আমার মায়ের বলা দশটি মিথ্যা কথা
এই পৃথিবীতে কত মানুষ রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যায় জানেন? ক্ষুধার যে কী ভয়াবহ যন্ত্রণা তাও কি জানেন? আমার চেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রনা আর কেউ কি বুঝেছে? না খাওয়া কতরাতের যে মৃত্যু ঘটেছে আমার পেটের ভিতর আমার ছোট শৈশবে।এমনি একদিন রাতে খেতে বসেছি। মা কোনোরকমে অল্প এক প্লেট খাবার যোগাড় করে সামনে দিয়েছেন।আমি অর্ধেক খেয়ে মা'র দিকে প্লেট বাড়িয়ে দিলাম। মা বললেন, আমি আগেই খেয়ে নিয়েছি।আমার আর কোনো ক্ষুধা নেই।তুই সবটুকু খা বাবা।-আমি ভিতরে ভিতরে কাঁদলাম আর বুঝলাম এটাই ছিলো মায়ের বলা প্রথম মিথ্যা কথা।
শৈশবে পা রাখতেই একবার আমার ভয়ানক গুটি বসন্ত হলো।মা প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলেন।আমার নিঃশ্বাস শুধু আসে আর যায়। মা সারারাত ঘুমান না।সারাক্ষণ নানারকমের ভয়ে আর উৎকন্টায় থাকেন। মা যেন নাওয়া,খাওয়া সব ভুলে গেলেন। আমার শ্বাস প্রশ্বাসের অবস্থা বুঝার জন্য মা আমার নাকের সাথে উনার গাল লাগিয়ে রাখেন।অল্পক্ষণের জন্য ঘুম থেকে জাগলেই দেখি মা অবিকল সেভাবেই আমার নাকের সাথে মুখ লাগিয়ে রেখেছেন।বললাম, মা তুমি ঘুমাবে না? একবার খেয়ে আসো ।রাতেও কি তুমি কিছু খাবেনা।মা বললেন, তোকে ঘুমে রেখে আমি ঠিকই খেয়ে নিয়েছি।
এটা ছিলো আমার মায়ের ২য় মিথ্যা কথা।
বাজার থেকে ভালো মাছ কেনার কোনো সামর্থ্য ছিলোনা মায়ের।কিন্তু আমার পুষ্টি নিয়ে ছিলো তার বড় দুঃশ্চিন্তা।সারাদিন সংসারের খাটুনির পর মা পাশের জলাশয়ে মাছ ধরতে যেতেন।একদিন কী যেন দুটি মাছ বড়শীতে ধরে বাসায় নিয়ে আসলেন। আহ! সেদিন মায়ের মুখে যে কী খুশী।রাতে খাবারের সময় মা মাছ দুটি আমার প্লেটে দিলেন। আমি একটি মাছ মায়ের প্লেটের দিকে এগিয়ে দিলে মা বললেন, মাছ খেলে আমার পেটে বড় বদহজম হয়। তাই আমি মাছ খাইনা। আমি তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে এসে দেখি, মা নিচু হয়ে বসে আমার ফেলে দেয়া মাছের কাটা চিবুচ্ছেন। আমার চোখের কান্না মাকে বুঝতে দিলাম না।
শুধু বুঝলাম-এটা ছিলো আমার মায়ের বলা ৩য় মিথ্যা কথা।
আমি স্কুলে ভর্তি হলে সংসারের খরচ আরো বেড়ে গেলো। বাড়তি টাকা কোত্থেকে আসবে? মা পাশের একটা নার্সারির সাথে যোগাযোগ করে, অনেকগুলো পলিথিনের ছোট ছোট ব্যাগ নিয়ে বাসায় আসলেন।মা সারাদিন ঘরের কাজ করে ,রাতের বেলা পলিথিনেরে ছোট ছোট ব্যাগগুলো মাটি দিয়ে পূর্ণ করতেন।একদিন রাত জেগে দেখি মা মাটির দেয়ালে হেলান দিয়ে কুপির আলোতে মাটি ভরছেন। আমি বললাম, মা অনেক রাত হলো, এবার ঘুমাও।
মা বললেন, বিশ্বাস কর, আমি একটুকুও ক্লান্ত না।ঘুমাবার জন্য সারারাতইতো পড়ে আছে।অথচ আমি দূর থেকে ভেসে আসা মোয়াজ্জিনের আযানের ধবনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
এটা ছিলো আমার মায়ের চতুর্থ মিথ্যা কথা।
একদিন স্কুল থেকে প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরলাম। পুরো শরীর থিরথির করে কাঁপছে।রাতে প্রচন্ড জ্বর আসলো।মা কোত্থেকে যেন কীভাবে একবাটি সাগু যোগাড় করলেন।আমি বিছানায় শুয়ে আছি ।মা এক চামচ করে করে আমার মুখে দিচ্ছেন। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙগলো। দেখি মায়ের একটি হাত বালিশের উপর আর সেই হাতের ওপরই আমি ঘুমিয়ে আছি।মাকে বললাম, মা ঘুমাও নি? মা বললেন-হুম ঘুমিয়েছিলামতো। এইমাত্র জাগলাম। আসলে ঘুমের মাঝে যদি মায়ের হাতখানা নড়ে গিয়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় তাই সারারাত মা একটুকুও ঘুমাননি।
