(এটি কোনো গল্প নয়, সত্য ঘটনা। তাই, বিনীত অনুরোধ করবো একটু সময় নিয়ে এ অসাধারণ শিক্ষণীয় গল্পটি পড়ার জন্য। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার জন্য। আপনার মাধ্যমেই হয়তোবা অন্ততঃ একজন মানুষের চিন্তা বদলে যেতে পারে। সত্যিকারের মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটতে পারে। মনপ্রাণে চাই এ গল্পের মূল ম্যাসেজটি যেন বেশী বেশী মানুষের কাছে পৌঁছায়। আর ব্লগ কর্তৃপক্ষ যদি প্রয়োজন মনে করেন তবে পোস্টটি স্টিকি করে অসংখ্য পাঠককে পড়ার সুযোগও করে দিতে পারেন- বিনম্র ধন্যবাদ)
চার্লস প্লাম্ব একজন যুদ্ধ বিমানের পাইলট। জীবনে ৭৫ টি কমবেট মিশনে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অংশগ্রহণ করেন। আমেরিকা আর ভিয়েতনাম যুদ্ধে সেদিন ছিলো তার সর্বশেষ মিশন। সে যেন এক দুঃস্বপ্নের দিন।
ভূমি থেকে নিক্ষিপ্ত এয়ার মিশাইলের আঘাতে তার বিমান তখন আকাশে পুড়ছে। শিকারীর রাইফেলের গুলিতে উড়ন্ত পাখি যেমন দিশাহারা হয়ে ভূমিতে পতিত হয়- চার্লস প্লাম্বের অবস্থাও ঠিক তেমন। ভূমি থেকে ২৮ হাজার ফুট উঁচুতে অগ্নিদগ্ধ এক যান্ত্রিক যান। আর তার ভিতরে পুড়ছে এক মানব পাখি।
চার্লসের হাতে সময় বেশী নেই । মাত্র কয়েক সেকেন্ড। অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্লেনের ভিতর থাকলে পুড়ে মরতে হবে। আর প্যাারাসুট নিয়ে লাফ দিলে হয়তোবা জীবন বাঁচবে । কিন্তু শত্রুপক্ষের কাছে বন্দি হয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে কারাগারের প্রকোষ্টে ।
চোখের সামনে ভাসছে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর মুখ। শুধুই খবর পেয়েছেন। ছেলের চেহারা দেখার সুযোগ আজো হয়নি। ভাবলেন, আগে জীবন বাঁচুক। নিজে মুক্ত হতে না পারেন।কিন্তু সন্তানতো পিতাকে দেখে যাবার সুযোগ পাবে।
তিনি প্যারাস্যুট নিয়ে লাফ দিয়ে শত্রপক্ষের কাছে ধরা দিলেন। সুদীর্ঘ ছয়টি বছর কারাগারে থাকার পর ফিরে আসলেন ক্যানসাস শহরে তার আপনজনদের কাছে ।
চার্লসের ছেলে বব এখন অনেক বড় হয়েছে। আগামী সপ্তাহে ইউএস ন্যাভিতে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণে চলে যাবে। চার্লস পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে এসেছেন ডীনার করতে।
এমন সময় একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে জিগ্গাসা করলো-
আপনি ক্যাপ্টেন চার্লস প্লাম্ব, তাই না?
হ্যাঁ। আমি চার্লস। আপনাকেতো চিনলাম না।
আপনি ইউএস ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এয়ার ক্রাফট ক্যরিয়ার কিটি হ্যাওকে ছিলেন। আপনার যুদ্ধ বিমানে আগুন লাগে। আর আপনি প্যারাস্যুটের মাধ্যমে জাম্প দিয়ে জীবন বাঁচান।
জ্বি। সেতো অনেকদিন আগের কথা। কয়েক সেকেন্ড দূরত্বেই সেদিন মৃত্যুকে খুব কাছ থেকেই দেখেছিলাম। কিন্তু আপনাকে এখনো আমি চিনতে পারিনি। আর আপনিই বা এতোসব কিছু জানেন কেমন করে?
