নিজের ব্যস্ততা আর মিথ্যে কথার শহরে থাকতে থাকতে বেশ হাপিয়ে উঠেছিলাম। সব কিছুর মধ্যে নিরানন্দ ছাড়া আর কিছুই খুজে পাচ্ছিলাম না। সব কিছুর মধ্যে কেবলই অসামজ্যসতা। শেওড়াপাড়াতে নেমেই ফোন দিলাম তাহের ভাইকে।
-ভাই কই আছ?
-শেওড়াপাড়ায়। তুই কই?
-আমিও শেওড়াপাড়ায়।
-গলির মাথায় চলে আয়। রওনক আমার সাথে আছে।
তাহের ভাই ফোন রেথে দিলেন। আমি দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম। তাহের ভাই আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। আর রওনক আমার থেকে দুই বছরের ছোট। আমরা একই রোডে থাকি। সেই সুবাদে আমাদের বন্ধুত্ব। কালভার্ট রোডের চায়ের দোকানে কাটে আমাদের সন্ধ্যা গুলো। আমাদের সাথে মশা গুলোরও বেশ ভাব হয়ে গেছে। সামনের পুরাতন বাড়িটার পরেই সেই চায়ের দোকানটা। তাহের ভাই আর রওনককে দেখা যাচ্ছে। আমি আরও দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম। বাশ দিয়ে বানানো চৌকির উপর বসে পড়লাম। তাহের ভাই বলল,
-কিরে চা খাবি?
-নাহ।
রওনক দুই হাত দিয়ে ফোন চাপাচাপি করছে। কি সব আজাইরা গেমস খেলে সারাদিন!!! ফোন চাপতে চাপতে রওনক বলল,
-কিরে, কাল কি প্লান?
-সারারাত ফুটবল খেলব আর পরদিন সারাদিন ঘুমাব।
তাহের ভাই হো হো করে হেসে উঠল। বলল,
-কাল তো সবারই ছুটি। চল কাল পাটুরিয়া যাই। সারাদিন নৌকা করে পদ্মাতে ঘুরব।
রওনক আমার দিকে তাকাল। আমি কি বলল বুঝতে পারছিনা। তাহের ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। সবার মাঝে নিরবতা। তার মানে সবাই যেয়ে চায়।
পরদিন খুব ভোরে উঠলাম। আমরা বাসা থেকে বের হয়ে সোজা গেলাম গাবতলী। ওখান থেকে লোকাল বাসে করে পাটুরিয়া ঘাট। সূর্য মামা পূর্ব গগণে তার আভা বেশ ভাল ভাবেই ছড়াচ্ছে। নয়টার ভিতরে আমরা পৌছে গেলাম। রুটি আর ডিম ভাজা দিয়ে সকালের নাস্তা করলাম আমরা। পাটুরিয়া ঘাটের উত্তর পাশে দাঁড়িয়ে আমরা ছোট্ট একটা প্লানিং করে ফেললাম। তাহের ভাই বলল, সারাদিনের জন্য একটা নৌকা ভাড়া করার কথা। আমি আর রওনক হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। ঘাটে তেমন কোন নৌকা ছিল না। আমরা উত্তর দিকে এগাতে থাকলাম। আমার কাধের ব্যাগে পানির বোতল আর রওনকের ব্যাগে শুকনা খাবার। তাহের ভাইয়ের কাছে চায়ের ফ্লাক্স। আমরা তিন মুসাফির এগিয়ে চলেছি পদ্মা নদীর পাশ দিয়ে। তাহের ভাই সামনে, আমি পিছনে আর রওনক মাঝে। মিনিট দশেক হাটার পর আমরা একটা নৌকা পেয়ে গেলাম। ছয়শ টাকার বিনিময়ে বিকাল পর্যন্ত নৌকা ভাড়া করা হল। মাঝারি সাইজের একটা নৌকা এটা। মাঝি সহ আমরা চারজন। আমাদের মাঝি চাচা মাঝ বয়সী একজন মানুষ। শুকনা শরীর। চোখে মুখে দারিদ্রতার ছাপ। পান খেতে খেতে দাত গুলো কালো করে ফেলেছে।
আমাদের নৌকা উজানে চলতে শুরু করেছে।মৃদু বাতাস আর পানির শব্দ ভালই লাগছিল। সূর্য মামার সাথে মেঘেরাও বেশ লুকোচুরি খেলছে। তবে রোদের ছড়াছড়িটাই বেশি। এর ভিতরে আফরোজা আপা আর মাহিন বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। একবারও ফোন ধরতে পারিনি। নৌকা আপন গতিতে এগিয়ে চলছে। তাহের ভাই গুন গুন করে কি যেন একটা গাইছে। বাতাসের জন্য বুঝতে পারছিনা। আর আমি ব্যগ থেকে পানির বোতল বের করতেছি। মাঝি চাচা বার বার আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন। রওনক মাঝি চাচার কাছাকাছি বসা ছিল। চাচা রওনককে বলল,
-বাবা তোমরা কি ঢাকা থেইক্যা আইছ?
