চোখ কচলাতে কচলাতে মোবাইল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে শহীদ দেখে রাত ৪.০০ টা বাজে। নিশা হোটেলের মালিক বলেছিল সরনকোট (Sarankot) রওনা হয়ে যাবার উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে সকাল ৪.৩০টা। শহীদ তার শরীরের একরাশ ক্লান্তি নিয়েই দুই বন্ধু হাফিজ আর আলমকে ডেকে তুলল। তিনজনে শীতের কাপড় পরে তিনতলা থেকে হোটেলের নীচের তলার লবিতে নেমে গেলো। লবিতে দাড়িয়ে আলম তার মাফলার ঠিক করতে করতে দেখল হোটেলের মালিক রাস্তায় একটি গাড়ীর পাশে দাড়িয়ে ড্রাইভারের সাথে কি একটা বিষয় নিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে।
তিনবন্ধু গাড়ীর কাছে যেতেই হোটেল মালিক পরিচয় করিয়ে দিল ড্রাইভারের সাথে। ড্রাইভার নিজেই আগ বাড়িয়ে বলল, স্যার আপনারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? আমিও বাংলাদেশের মানুষ, আমার পূর্ব পুরুষেরা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় বসবাস করতো। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তারা নেপাল চলে আসে। আজ সকালে আপনাদের পেয়ে আমার খুবই ভাল লাগছে। আশা করছি আজ আমাদের দিনটা ভালই কাটবে; আমরা অন্নপূর্ণা ভাল ভাবেই দেখতে পাবো। চলেন স্যার আমরা এগিয়ে যাই।
তিনজনে শীতে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ীতে উঠে গেলো। গুগলে সার্চ দিয়ে আলম দেখল, সরনকোট জায়গাটা সমতল থেকে ১৬০০ মিটার উপরে। পোখরা শহরের ফেউয়া লেইক (Phewa Lake) এর কাছে যেই নিশা হোটেল থেকে ওরা রওনা হয়েছে, সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরেই সরনকোট; আর সেখানে যেতে সময় লাগবে ৩০ মিনিটের মতো।
পোখরার মতো এমন সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো শহর তিনবন্ধুর কেউ কোনদিন দেখেনি। পোখরা শহরটা সকাল দুপুর আর রাত একেক সময় দেখতে একেক রকম। এ শহরের দৃশ্য আবহাওয়ার সাথে সাথে মানে মেঘ বৃষ্টি আর রোদের সাথে পরিবর্তন হয়ে যায়।
সকালের নির্জন শহর দেখতে দেখতে... এক শহরের সীমানা শেষ হয়ে যায়... আর শহরটাকে পেছনে ফেলে গাড়ীটা পাহাড়ের উপরের দিকে ধীরে ধীরে উঠতে থাকে। তিনবন্ধু নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে গোটা একটা শহর, যার বুকে মিটি মিটি জলছে আলোর বন্যা।
সরণকোট পাহাড়ের উপরে অবস্থিত একটা গ্রাম; আকাশ পরিষ্কার থাকলে যে গ্রাম থেকে তাকিয়ে সব চাইতে সুন্দর পর্বত মানে অন্নপূর্ণা (Annapurna range) দেখা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এই অন্নপূর্ণা দেখতে এই গ্রামে এসে ভীর করে।
তিনবন্ধু যখন সরণকোট গিয়ে পৌছালো তখনও অন্ধকার রাত, আলো ফুটেনি আর আকাশে সাদা সাদা পেঁজা তুলার মতো মেঘ, চারপাশে হিম ধরানো ঘন কুয়াশা। শত শত মানুষ রাত জেগে অপেক্ষা করছে কখন সকাল হবে? পরিষ্কার একটি সকাল যেখানে কোন মেঘ থাকবে না, সেই আকাশের জন্য মনে মনে প্রার্থনা চলছে...।
মেঘ শুধু সরণকোট গ্রামে নয় অন্নপূর্ণা রেঞ্জেও থাকা যাবে না, তবেই সবাই অন্নপূর্ণাকে দেখতে পাবে। হ্যা, মানুষের প্রতীক্ষার প্রহর পেড়িয়ে পূর্ব আকাশে ঝলমল করে হেঁসে উঠলো একটি নতুন সূর্য... চারদিকে মানুষ হই হই করে উঠলো..., যেনো নিজ দেশের ছেলেরা বিদেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জিতেছে তেমন একটা উচ্ছ্বাস আর চিৎকার...।
সোজা সামনে তাকিয়ে ছিল শত শত মানুষ যাদের অনেকেই অল্প বয়সী যুবক-যুবতী, স্কুলে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী আর বয়সী বুড়ো; তারা জানেনা অন্নপূর্ণা আসলে আকাশের কোন দিকে উদিত হবে...!? মানুষের কি আকর্ষণ, কি উৎকণ্ঠা...!