স্যার, আমাকে আপনার চিনার কথাও না। এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার কিটি হাঔকের আমি ছিলাম সাধারণ একজন সেইলর। আমার কাজ ছিলো- আপনার প্যারাস্যুট প্যাক করে দেয়া। আশাকরি সেটা সেদিন ঠিকমতোই কাজ করেছিলো।
লোকটি এতোটুকু বলে স্যালুট দিয়ে অল্পদূরে নিজের টেবিলে গিয়ে বসে।
চার্লসের মুখ থেকে যেন আর কোনো কথা বের হয়না। স্ত্রী আর পুত্র টেবিলের অন্যপাশে বসে আছে। ছেলে বব বুঝে ওঠতে পারছেনা বাবার হঠাৎ করে কি এমন হলো?
চার্লস চোখ বন্ধ করে লোকটির চেহারা মনে করার চিন্তা করেন। সাধারণ সেইলরের পোষাকে এই লোকটি সেসময় দেখতে কেমন ছিলো? এবার মনে পড়ে -অনেকবার তিনি এই লোকটিকে এয়ার ক্রাফট ক্যারীয়ারে দেখেছেন। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কতবার গটগট করে এই লোকটির সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছেন। কিন্তু কোনোদিনও তার নামটি জানতে চাওয়া হয়নি? জানার ইচ্ছেও জাগেনি। বলা হয়নি কোনোদিন- তুমি কেমন আছো? জানতে চাওয়া হয়নি কোনোদিন তার কোনো কোশলাদি। আর হবেই বা কেন?উনি যে ছিলেন একজন যুদ্ধ বিমানের পাইলট আর লোকটি ছিলো অতি নিম্মপদবীর এক সামান্য সেইলর।
চার্লস নিজ পুত্র আর স্ত্রীকে নিয়ে এবার লোকটির সামনে আসেন। লোকটি চিন্তা করে ঘটনা কি? মনে মনে ভাবে একজন উর্ধ্বতন জাঁদরেল বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা'র সাথে এভাবে কথা বলা হয়তোবা শোভন হয়নি। সে চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়।
এরপর ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা। চার্লস বলেন- আপনি দাঁড়াবেন না ।আপনি বসুন। আপনি জানতে চেয়েছিলেন, সেই প্যারাসুট সেদিন ঠিকমতো কাজ করেছিলো কিনা?
লোকটি এবার সত্যি ভয় পায়? প্যারাস্যুট কি তবে ঠিকমতো কাজ করেনি সেদিন?
ক্যাপ্টেন চার্লস এক হাতে নিজ পুত্রকে ধরেন আরেক হাতে ধরেন স্ত্রী'র হাত। তারপর, তিনজনে একসাথে অতি নিমপদবীর সেইলরকে স্যালুট দিয়ে চার্লস বলেন- সেই প্যারাস্যুট যদি সেদিন ঠিকমতো কাজ না করতো তাহলে আজকে আমি আর এখানেই থাকতাম না। আমার দেহ সেদিন সেই মহুর্তেই আকাশেই ভস্মীভূত হয়ে ছাই হয়ে যেতো।
কোনোদিন আপনার কাছে কোনো কোশলাদি জানতে চাওয়া হয়নি। জানতে চাওয়া হয়নি আপনি কেমন আছেন? জানি, প্যারাস্যুট প্যাক করে দেয়াটা ছিলো আপনার চাকুরীর অংশ। সামান্য কোনো ভুল হলে, অথবা কাজে এতটুকু দেরী হলে প্রচন্ড ধমক খেয়েছেন। শাস্তি হয়েছে। অথচ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এমনকি হয়তোবা বছরের পর বছর যে একাগ্রতার সাথে এ কাজটি আপনি করে গেছেন। সেজন্য কোনোদিন এতটুকু ধন্যবাদ পর্যন্ত আপনাকে জানানো হয়নি।
আজ আমার সুযোগ এসেছে-হয়তোবা এজন্যই আমাকে স্রষ্ঠা বাঁচিয়ে রেখেছেন। এতোটুকু উপলব্দি করার জন্য যে, এ জীবনে কোনো কাজই তুচ্ছ নয়। এ সমাজে কেউ অচ্ছুত নয়। পদমর্যাদায় সবাই হয়তোবা সমান না ।তবে মানুষ হিসাবেই সম্মানীয়। স্যালুট আপনাকে স্যার। আজ আপনিই আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।