-হুম।
-তয় বাবা পদ্মার ইলিস না খাইয়া কিন্তু যাইয়ো না।
-হুম।
রওনককে দেখে বোঝা যাচ্ছে আজ তার কথা বলার মুড নাই। হুম, হা টাইপের শব্দ দিয়ে কাজ সেরে নিচ্ছে। আমরা পাটুরিয়া ঘাট থেকে প্রায় চার পাচ কিলোমিটার দূরে চলে এসেছি। নদীর মাঝে অসংখ্য ছোট বড় চর। দেখতে দারুন লাগছিল। আর নদীর দুপাশে গ্রাম গুলো ছিল আরও সুন্দর। আকাশের সমস্ত নীল নদীর পানিতে পড়েছে আজ। স্বচ্ছ নীল পানি। নদীর বুকে ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে আমার। তাহের ভাই চাচাকে বলল,
-চাচা যেকোন একটা চরে নৌকাটা ভিড়াও।
-জ্বে, ঠিক আছে।
আমাদের কাছাকাছি একটা চর দেখা যাচ্ছিল। হয়ত হাজার বারশ বর্গফুটের হবে। আমাদের নৌকা ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেল। জোয়ার আসলে যে চরটা ডুবে যায় সেটা বেশ ভালভাবে বোঝা যাচ্ছে। পানি ছুই করছে চরটাতে। তাহের ভাই আমাকে বলল,
-ব্যাগ থেকে খাবার গুলো বের কর।
-হুম করছি।
রওনকের ব্যাগে খাবার গুলো রাখা আছে। সল্টেজ বিস্কুট আর ড্রাই কেক। সাথে পুদিনা পাতার চা। রোদের তীব্রতা আর বাসাতের আধিখ্যতায় শরীর থেকে কোন ঘাম বের হচ্ছিল না। শুধু পানি পিপাসা লাগছিল বার বার।
নৌকা থেকে নামে পড়লাম। দ্বীপের মাঝে আমরা। চারপাশে পানি। অদ্ভুত এক ভাললাগা কাজ করছিল আমাদের মাঝে। আমরা ছোট বাচ্চাদের মত এলোমেলো ছোটাছুটি করছিলাম। চাচা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন আর মুখ টিপে হাসছেন। আমরা চাচাকে নিয়ে জল খাবারটা খেয়ে নিলাম। চাচা নৌকাতে বসে বটপাতার বিড়ি খাচ্ছেন। সূর্য ঠিক আমাদের মাথার উপরে। ব্যাগে রাখা কাপড় গুলো রওনক নিয়ে আসল। ওগুলো পরে পানিতে নামলাম। আমরা তিনজনই ভাল সাতারু। আমরা গলা পানিতে নেমে শরীরটা ঠান্ডা করছিলাম আর তাহের ভাই আমাদের মিরাক্কেলের যতসব ফালতু জোকস শোনাচ্ছিল। অহেতুক হো হো করছিলাম।
প্রায় ঘন্টা খানিক আমরা পানিতে। উঠতে ইচ্ছা করচ্ছিল না। বেশিক্ষন পানিতে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে এই ভয়ে আমরা উঠে পড়লাম। চাচা তখনও বিড়ি খাচ্ছিল। বেশ দূরে একটা বাজার দেখা যাচ্ছিল। বাজারটা নদীর পাড়েই। ছোট ছোট টিনের ঘর। তাহের ভাই চাচাকে বলল,
-চাচা ওই বাজারে কি ইলিস কিনতে পাওয়া যায়?
-যায় তো, মাছ কিন্না কি ঢাকায় নিয়া যাইবা?
-না। মাছ পুড়িয়ে খাব।
চাচা বোকার মত তাহের ভাইয়ের দিকে তাকাল। এই জাতীয় কথা মনে হয় সে আগে শোনেনি।
-কিছু মনে না করলে বাবা একখান অনুরোধ করতাম…।
-কি অনুরোধ চাচা?
