গত সাত দিন যাবত হিরক ভাইয়ের কোন খবর নাই। মনু মুন্সির সেই টংয়ের দোকানে আজকাল আর তাকে আগের মত পাওয়া যায় না। আমিও যেতে পারিনা।মানুষটার প্রযুক্তি প্রেম নেই বললেই চলে। কোন ফোন নেই তার। দরকারের সময় তাকে পাওয়া খুব মুশকিল। কিন্তু তার কাছ থেকে যে বইটা ধার করেছিলাম সেটা ফেরত দেবার শেষ দিন আজ। বইটা আজ ফেরত দিতে হবে। আমি বইটা নিয়ে বের হলাম। গাজী রোদের শেষ মাথায় মনু মুন্সির চায়ের দোকান। সেখানেই গেলাম আগে। দোকানে বিদ্যুত নেই। মোমবাতির আলোতে মনু মুন্সিকে অচেনা লাগছে। কাপ ধোয়ার ঝনঝন শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমাকে দেখে মনু মুন্সি কিছুটা নড়ে বসল। পান চিবাচ্ছে।
কি মনু ভাই, হিরক ভাইয়ের কোন খবর আছে নাকি?
মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিলেন।
হিরক ভাই এই টং ঘরে সন্ধার পর এসে বসে। তবে চা খেতে নয়। আদা জল খেতে আসেন তিনি। আমি মাঝে মাঝে আসি হিরক ভাইয়ের সাথে। এখান থেকে ঠিক তিনটা গলি পরেই হিরক ভাইয়ের বাসা। আমি আর কথা না বাড়িয়ে হাটা শুরু করলাম। গুনে গুনে ঠিক একশ তিরানব্বই কদম পার হতেই পৌছে গেলাম সেই আদ্ভুত বাড়িটার সামনে। চার তালা বিশিষ্ট পুরান দিনের বাড়ি এটা। দ্বিতীয় তালায় গত এক বছরে কোন ভাড়াটে আসতে দেখিনি। ফাকা পড়ে আছে। তিনতলায় লাইট জ্বলছে। তার মানে হিরক ভাই বাসাতেই আছে।
দরজা নক করতেই ওপাশ থেকে একটা কাশির শব্দ শোনা গেল। মনে হল অন্য কেউ। বেশ কিছুক্ষন পরে হিরক ভাই দরজা খুলল। ফ্যাকাশে একটা চেহারা। মনে হল আমাকে দেখে বিরক্ত হয়েছে। ঘরে ঢুকতেই কেমন যেন একটা বাজে গন্ধ নাকে গেল। আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। হিরক ভাই ওনার রুমে চলে গেল। দুই রুমের ছোট বাসা এটা। একাই থাকেন তিনি। মনে হচ্ছে গত দশ দিনে দরজা জানালা খোলা হয়নি। বসার ঘরের সোফার পাশেই একটা পিতলের টপ রাখা। এটা আজই প্রথম দেখমাল। কোন গাছ নেই টপে। কালো আর স্যাতসেতে মাটি। আমি হিরক ভাইয়ের রুমে ঢুকলাম। বিছানার উপর একটা বই খোলা আছে। আর সেটার দিকেই তার মনযোগ।
আমাকে বলল, মাংসখেকো কোন গাছের নাম জানিস তুই?
হুম। ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ। কোন এক পত্রিকাতে পড়েছিলাম।
বৈজ্ঞানিক নাম জানা আছে?
না।কেন? কি করবে ?