এ ঘটনািট লিখতে গিয়ে নিজের জীবনেরই একটা কথা মনে পড়লো। আমার এক পরিচিত বড় ভাই তখন আর্মির ক্যাপ্টেন হয়েছেন। ধরাকে সরা গ্যান মনে করেন। মানুষকে মনে করেন তেলাপোকা বড়জোর হলে টিকটিকি। একদিন ওনার মোটর সাইকেলের পেছনে শাহবাগ হয়ে টিএসসি'র দিকে যাচ্ছি। এমন সময় একজন ট্রাফিক পুলিশ দাঁড় করিয়ে লাইসেন্স চাইলো।
সাথে সাথেই বড় ভাইয়ের সে কি চীৎকার। ব্লাডি ( এটা আর্মিদের মনে হয় একটা নিজস্ব স্টাইল,দুনিয়ার সবাইকে ব্লাডি বলে ধমক দেয়া)-তুই আমাকে চিনিস? জানিস আমি কে? তোর বসকে ডাক। এতোবড় স্পর্ধা সামান্য একটা ব্লাডি কনস্টেবল। আমাকে তুই রাস্তায় দাঁড় করিয়ে লাইসেন্স চাস? আমি তোর বাপ। যা, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক।
আমার তখন মনে হলো- হে রাব্বুল আলামীন। এই ট্রাফিক পুলিশকে পৃথিবীর সব মানুষ দেখলেও ওনার পুত্র কন্যাদের কেউ যেন উনাকে এই অবস্থায় না দেখে। পিতার চোখের সামনে পুত্রের অমর্যাদা হয়তোবা সহ্য করা যায়। কিন্তু পুত্রের চোখের সামনে পিতার এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো পুত্রের কাছেই সহ্য হবেনা।
কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম-একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে একজন ম্যজিস্ট্রেট পদবী'র কেউ শত মানুষের সামনে কলার ধরে শাসাচ্ছে। সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দীকিকে দেখেছিলাম-একজন কর্মকর্তাকে পানিতে নামিয়ে দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করাতে। অন্যান্য মন্ত্রী মহোদয়দেরকেও মাঝে মধ্যে প্রায় চড় থাপ্পড় মারতে দেখা যায়। রনি ভাইকেও একবার দেখেছিলাম দিন দুপুরে ফ্রী কিক চালাতে। বড় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে অনেকদিন আগে দেখেছিলাম ( নাম মনে হয় এডিসি কোহিনূর) একজন অতি বৃদ্ধ মানুষের কলার চেপে ধরতে। এগুলো হলো বড় ঘটনা। মাঝে মাঝেই ঘটে। আর বুকের ভিতর কেঁপে কেঁপে ওঠে।
এরকম, প্রতিদিন কত শত রিকসাড্রাইভার প্যাসেন্জারের কাছ থেকে, বাসের হেল্পার যাত্রীর কাছ থেকে, শ্রমিক মালিকের কাজ থেকে, কাজের ছেলে গৃহকর্তার কাজ থেকে, হলের সাধারণ ছাত্র ছাত্রী দলীয় ক্যাডারদের কাজ থেকে, অফিসের কেরানী বসের কাছ থেকে সামান্য ভুলের জন্য চড় থাপ্পড় ধমক অবিরাম খেয়েই যাচ্ছেন।
অথচ যে ছেলেটি দিনের পর দিন শার্ট ইস্ত্রি করে দিলো -তাকে কোনোদিন কি ধন্যবাদ দিয়েছি? কিন্তু যদি কখনো এতোটুকু কাপড় নষ্ট হয়-সেদিন ধমক দিতে দেরী করিনি।
যে কাজের লোকটি প্রতিদিন ঘরদোর পরিষ্কার করে রাখলো- তাকেও কি কোনোদিন ধন্যবাদ দিয়েছি? অথচ কাজে এতোটুকু অবহেলা হলে রেহাই দেইনি।
যে ট্রাফিক পুলিশ শীতে , বর্ষায়, গরমে, সকালে , দুপুরে , রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ট্রাফিক কন্ট্রোল করে সেবা দিয়ে গেলো- তাঁকে কি কোনোদিন ধন্যবাদ দিয়েছি? অথচ ক্ষমতার সুযোগ পেলেই ইচ্ছেমতো শাসিয়ে দিয়েছি।
