বাইরে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। মাস্টার ভাইয়ের দোকানে বসে আমি অলস সময় কাটাচ্ছি। ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় মাত্র সপ্তাহখানেক।কাজের ফাঁকে তিনি অদ্ভূত সুন্দর গল্প করেন। টুকটাক কাজে সাহা্য্য করার জন্য দোকানে একটা ছেলে আছে । নাম মজীদ। তিনি মজীদকে ডেকে বললেন-"মজীদ আমাদের দুই কাপ চা দে"। তা ভাইজান আপনার সাথে যে গল্পটি আমি করছিলাম।
আমি বলি, হ্যাঁ। ছোট ছেলে ইয়াকুব চোখ কচলাতে কচলাতে বাড়ি আসলো। এতোটুকু বলেছিলেন।
ও আচ্ছা। ইয়াকুবের মা ছেলের হাত, মুখ ভালো করে ধোয়ে খাবার খেতে দিলেন। ঠিক এমন সময় নামলো ঝমাঝম বৃষ্টি।
মজিদ দুকাপ চা দিয়ে আমার পাশের টুলে বসে। ফিক করে হেসে বলে-ওস্তাদ নতুন গল্প নাই। সেই একই গল্প আর কয়জনকে শুণাবেন।
মাস্টার ভাই মজীদের কথায় কান না দিয়ে উনার গল্প বলতে থাকেন। আমি তন্ময় হয়ে শুণি।
ইয়াকুবের ভাতের প্লেটে শণের ছাউনি ভেদ করে টপাটপ কয়েকফোঁটা বৃষ্টি পড়ে। টিনের প্লেটে বৃষ্টি পড়ে টুং করে ওঠে। ইয়াকুব এবার অন্য জায়গায় গিয়ে বসে। কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটা থেকে সে বাঁচতে পারেনা। মা শাড়ি দিয়ে ছেলের মাথা মুছতে মুছতে বলেন- তুই যেখানে বৃষ্টি পড়ে সেখানে বসিস কেন? আন্ধা নাকি, তোর চোখ নাই?
ইয়াকুব একহাতে ভাত খায় আর আরেক হাতে চোখ কচলায়।
মা শাড়ীর আঁচল এবার ছেলের চোখের উপর রেখে মুখে জোড়ে ফুঁ দিয়ে বলেন- চোখ বেশী কচলাইছ না। ঘুম থেকে ওঠলেই ভালো হয়ে যাবে। আর তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠ। খেলতে হবেনা?
মজীদ পাশ থেকে বলে- "মা-তোমার এই এক খেলা ছাড়া আর কোনো খেলা নাই"-ইয়াকুব এখন এই কথাটি বলবে তাই না ওস্তাদ?
মাস্টার ভাই, মাথা নেড়ে মজীদের কথায় সায় দেন।
ইয়াকুব গামছা দিয়ে মায়ের চোখ শক্ত করে বেঁধে দূরে চুপ করে দাঁড়ায়। মা বাঁধা চোখে ছেলেকে খুঁজতে থাকে। কিছুক্ষণ খুঁজাখুঁজির পরই ঝাপটে ছেলেকে ধরলে দুজনেই একসাথে হোহো করে হেসে ওঠে। মা হাসতে হাসতে এবার ইয়াকুবের চোখ বাঁধেন।
কিন্তু ইয়াকুবকে আর বেশীক্ষণ খুঁজতে হয়না। মা সহজেই ছেলের কাছে ধরা দেন। প্রতিদিনই মা ছেলের এই কানামাছি খেলা চলতে থাকে।
আরেকদিন, মায়ের চোখ বাঁধা। মা বলে দেখি, আজকের খেলায় জিতে কে? মায়ের এক হাতে সুঁই আর আরেক হাতে সুতো। ছেলে মুগ্ধ হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পরই মা সুঁইয়ের ভিতর সুন্দর করে সুতো ঢুকিয়ে দেন। এবার ইয়াকুবের পালা। বাঁধা চোখে তার কচি দুহাত থিরথির করে কাঁপছে।
মা ছেলের দিকে অপলক চেয়ে আছেন। ইয়াকুব চেষ্টা করেই যাচ্ছে। ঠিকমতো পারছেনা। মায়ের চোখ বেয়ে অশ্রু নামে। যেটা ইয়াকুব দেখতে পায়না। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু পারলোইনা। অবশেষে মা ছেলের চোখের বাঁধন খুলে দেন। ছেলে দু হাতের পীঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মাকে দেখে বলে- মা তোমার চোখ লাল কেন? তুমি কি কাঁদছো?
নারে বাবা - কাঁদছি না । মনে হয় চোখে কিছু পড়েছে। এভাবে মা আর ছেলের এই অদ্ভূত খেলা প্রতিদিন চলতেই থাকে।দিন,সপ্তাহ, মাস যায়। খেলাগুলো ক্রমে আরো জটিল হয়।
আমি বলি-মাস্টার ভাই। মা আর ছেলের মাঝে দেখি এ এক অদ্ভূত ভালোবাসার সম্পর্ক। তো এ খেলায় জিতলো কে?
বৃষ্টি এখন যেন ঝড় হয়ে নামছে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমক আর মেঘমাল্লার গর্জন।
মজীদ চায়ের কাপখানা হাতে নিতে নিতে বলে "ওস্তাদ ,আপনার চা আজকেও আবার ঠান্ডা হলো।"
মাস্টার ভাই -ড্রয়ারের ভিতর থেকে পলিথিনে মোড়া একখানা কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, "পড়ে দেখেন। তাহলেই বুঝতে পারবেন- খেলাটায় জিতলো কে"?