-ওই বাজার থেইকা মাছ কিনলে আমি রান্ধনের ব্যবস্থা করতে পারমু। পাশেই আমার বাড়ি।
তাহের ভাই আমার আর রওনকের মুখের দিকে তাকাল। আমরা দুজনেই চুপ।
-ঠিক আছে চাচা।
আমাদের নৌকা আবার চলতে শুরু করল। বাতাসের বেগ আগের থেকে বেড়ে গেছে। বাতাসের ঠিক উল্টো পথেই চলছি আমরা। দূরে ছোট ছোট অনেক নৌকা দেখা যাচ্ছে। আর নদীর কূলে নগ্ন গায়ে ছোট ছেলেরা গোসল করছে। দূর থেকে জেলেদের নৌকা থেকে গান ভেসে আসছিল-
“কি কথা কহিয়া মোরে
ফ্যালাইলি পিরিতের ডোরে
অখন বুঝি তুমার মনে নাই
সুজন বন্ধুরে…………”
আমরা বাজারে পৌছে গেলাম। রওনক এক লাফে নৌকা থেকে নামল। নৌকাটা দুলে উঠল। আমি একটু হলেই পড়ে যেতাম। চাচা আমাকে ধরে ফেলল। ছোট্ট একটা বাজার। সব মিলিয়ে হয়ত আট থেকে নয়টা টিনের ঘর আছে এই বাজারে। ছোট ছোট সব দোকান। একটা চায়ের দোকান আছে পূর্ব মাথায়। এটা মূলত জেলেদের মাছ কেনা বেচার হাট। আর মাছের বাজার বসে খুব ভোর বেলা। কিন্তু এখানে সারাদিনই মাছ পাওয়া যায়। চাচা দরদাম করল মাছের। চারশ টাকা দিয়ে আমরা মাঝারি সাইজের দুটো ইলিস কিনলাম। বাজারের উত্তর পূর্ব পাশে মাঝি চাচার বাড়ি। পাচ মিনিটের পথ। সরু পথ ধরে হাটতে হাটতে আমরা চাচার বাড়িতে পৌছালাম। এক চালা তিনটা ঘর চাচার বাড়িতে। ঘর গুলোতে পাট কাঠির বেড়া দেওয়া। বাড়ির দক্ষিন পাশে বিশাল একটা বাশ বাগান। আমাদেরকে দক্ষিন পাশের ঘরটাতে বসতে দেওয়া হল। পাট কাঠির বেড়া কেটে জানালা বানান হয়েছে। ঘরের ভিতর তেমন কিছুই নেই শুধু একটা খাট ছাড়া। বিছানায় একটা কাথা বিছানো আর তেল চিটচিটে দুটো বালিশ। ঘরের পশ্চিম পাশে একটা বাশ ঝোলান আছে। সেখানে কিছু পুরাতন কাপড় রাখা আছে। কাপড় গুলো দেখে মনে হচ্ছে চাচার ছেলেদের কাপড় এগুলো। হয়ত এখন বাড়িতে নেই। আমরা বিছানায় পা উঠিয়ে বসে আছি। চাচা দাঁড়িয়ে আছেন। বাইরে থেকে একটা মহিলার গলা শোনা গেল। ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চাপা কন্ঠে বলল,
-শরবতটা নিয়া যান।
চাচা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। চাচির হাত থেকে শরবতের গ্লাস গুলো নিল।
-লও বাবারা। ব্যালের শরবত। নিজেগো গাছের।
আমরা শরবত খেয়ে বিছানায় বসে বসে গল্প করছিলাম। চাচা হয়ত চাচির কাজে সাহায্য করছে। দক্ষি্না বাতাসে ঘুম চলে আসছে আমার। আমি শুয়ে পড়েছি। রওনক ফোনে গেমস খেলছে আর তাহের ভাই সেটা দেখছে।
প্রায় ঘন্টা খানিক পরে চাচা এসে জানালেন রান্না শেষ। ততক্ষনে আমাদের পেটের ভিতরে ছুচো গুলো নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। সরষে ইলিস, ডিম ভাজা আর মোটা চালের ভাত দিয়ে আমাদের ভুরিভোজ হল। চাচা জোর করে বার বার প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছিল। রান্নাটা ছিল আসাধারণ।
খাওয়ার পর আমরা বেশিক্ষন দেরি করিনি। এখান থেকে পাটুরিয়া ঘাট যেতে অনেক সময় লেগে যাবে। আবার শুরু হল আমাদের যাত্রা। এবার তো আমরা ভাটির দিকে যাচ্ছি। হয়ত বেশি সময় লাগবেনা। অনেকটা দূরে চলে এসেছি আমরা। পিছনে ফিরে তাকালাম । দুরের ছোট্ট টিনের ঘর গুলোকে বড় বেশি ঝাপসা লাগছে। গাংচিল গুলো সেদিকেই উন্মাদের মত ছুটে চলেছে। আর আমি ফিরে যাচ্ছি আমার সেই পুরনো মিথ্যা কথার শহরে………………
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:১৯