নতুন একটা পিতলের টপ কিনেছি। ওটাতে মাংসখেকো গাছ লাগাব।
আমি আর কোন কথা বললাম না। চুপ করে বসে থাকলাম। একবার সত্তজিৎ রায়ের একটা বইতে পড়েছিলাম মাংসখেকো গাছের কথা। গাছটার নাম ভুলে গেছি। যার শেষটা এমন যে, গাছটা একটা সময় নায়ককে খেয়ে ফেলতে চায়।
জানিনা আমি হটাৎ করে এতো ঘামছি কেন!! ভ্যাপ্সা গরম আর গন্ধ আমাকে পেয়ে বসছিল যেন…………।।
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যাচ্ছিল আমার। হাত দিয়ে বার বার ঘাম মুছে ফেলছিলাম। মনে হচ্ছিল শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। বিছানা থেকে দেখা যাচ্ছিল রান্না ঘরের উত্তর পাশটা। গ্যাসের চুলাটা নিভু নিভু আলোতে জ্বলছে।চুলার উপরে মনে হয় আলু সেদ্ধ করতে দেয়া ছিল। সেটার পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে এদিকে। বুক সেলফের উপরে কাচের বোতলে রাখা ফরমালিন মিশ্রিত মৃত সাপটাকে হটাৎ করে জীবন্ত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন হাজার বছরের ক্ষোভ। ক্ষোভ থাকারই কথা। বছর দুয়েক আগে আমরা যখন মাধবকুন্ডে গিয়েছিলাম তখন এটাকে আমরা ধরেছিলাম। ঢাকাতে আনতে আনতে এটা আধা মরা হয়ে গিয়েছিল। এই সাপটার নামটা আমার জানা নাই। কালচে সবুজ টাইপের একটা রঙ। চোখ দুটো গাঢ় লাল। মৃদ্যু আলোতে চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে। সাপটা ঢাকাতে আনার দু-তিন দিন পরেই মারা গিয়েছিল। পরে হিরক ভাই সেটাকে আর সৎকার করে নাই। ফরমালিন দিয়ে ওটাকে রেখে দিয়েছিল। শুনেছি মৃত জিনিসের আসে পাশেই তার আত্তা ঘোরাফেরা করে।
পোড়া গন্ধটা আরও প্রকট হতে লাগল। রান্না ঘরের উত্তর পাশে চোখ পড়তেই দেখলাম পাতিল থেকে ধোয়া বের হচ্ছে। হিরক ভাই হটাৎ বিকট শব্দে হেসে উঠল। আমি চমকে উঠলাম।
কিরে ভয় পেয়েছিস?
হুম।
এর আগে আমি কখনও হিরক ভাইকে এভাবে হাসতে দেখিনি। তার হাসি দেখে আমার শরীরের সব পশম সোজা হয়ে গেল। আমি ভিতরে ভিতরে কাপছিলাম। কিন্তু আমি হিরক ভাইকে কিছু বুঝতে দিলাম না।
আমি রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। চুলাটা বন্ধ করে দিলাম। পাতিলের ভিতর আলু পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। সমস্ত ঘর ধোয়ায় সাদা হয়ে গেছে। আমার কাশির উপক্রম হল। বসার ঘরের জানালাটার একপাশ খুলে দিলাম। হু হু করে বাইরের ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকতে লাগল। থেমে থেমে মেঘের এলোমেলো দৌড়াদৌড়ি বেশ ভাল ভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। হিরক ভাই দৌড়ে এসে জালানাটা বন্ধ করল।
কি করলি এটা?
কেন?
হিরক ভাইয়ের চোখ দুটো কালচে সবুজ সাপটার মত লাগছে। আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম।
অক্সিজেন ঢুকতে দিলি কেন?
তোমার ঘরে তো অক্সিজেনের অভাব, তাই জানালা খুললাম।
আমার দরকার স্যাতসেতে আর কম নাইট্রোজেন সম্পন্ন পরিবেশ।
তাহলে অক্সিজেন কি দোষ করল?
অক্সিজেন স্যাতসেতে ভাবটা নস্ট করে দেয়।
হুম বুঝছি।
আমি কাল সকালের ট্রেনে সিলেটে যাচ্ছি। চার দিন থাকব।
হুম
বাসার ডুপ্লিকেট চাবিটা বুক সেলফের পাশে রাখা আছে। নিয়ে নিস।
হুম। ঠিক আছে।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বুক সেলফের দিকে এগিয়ে গেলাম। আর খুজতে থাকলাম পুরনো জং ধরা চাবিটা…………
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৯:৪৩