আমি কাগজখানা খুলে হাতে নেই। দেখেই মনে হচ্ছে- কোনো এক ডাক্তারের দেয়া অনেক পুরানো একটা ব্যবস্থাপত্র।
রোগীর নাম- ইয়াকুব আহমেদ। বয়স- ৮। নীচে রোগের ও নানান ঔষধপত্রের নাম লেখা। তারও নীচে লেখা- বয়স বাড়ার সাথে সাথে চোখের জ্যোতি কমবে। চার-পাঁচ বছরের ভিতরে ছেলে পুরো অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
কাগজটি পড়ে চমকে ওঠি।
কি অবাক হচ্ছেন আপনি? জ্বি সবাই আপনার মতোই অবাক হয়।ইয়াকুবের বয়স যখন বারো তখনই তার মা মারা যান। এই কাগজটি পাওয়া যায় মায়ের বালিশের নীচে। মা মারা যাওয়ার দুমাস আগেই বেচারা ইয়াকুব পুরো অন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এর আগেই তার মা তাকে শিখিয়ে যান কীভাবে অন্ধচোখে সুঁইয়ে সুতো ঢুকাতে হয়। কাপড় কাটতে হয়।সেলাই মেশিন চালাতে হয় সব কিছু। কথা বলতে বলতে এবার তিনি ড্রয়ার থেকে খুব যতন করে রাখা- একটা প্যাকেট বের করেন। প্যাকেটের ভিতর ভাঁজ করে রাখা একটা জামা। হাতে নিতে নিতে বলেন- এটা হচ্ছে ইয়াকুবের হাতে তৈরি করা তার মায়ের জন্য জামা। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে মা খুব খুশী হয়ে অন্ধ ছেলের হাতে বানানো জামা পরতে পরতে বলেছিলেন-"আমার ছেলেকে আর কোনোদিন ভিক্ষা করে খেতে হবেনা"। এই জামা পরেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদেয় নেন।যে জামায় এখনো ইয়াকুব তার মায়ের গন্ধ খুঁজে পায়। বিশ্বাস করেন-ভাইজান। জীবনে একটি কাপড়ও ইয়াকুব ভুল করে কাটেনি। একবারও উল্টাপাল্টা কোনো কাপড় সে সেলাই করেনি।
এই অদ্ভূত গল্প শুণতে শুণতে আমি বলি- তা ইয়াকুব কি জানতো না যে সে অন্ধ হয়ে যাবে? তার মা কি এ কথা তাকে কখনো বলেন নি?
জ্বিনা। পৃথিবীর এতো সুন্দর রঙের ভূবন দেখতে দেখতে একটা ছেলে ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যাবে-সেকথা মা তার অবুঝ ছেলেকে কেমন করে বলবে! তাই, কোনোদিন মা তাকে সেটা বুঝতেও দেয় নি। মা সারাদিন কাজের ফাঁকে একটু অবসর পেলেই নিজের চোখ বেঁধে রাখতেন। এখন বুঝতে পারি,মা ছাড়া এতিম ছেলের অন্ধ জীবন কেমন করে যাবে, হয়তোবা সেটা ভেবেই নিজের চোখ অন্ধ করে ছেলের দুঃখ বোঝার চেষ্টা করতেন।
তা, এই ডাক্তারী ব্যবস্থাপত্র, এই জামা এসব আপনি কোথায় পেলেন?
মাস্টার ভাই কাপড় কাটার কাঁচি একপাশে রেখে আস্তে করে এবার চোখের চশমাটা খুলে-চোখ মুছেন। ভারী কন্ঠে বলেন- বারো বছরে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়া আমিই সেই ইয়াকুব। টেইলর মাস্টার ইয়াকুব। সবাই ভালোবেসে মাস্টার ভাই বলে ডাকে। আমি অবুঝ ধীরে ধীরে অন্ধ হচ্ছিলাম আমার জন্ম অসুখে। আর আমার আদরের মা অন্ধ হয়েছিলেন তার পুত্র শোকে। কী অদ্ভূত তাই না !
মাস্টার ভাই বলতে থাকেন- একটা কুমির মা একটানা ২০ দিন না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। সন্তানের যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায় এই দুঃচিন্তায়। একটা মাকড়শা নিজের শরীর খাইয়ে সন্তানদের বড় করে তোলে। একটা টিকটিকি মা বুকে বাচ্চাকে নিয়ে সপ্তাহ ঝুলে থাকে যদি বাচ্চা টিকটিকি হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে নীচে পড়ে যায়। আর এক মানুষ মা নিজের সন্তানের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে দিন,সপ্তাহ, মাস, বছর পার করে দেন। অদ্ভূত। বড়ই অদ্ভূত। আর একমাত্র মায়েরাই এই অদ্ভূত ভালোবাসার সওয়ারী হতে পারেন।
মাস্টার ভাইয়ের শেষ দিকের কথাগুলো আমার বুকে এসে যেন তীরের মতো বিঁদে।আমি আর কিছুই শুণতে পারছিনা। বুকের ভিতর হাহাকার করে ওঠে। কান্নার বাঁধ ভাঙ্গা আওয়াজ শুণতে পাই। প্রবল ঝড়ের মাঝে আমি নীচে নেমে বৃদ্ধাশ্রমের দিকে দ্রুত দৌড়াতে থাকি। মা ডাকছেন- আয় খোকা আয়। কতদিন আমার বৃদ্ধা দৃষ্টিহীন মাকে দেখা হয়নি।
© আরিফ মাহমুদ
আটলান্টা
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:৪৭