"এক স্বপ্নদ্রষ্টা কীর্তিমান মানুষ ডঃ ইউনুসের আনস্মার্ট, ক্ষ্যাত, বোকা,প্রতিভাহীন, মেডিওকারদের জন্য কিছু অসাধারণ কথা"
ডঃ ইউনুসের বক্তৃতা শুণার এবং উনার সাথে কথা বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। পৃথিবীর সব কীর্তিমান মানুষগুলোই খুবই বিনয়ী হন এবং জটিল বিষয়গুলো খুবই সহজ, সরল, প্রাণ্জল এবং হৃদয়গ্রাহী করে বুঝানোর এক অদ্ভূত ক্ষমতা উনাদের রয়েছে। একটা জিনিস খেয়াল করলাম গুণি মানুষগুলো জটিল বিষয়গুলোকে অতি সাধারণ করে তোলে ধরেন। আর অল্পজানা মানুষগুলো সাধারণ বিষয়গুলোকে অতি জটিল করে তোলেন। গত কয়েকদিন আগে আমেরিকার কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দেয়া উনার বক্তৃতার কিছু সারাংশ এখানে অনুবাদ করে দেয়ার লোভ সামলাতে পারলামনা।
আমি একেবারেই ভুলপথে আমার কর্মজীবন শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেই ভুল উপায়গুলোই আজ এতো সুন্দরভাবে,সাবলীলভাবে সঠিক হয়ে গেলো চিন্তাই করতে পারিনি। এটা খুবই মজার ব্যাপার। সেই মজার ব্যাপারটিই তোমাদের না বলে পারছিনা।
আমি প্রথম গরীব, অসহায় মানুষগুলোকে ঋণ দেয়া শুরু করলাম। আর তা দেখে সবাই খুবই হাসাহাসি করলো। ওরা বললো- আমি মূর্খের মতো একটা কাজ করছি। শুধু মূর্খই না। এতো বড় বেকুব লোক ওরা পৃথিবীতে আর দেখেনি।
তারপরও আমি একবারে হতাশা থেকেই কাজটা শুরু করলাম। বাংলাদেশের মতো একটা গরীব দেশে এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলোনা । এখানে আপনি চিন্তা করবেন একটা, স্বপ্ন দেখবেন একটা কিন্তু হবে তার উল্টোটা। তখন, সবকিছু দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছিলো। আমারও একটা কাজ শুরু করা দরকার। তাই শুরু করে দিলাম।
আর আমি এমন একটা কাজ শুরু করলাম, বিশ্বাস করেন যে বিষয়ে আমার বিন্দুপরিমাণ ধারণা নেই।জানিনা ব্যাংক কি? কেমন করে চালাতে হয়। অথচ দেখেন- এই না জানা কাজটিতেই আমি আজ সফল হলাম।
যখন সবাই জানতে চায়- আমি কেমন করে ক্ষুদ্র ঋণর কাজ শুরু করলাম। আমি তাদের সত্যি কথাটাই বলি- ব্যাংকিং সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নাই। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা। যদি এবিষয়ে জানতাম-তবে কোনোদিনই, কোনো উপায়েই একাজ আমি শুরু করতে পারতাম না। তাই একথা ধ্রুব সত্যি -অনেক সময় না জানাটাই একটা বড় আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দেয়।
না জানা মানেই হলো কোনো একটা বিষয়ে তোমার মনটা এখনো মুক্ত। তোমাকে তখন প্রতিষ্ঠিত কোনো নিয়ম, কোনো কর্মধারা ইত্যাদি নানা জটিল ব্যাপারগুলো নিয়ে আর ভাবতে হবেনা। কোনো চিন্তা করতে হবেনা। এরপর-আমাকে বলা হলো-তবে একেবারে না জেনেই কীভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজ শুরু করলেন?
দেখেন, আমি আগেই বলেছি-ব্যাংকিং এর কিছুই আমি জানিনা। ফলে একটা লাভ হলো। আমি দেখলাম সাধারণ প্রতিষ্ঠিত কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম কি? কীভাবে ওরা কাজ করে? খুবই সতর্কতার সাথে আমি তাদের কার্যক্রম অনুসরণ করলাম।
তারা যা করতো আমি সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে শুরু করলাম। যেমন-কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবে।
তারা ধনীলোকদের কাছে যায়- আমি গেলাম গরীবের কাছে।
ওরা যায় পুরুষ মানুষের কাছে। ৯৭% ঋণ গ্রহীতা ওদের পুরুষ। আমি গেলাম মহিলাদের কাছে।৯৭% আমাদের ঋণ গ্রহীতা হলো মহিলা।
সাড়ে ৮ মিলিয়ন মহিলা আমাদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে।
কনভেনশনাল ব্যাংকের মালিক হলো একচেটিয়া ভাবে ধনীরা। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হলো শুধু গরীবরা।
কনভেনশনাল ব্যাংকের জামানত দরকার। গ্রামীন ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতারা নিজেরাই চলতে পারেনা। তাদের আবার জামানত কি? তাই জামানতের পুরো ব্যাপারটিই আমরা গ্রামীন ব্যাংক থেকে বাদ দিয়ে দিলাম।