এবার শত শত মানুষের চিৎকার, কোলাহল আর করতালি... হ্যা, ঐতো মানুষের মাথা যতটা উপরে উঠানো যায় ততটা উপরে মেঘের উপরে সাদা উজ্জল আলো নিয়ে জেগে উঠেছে অন্নপূর্ণা আর তার রূপসী গাঁয়ে পড়েছে সূর্যের কাঁচা সোনালি রঙের মহনীয় প্রলেপ। কি অসাধারণ এই অন্নপূর্ণা আর তাকে নিয়ে মানুষের এতো আগ্রহ উচ্ছ্বাস আর ভালবাসা...!
প্রকৃতি যে এতো সুন্দর আর মনোহর; যারা অন্নপূর্ণা দেখেনি তারা কোনদিনই বুঝবে না। আসলে অন্নপূর্ণার সৌন্দর্য ছবি তুলে বা ভিডিও করে মানুষকে দেখানো যায় না। কিছু কিছু সৌন্দর্য আছে, যা কেবল চোখেই দেখা যায়; আর অনুভব করা যায় কিন্তু বলা যায় না...। মানুষ হয়তো অন্নপূর্ণার আসল সৌন্দর্য কোনদিনই ভাষায় বর্ণনা করতে পারবে না...!
তিনবন্ধু হোটেলে ফেরার রাস্তায় একটি এয়ার লাইন এজেন্টের অফিসে গিয়ে কথাবার্তা বলল, জানতে পারলো এখান থেকে এয়ারে কাঠমান্ডু গেলে হিমালয় পর্বতের রেঞ্জগুলোকে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। এদিকে আলম হিন্দি টিভি দেখে দেখে সাউথ ইন্ডিয়ান একসেন্টে ভালই হিন্দি শিখে ছিল। সে খুব আগ্রহ নিয়ে এয়ার লাইন এজেন্টের সাথে হিন্দিতে গল্প গুজব জমিয়ে ফেললো।
তিনবন্ধু কাঠমান্ডু থেকে পোখরা আসার দিন দেরিতে রওনা হওয়ার জন্য টুরিস্ট বাস মিস করেছিল; তারপর ভাড়া করা মাইক্রোবাসে পোখরা আসতে পাহাড়ি রাস্তার যে দৃশ্য তারা দেখেছে তাতে তিনজনের কেউই ওই রাস্তায় গাড়ীতে কাঠমান্ডু ফিরে যাবার সাহস করছে না।
যাই হোক, হাতে সময় কম আর এদিকে জনপ্রতি মাত্র ৪৫ ডলার এয়ার ফেয়ার দেখে তিনজনে তিনটা টিকিট কিনে ফেলল। এয়ার লাইন এজেন্ট জানালো, পোখরার বিমান ছাড়ে আকাশের মেজাজ-মর্জি মতো; মানে সময় অনুযায়ী বিমান থাকলেও সেটা পুনঃ নিরধারিত হয় আবহাওয়া দেখে।
সময় অনুয়ারী বুদ্ধা এয়ারের (Buddha Air) বিমান ছেড়ে যাবে দুপুর ১২.০০ টায়। তিনবন্ধু যখন দেখল, আগামীকাল সন্ধ্যায় কাঠমান্ডু থেকে ওদের ঢাকায় ইউনাইটেড এয়ারের ফ্লাইট ধরতে হবে, তাই আগামীকাল সকালের টুরিস্ট বাস ধরা আর আবহাওয়ার ভরসায় না থেকে আজই পোখরা থেকে কাঠমান্ডু চলে যাওয়াই ঠিক হবে।
যাই হোক, তিনজন শেষ বারের মতো ফেউয়া লেকের পাড়টা ঘুরে আর একটা ঝর্ণা দেখে দুপুরের আগেই রওনা হয়ে গেলো পোখরা এয়ার পোর্টে। এয়ার পোর্টে দুইভাগে চেক হয় বিদেশীদের। একভাগে ইমিগ্রেশনের লোকজন আর অন্যভাগে এয়ার লাইনের লোকজন যাত্রীদের পরীক্ষা করে।
তিনবন্ধু ইমিগ্রেশনের লাইনে দাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে তিনটা ফর্ম পূরন করলো আর পাশে ব্যাংকের বুথে এয়ার পোর্টের ট্যাক্স দিয়ে দিল। ইমিগ্রেশনের ফর্ম পুলিশের হাতে দিতেই পুলিশ অফিসার বলল, আপনি ইন্ডিয়ান?
