেছে। অপরাজিতার মলিন পাতা গুলো মার শূন্যতা টের পেয়েছে। খাচায় পোষা বাজ্রিগরও মার শূন্যতা অনুভব করেছে। আমি কিছু বুঝি আর না বুঝি মা যে এই সংসারের কান্ডারী সেটা অন্তত বেশ ভাল ভাবেই বুঝতে পেরেছি। মার কিছু হলে এই সংসারটাকে আমরা নোটিস ছাড়াই বন্ধ ঘোষনা করি। রাতের খাবারটাও যে যার মত খাই। তখন দুধের গ্লাসটাও কেউ হাতে হাতে পৌছে দেয় না। খাবার টেবিলটার চেহারাটাও থাকে ময়লার ভাগাড়ের মত। আমার ঘর্মাক্ত জামা কাপড় গুলোও অস্বস্তির নিঃশাস নিতে থাকে। তারপরেও এটা ভেবে ভাল লাগে যে, আমার বাবার মত একজন মানুষ আমার মায়ের ছায়া সঙ্গী।
সেদিন সকাল বেলা অফিসে এসে গুগলিং শুরু করে দিলাম হাই প্রেসারের রোগীদের ডায়েট চার্ট দেখার জন্য। মার জন্য একটা চার্ট তৈরী করে সন্ধ্যা বেলা সেটা প্রিন্ট করে নিয়ে গেলাম। বাসায় ফেরার সময় চার্ট দেখে দেখে কিছু খাবারও কিনলাম। মোটামুটি মাঝারি মানের একটা পোটলা হল আর কি। বাসার জন্য কেনাকাটা করা খুব একটা হয়ে উঠেনা আমার। আর সেই স্বভাবটাও যেন দিন দিন ভুলতে বসেছিলাম। আমি যে সময়টাতে বাসায় ফিরি মা ওই সময়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে আমাকে দেখা মাত্র বাসার গেটের চাবিটা দড়িতে বেধে নিচে ফেলে। আজকাল মাকে আর ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনা। বারান্দাটাকে শ্মশান ঘাটের মত লাগে। মার মলিন মুখটা দেখতে আমার একদম ভাল লাগে না। আজকাল মার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারিনা না। কেমন জানি গলাটা ধরে আসে। বাসায় ফিরেই মার হাতে খাবারের পোটলাটা দিলাম। আর ডায়েট চার্টটাও টানিয়ে দিলাম ডাইনিং রুমের দেয়ালে। এটা দেখে মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ মুচছিল। ব্যাপারটা না দেখার ভান করে ওখান থেকে সরে আসলাম কারন কিছু কিছু ভালবাসার প্রকাশটা নিজের ভিতরে থাকাই ভাল। আমার চোখের অশ্রুস্নানটাও নীরবে চলতে থাকল।
আমার দাদী একা একাই কথা বলেন। এই স্বভাবটা আমার মার ভিতরে আছে একটু আধটু। মা যখন ভোর বেলা আমাদের জন্য খাবার তৈরী করে তখন রান্না ঘরে একা একা কথা বলেন। এটা নিয়ে যে কতদিন মার সাথে চিল্লাচিল্লি করছি। কারন সকাল বেলার ঘুমটা আমার কাছে বেহেস্তি ঘুম মনে হয়। গতকাল সকালে আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি মা তখনও ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মানুষটার কেউ নেই। অসহায় একটা মুখ। আমরা তিন ভাই-বোন আর বাবা ছাড়া আসলেই এই মানুষটার আর কেউ নেই এই গ্রহে। মার আরেকটা স্বভাব আছে, সেটা হল হটাৎ করে রেগে যাওয়া। আর এই রাগটা বড়জোর কয়েক মিনিট থাকে। এই স্বভাবটা নানার কাছ থেকে পাওয়া।
এখন মা কেমন জানি বদলে গেছে। একা একা কথা বলে না। রাগ করে না। চুপচাপ হয়ে গেছে। সারাক্ষন মাকে নিয়ে আমার টেনশন হয়। পাগল পাগল লাগে। আজকাল আমার আর রাত করে বাসায় ফিরতে ভাল লাগে না। মার সানিধ্যটাই ভাল লাগে। মার কাছে নানা বাড়ির গল্প শুনতে ভাল লাগে। মার সাথে বসে টিভি দেখতে ভাল লাগে। আমি চাই আমার প্রতিটি সকাল শুরু হোক মায়ের গলাটা শুনে। শুক্রবাবের সকালটা শুরু হোক খিচুড়ি আর ডিম ভাজা দিয়ে। আমার এলোমেলো দিনগুলো কাটুক মায়ের শাসন বারনে। মাগো তোমার সুস্থতা কামনায়, সেই অপেক্ষাতেই রইলাম.........।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:৫৭