একথা শুণে সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো।হাসাহাসি শুরু করলো। এটাও একটা ভালো ব্যাপার। যখন কেউ হাসাহাসি করবে, বিদ্রুপ করবে তখনই বুঝতে হবে। তোমার কাজ আলাদা। এই হাসাহাসিটাকে পজিটিভলি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ওরা শুধু হাসলোই না। আরো বললো- আরে এই লোক পাগল নাকি ?এটা কীভাবে সম্ভব! আমি বললাম-চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? ঐ যে আগেই বলছিলাম না- আমি প্রকৃত ব্যাংকিং এর ব্যাপারে কিছুই জানিনা বলেই এভাবেই শুরু করতে পেরেছিলাম।
যেহেতু আমাদের জামানতের কোনো বালাই নাই। সেজন্য আমাদের কোনো আইনজীবীরও দরকার নাই। আপনারা শুণে আশ্চর্য্য হবেন- পৃথিবীতে গ্রামীণ ব্যাংকই একমাত্র ব্যাংক যেখানে কোনো আইনজীবী নাই।কোনো আইনজীবী ছাড়া, কোনো জামানত ছাড়া বিলিয়ন ডলার গরীবদের ঋণ দিলাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি আমেরিকার মতো ধনী দেশেও গরীবদের জন্য নিউইয়র্কে ৫ টি গ্রামীনব্যাংকের শাখা রয়েছে। ৃণ গ্রহীতা ১০০% মহিলা এবং ৃণ পরিশোধের হার প্রায় ৯৯% ।
এসব কথা বলার কারণ হলো- কোনো বিষয়ে না জানলে ভয় পাওয়ার,থেমে থাকার, নিথর হয়ে বসে থাকার কোনো কারণ নাই।
কখনো মনে করবে না যে- কোনো একটা বিষয়ে শুরু করতে হলে তোমাকে খুবই স্মার্ট হতে হবে, দারুন প্রতিভাবান হতে হবে।
আমাদের মতো স্টুপিড লোকেরাই কাজ শুরু করে এবং সফল হয়।আর এখানেই হলো সত্যিকারের মজা। তাই তোমাদের বলছি- কোনো ব্যাপারে চ্যালেন্জ মোকাবিলায় ভয় পাওয়ার কিছুই নাই।
কনভেনশনাল ব্যাংক সবসময় বলে আসছিলো- গরীব মানুষের ঋণ গ্রহণের কোনো সক্ষমতা নাই। ওরা ক্রেডিট ওয়ার্থি নয়- এ কথা আমি মিলিয়ন বারের চেয়েও বেশী শুণেছি। শুণতে শুণতে বললাম- গরীব মানুষরা "ক্রেডিট ওয়ার্থি" এটা চিন্তা করার চেয়ে ব্যাংক "পিপল ওয়ার্থি" কিনা -সেটাই হলো আসল বিবেচনার বিষয়।
কাজেই স্রোতের বাইরে গিয়ে বিপরীতমূখি কাজ করা অথবা স্টুপিডভাবে কোনো কিছু শুরু করা খারাপ নয়। বসে না থেকে যেকোনো কিছু শুরু করাটাই আসল। পথ দেখানোর মতো হাজার লোক থাকবে। কিন্তু নিজের পথটুকু নিজেকেই হাঁটতে হবে। এই পথ অন্য কেউ আর পৃথিবীতে হেঁটে দিবেনা। আমিও আমার পথে হাঁটা শুরু করলাম। আর শুরু যখন করেছি- অবশ্যই একজায়গায় গিয়ে শেষ হবে।
হাঁটার পথ মসৃণ হবে নাকি পিছঢালা হবে, কাঁদা হবে নাকি শুকনো হবে-এসব চিন্তা করে ঘরে বসে থাকলে হবেনা। মাটিতে পা রাখাটাই আসল।
ডঃ ইউনুসকে সুদখোর হিসাবে গালি দিয়ে অনেকে খুবই তৃপ্তি পান। কিন্তু উনারা চিন্তা করে দেখেন না আমাদের পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাই সুদের উপরে।পোস্টের কলেবর বৃদ্ধি পাবে বলে শুধু দুটো কথা বলেই শেষ করছি।বাংলাদেশে ঠিক এ মুহুর্তে যে শিশুটি জন্ম নিলো তার ৃণ হলো ২২০ ডলার বা একটু এদিক ওদিক হতে পারে যা টাকায় ১৭,৬০০ টাকা।১৯৭৩-১৯৭৪ সালে যা ছিলো মাত্র ৫৪ ডলার। এই ৃণের সুদ আমার আপনার প্রিয় জন্মভুমিকেই পরিশোধ করতে হচ্ছে। অর্থ্যাৎ যে মাটির ওপর আপনি হাঁটেন সেটাও ৃণগ্রস্থ। এই গেলো একটি কথা।আরেকটি কথা হলো-বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ষোল আনা অথবা চৌদ্দ আনা ৃণ-সুদের সাথে জড়িত। কিন্তু সুদখোর হিসাবে গালি খান-শুধু ইউনুসই।
প্রেসিডেন্ট ওবামা দাঁড়িয়ে গলায় মেডেল পরিয়ে দিয়ে বলেন- আজ পুরো আমেরিকাবাসী গৌরবান্বিত হলো- আর আমরা গালিদেই- যা বেটা সুদখোর।
পৃথিবীর দশজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির একজন হিসাবে নির্বাচিত হয়ে পুরো দেশকেই গৌরবান্বিত করেন- আমরা বলি- তুই বেটা মহাজন, সুদখোর।
বার্সেলোনা মাঠে ডঃ ইউনুসের জন্য মানপত্র পাঠ করা হয়-আমরা বলি বেটা খুবই ধুর্ত, মহাজন, সুদখোর। এই হলো গুণীমানুষকে সম্মান দেয়ার নমুনা।আর এই গালির পরিমাণ বেড়েছে উনার নোবলে পুরস্কার পাওয়ার পরপরই।
যেন-এটা দেশের জন্য কোনো গৌরবের না- এই প্রাপ্তিটা যেন বিরাট একটা অপরাধ। মাঝে মাঝে এতো অবাক হই নিজের বাকশক্তিই রুদ্ধ হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:৩৬