আলম বলল, জি না, আমি বাংলাদেশী আমরা তিনজনই বাংলাদেশী।
পুলিশ অফিসার বলল, আপনার পাসপোর্ট বাংলাদেশী কিন্তু টিকিটতো ইন্ডিয়ান।
আলম বলল, স্যার আমি আপনার কথা বুঝতে পারছিনা!? আমরা আজ সকালে এক এয়ার এজেন্টের কাছ থেকে এই তিনটা টিকিট কিনেছি। আমাদের খুব জরুরী কাঠমান্ডু যাওয়া দরকার; কেননা আগামীকাল সন্ধ্যায় আমাদের ঢাকায় ফ্রাইট ধরতে হবে।
পুলিশ অফিসার বলল, দেখুন নেপালে এয়ার টিকিট তিন রকমের দামে বিক্রি হয়। ১। নেপালীদের জন্য ২। ইন্ডিয়ানদের আর ৩। বিদেশীদের জন্য। আপনাদের তিনজনের ভাড়া ইন্ডিয়ানদের জন্য নির্ধারিত যে ভাড়া; সেই ভাড়ায় কেনা হয়েছে। আমরা এয়ার পোর্টে নিয়ম অনুযায়ী কোন বিদেশীকে ইন্ডিয়ান ভাড়ায় ভ্রমণ করতে দিতে পারি না। আপনাদের জানা উচিৎ ছিল বিদেশীদের ভাড়া ১১০ ডলার আর ইন্ডিয়ানদের ভাড়া ৪৫ ডলার। আপনারা এখন এই ফ্লাইটে যেতে পারবেন কিন্তু আপনাদের ১১.৩০টার মধ্যেই অতিরিক্ত ডলার দিয়ে টিকিট রি-কনফার্ম করতে হবে।
শহীদ বলল, স্যার দেখুন আমাদেরতো কোন দোষ নেই, আমরাতো বলি নাই যে আমরা ইন্ডিয়ান, ঐ এয়ার এজেন্ট ভুল করেছে। আমাদের কোন খারাপ উদ্দেশ্যও নেই। আমাদের সমস্যাটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন...।
পুলিশ অফিসার বলল, দেখুন আমাকে এতো কথা কেন বলছেন? আপনারা নিয়ম মানলেই কেবল আমি পারমিশন দিতে পারি। আমার কথা না বুঝলে আমি আমার থেকে উচ্চতর কর্মকর্তার কাছে আপনাদের নিয়ে যেতে পারি; কিন্তু নিয়ম আপনাদের মানতে হবেই।
হাফিজ বলল, স্যার আমাদের কোন উপায় নেই। আমাদের আজ অবশ্যই কাঠমান্ডু যেতে হবে; আগামীকাল সন্ধ্যায় ঢাকার ফ্লাইট ধরতে হবে। অন্যদিকে আমাদের চেক করে দেখতে পারেন, আমাদের কাছে টিকিটের অতিরিক্ত ভাড়া দেবার মতো ১৯৫ ডলার নেই। আমাদের একটু হেল্প করুন...।
পুলিশ অফিসার বলল, দেখুন আমার কিছুই করার নেই। আমি আপনাদের এয়ার পোর্ট প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার নিকট নিয়ে যাচ্ছি, আপনারা তার সাথে কথা বলে দেখতে পারেন...।
যথারীতি তিনবন্ধু এয়ার পোর্ট প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার রুমে গেলো আর সেই কর্মকর্তা পুলিশের ঐ অফিসারের চাইতেও তীব্রভাবে আইন ভাঙ্গার জন্য তিনবন্ধুকেই দোষারোপ করতে থাকলো...।
এক সময় ফোন দিয়ে এয়ার লাইন এজেন্টকে ডেকে আনল; আর সেই এজেন্টকে তার টিকিট বিক্রির ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে বলল। এয়ার লাইন এজেন্ট বলল, স্যার এই তিনজনের একজন খুব ভাল সাউথ ইন্ডিয়ান একসেন্টে আমার সাথে গত দুইদিন কথা বলেছে; তাই আমি ভেবেছি ওরা ইন্ডিয়ান, আমার ভুলের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি...।