যে রিকসার ড্রাইভার- প্রতিদিন গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে গেলো-তাঁকেও কি একবার ধন্যবাদ দিয়েছি? অথচ একটু দেরী হলে-প্যাডেল জোরে চাপ দিতে না পারলে রীতিমতো চড়াও হয়েছি।
যে বৃদ্ধ খেয়া মাঝি স্রোতের আর জীবনের প্রতিকূলে নৌকা বেয়ে ঘাট পার করে দিলো- তাঁকে কি ধন্যবাদ দিয়েছি? অথচ শার্টে একটু কাদা অথবা জল লেগে গেলে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়েছি।
যে ছেলেটি প্রতিদিন ক্যান্টিনে খাবার পরিবেশন করে গেলো-তাকেও কি একবার ধন্যবাদ দিয়েছি? অথচ একটু এদিক ওদিক হলেই ইচ্ছেমতো চড় থাপ্পড় মেরে ছাত্রত্বের বাহবা নিয়েছি।
যে ফেরীওয়ালা সারাদিন ফেরি করে পণ্য সামগ্রী দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে, তাকেও কি কোনোদিন ধন্যবাদ দিয়েছি? অথচ নিজের এতোটুকু মর্জি মাফিক না হলে, একটু জোরে চেচিয়ে ফেরী করলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছি।
রোদে পুড়ে , জলে ভিজে যে কৃষক ফসলের মাঠ থেকে খাবার আমার একেবারে টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলো তাঁকেও কোনোদিন ধন্যবাদ দেইনি। ষোল , আঠারো ঘন্টা গার্মেন্টসের ভিতর বন্ধি হয়ে যে মেয়েটি আমার বস্ত্র তৈরী করলো তাকেও কোনোদিন ধন্যবাদ দেইনি। যে শ্রমিক ইট ,কংক্রিট, পাথর ভেঙ্গে ভেঙ্গে আমার মাথার ওপর ছাদ তৈরী করে দিলো তাকে ও কোনোদিন ধন্যবাদ দেইনি। যে কুলি, দিনমজুর আমার ইয়া বড় বড় লাগেজ,স্যুটকেস বাসে, ট্রেনে, গাড়ীতে তোলে দিলো তাকেও কোনোদিন ধন্যবাদ দেইনি।যে মুচি আমার জুতো হাতে নিয়ে চকচক করে দিলো-তাকেও কোনোদিন ধন্যবাদ দেইনি।যে মুয়াজ্জিন প্রতিদিন ভোরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আযান দিয়ে আমাকে প্রার্থণা করার জন্য আহ্বান জানালো তাঁকেও কোনোদিন ধণ্যবাদ দেইনি।
এরা হয়তোবা ক্যাপ্টেন চার্লসের মতো আমাদের কাউকেই মৃত্যুর হাত থেকে সরাসরি বাঁচায়নি ।তবে এদের সবার মিলিত অবদান আমাদের জীবন বাঁচানোর একেকটি প্যারাস্যুট প্রতিদিনই তৈরি করে দিয়েই যাচ্ছে।
আজ আমেরিকার "থ্যাঙকস গিভিং হলি ডে"। একটা অসাধারণ জীবন দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীর অপরুপ রুপ দেখানোর জন্য রাব্বুল আলামীনের প্রতি ধন্যবাদ, শোকরিয়া জানাচ্ছি। চুপ মেরে সেদিন মোটর সাইকেলের পেছনে বসে থেকে একজন নিরাপরাধ ট্রাফিক পুলিশের কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো প্রতিবাদ করতে না পারায় আজ এতোদিন পর আপনার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আর যারা নানাভাবে প্রতি পদে পদে নীরবে, নিভৃতে, একাগ্রতার সাথে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ক্লান্তিহীন, বিরামহীন ভাবে আমাদের জন্য প্যারাস্যুট প্যাক করে দিয়েই চলেছেন। তাদেরকে আর ধন্যবাদ জানালাম না।
বরং দাঁড়িয়ে আপনাদের সবাইকে স্যালুট জানালাম।স্যালুট, স্যালুট, স্যালুট।