এয়ার পোর্টের জরিমানা ১৯৫ ডলার দিয়েই বিদেশীদের মতো ভাড়ায় পোখরা থেকে কাঠমান্ডু যেতে হবে, এটা ভেবে তিনবন্ধুই বিচলিত হয়ে গেলো; কেননা তারা এতো ভাড়া জানলে এই এয়ারের টিকিট ক্রয় করতো না। ওদিকে তিনজনের আসলেই পকেটে ডলার কম আছে...। একদিকে ডলার তেমন নেই, অন্যদিকে হাতে সময়ও কম।
এদিকে এয়ার পোর্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, যদি এই ফ্লাইট মিস হয় তাহলে বুদ্ধ এয়ার কিংবা এয়ার পোর্ট কোন পক্ষই তিনজনের বিমান ভাড়া বাবদ ১৩৫ ডলার আর ফেরত দিবে না...।
এরকম একটা আতংকজনক সময়ে এয়ার পোর্ট কর্তৃপক্ষ থেকে একটি শেষ সুযোগ দিয়ে বলা হলো, আপনার ১০০ ডলার জরিমানা দিয়ে এখনও এই ফ্লাইটে যেতে পারেন; কেননা আপনারা তিনজন আর এয়ার এজেন্ট দুইপক্ষই টিকেট বেচা-কেনায় ভুল করেছেন। আপনাদের জন্য এখন ইমিগ্রেশন পার হওয়া আর বোর্ডিং নেয়ার জন্য মাত্র ২০ মিনিট সময় হাতে আছে। ভেবে দেখুন, এই স্বল্প সময়ে কি করবেন? যা করার এখনই করুন...!?
তিনবন্ধু একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে আর কোন উপার খুঁজে পেলো না। অবশেষে আলম পকেট থেকে ডলার বের করলো, আর ১০০ ডলার জরিমানা দিয়ে দিলো। তারপর রানওয়েতে দাড়িয়ে থাকা বিমানে উঠার জন্য তিনবন্ধু বোর্ডিং এরিয়ার দিকে দ্রুত বেগে এগিয়ে গেলো...।
তিনজনের ১১০ ডলার করে বিদেশী হিসেবে মোট ৩৩০ ডলার টিকিট বাবদ লাগার কথা ছিল। এ যাত্রায় তিনজনের টিকিট বাবদ লাগছে ১৩৫ ডলার আর জরিমানা ১০০ ডলার সর্বমোট ২৩৫ ডলার। তার মানে হিসেব করলে ৩৩০ থেকে ২৩৫ বাদ; এই ফ্লাইট পোখরা থেকে টেক-অফ করে আবার কাঠমান্ডুতে টেক-অন করা বাবাদ তাদের তিন বন্ধুর সাশ্রয় মাত্র ৯৫ ডলার।
হিসেবের খাতায় ৯৫ ডলার সাশ্রয় রেখে আর তিনবন্ধু বিমানে গিয়ে বসে পড়লো। বুদ্ধ এয়ার টেক-অফ করার পরেই শুরু হয়ে গেলো হিমালয় রেঞ্জ দেখার মোহনীয় জাদুর খেলা...।
তিনবন্ধু আকাশ থেকে নেপালের আলোকিত পর্বত রেঞ্জ দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলো... কাঠমান্ডু এয়ার পোর্টে যখন ইমিগ্রেশন চেকিং হবে তখন বিদেশী টিকেট না কিনে ভারতীয় টিকেট কেন কেনা হয়েছে... এজন্য আবারও জরিমানা দিতে হবে নাতো?
---------------------------------------------------------------------------------------------------
© খোরশেদ খোকন । ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:১৩