এটা ছিলো আমার মায়ের ৫ম মিথ্যা কথা।
ইতোমধ্যে আমার প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষার সময় এসে গেলো। সূর্যের প্রচন্ড দাবদাহ। মা এই প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষায়।পরীক্ষা শেষ হলে আমি দৌড়ে মায়ের কাছে আসতাম।মা তার আঁচলের নীচে আমাকে টেনে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতেন। তারপর কীভাবে যে টাকা যোগাড় করতেন তা আমি জানিনা। একটা কচি ডাব আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলতেন-এক চুমুকে সব খেয়ে ফেল মানিক।
আমি অল্প পান করে মা কে বলতাম, মা তুমি একটু খাও। মা বলতেন, আমার যে একটুকুও তৃষ্না নাই।
এটা ছিলো আমার মায়ের ৬ষ্ঠ মিথ্যা কথা।
তারপর, একদিন কী যে হলো।কিছুই বুঝতে পারলামনা।আমাকে আর আমার মাকে এক জটিল পৃথিবীতে বড় নিঃস্ব, বড় অসহায় রেখে আমার বাবা চিরতরে হারিয়ে গেলেন। কয়েকবছর পরপর বাবা হুট করে আসতেন,তারপর আবার চলে যেতেন।মানুষের মুখে শুনতাম মদ, জুয়া আমার বাবাকে আর্থিক দিক দিয়ে এবং শারীরিক দিয়ে দিয়ে দুভাবেই একেবারে শুণ্য করে ফেলেছে।মৃত্যুর আগে বাবা, মায়ের হাত ধরে বললেন-আমি এইবার তোমার কাছে ফিরে এসেছি।তোমাদের ছেড়ে আর কোথাও যাবোনা। আমাকে ছেড়েও তোমরা কোথাও যেওনা।অথচ বাবা আমাদের শুণ্যে রেখে একেবারে না ফিরার দেশেই চলে গেলেন।দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়। আমার মায়ের মুখ শুকাতেই থাকে। প্রতিবেশীরা আমার মাকে নতুনকরে সংসারী হওয়ার পরামর্শ দিলো। মা আমাকে বুকের সাথে আগলে নিয়ে বললেন-আমার আর কোনো অবলম্বনের দরকার নেই, আমার আর কোনো ভালোবাসারও দরকার নাই।
এটা ছিলো আমার মায়ের ৭ম মিথ্যা কথা।
ধীরে ধীরে আমিও বড় হতে লাগলাম। মা বৃদ্ধা হতে লাগলেন। আমি হাইস্কুল পাশ দিয়ে শহরের কলেজে ভর্তি হয়ে কয়েকটা টিউশনি শরু করলাম।মা বাড়ির পিছনে ছোট জায়গায় নানা রকমের সবজি চাষ করে, ঘরে মুরগী লালন পালন করে আমার পড়ালিখার খরচ যোগাতে লাগলেন। মাকে বললাম, মাগো আমি অনেক টাকা পাই।তুমি এইটাকাগুলো নাও। সারাজীবন কষ্ট করেছো মা।এবার একটু বিশ্রাম নাও।মা হাসেন।তারপর আরো বাড়তি কিছু টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন আমার প্রচুর টাকা আছে সোনা।এই টাকা তুই রাখ।আমার বাড়তি কোনো টাকার দরকার নেই।
এটা হলো আমার মায়ের ৮ম মিথ্যা কথা।
ভালোভাবে পড়ালিখা শেষ করে ভালো রেজাল্ট করে আমি শহরে বেশ ভালো একটা চাকুরি শুরু করলাম। সুন্দর একটা এ্যাপার্টমেন্ট ভালো করে গুছিয়ে মাকে নিয়ে আসলাম।এক সপ্তাহ পর মা বলেন, এই শহরে আমার একটুকুও ভালো লাগেনা।দম বন্ধ হয়ে আসে।।আসলে প্রতিদিন ঘরের জানালা খুলে বাবার কবরের দিকে চেয়ে মোনাজাত না করলে যে মা'র মনে শান্তি আসেনা। বাবা মৃত্যুর আগে মায়ের হাতে হাত রেখে বলেছিলেন, বাবাকে ছেড়ে যেন মা কোথাও না যান। তাইতো মা সবসময় সেখানেই থাকতে চান।অথচ
মা বললেন,এই শহুরে সুখের জীবন মা'র একেবারেই ভালোই লাগেনা।
এটা ছিলো আমার মায়ের নবম মিথ্যা কথা।
তারপর একদিন খবর এলো মা খুবই অসুস্থ। ভয়ঙকর অসুস্থ।আমি তাড়াতাড়ি গ্রামে ফিরে আসি। দেখি মা জীর্ণ শীর্ণ হয়ে শুকিয়ে একেবারে পাটকাঠি হয়ে আছেন।মায়ের বিছানার পাশে বসি।বুঝতে পারি মায়ের বিছানায় ওঠে বসার এতটুকু শক্তি নেই।মা আদো আদো কন্ঠে বলেন-অনেক দূর থেকে এসেছিস ।নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধা লেগেছে। মা তোকে খাবার বেড়ে দেই।
মা ওঠে বসার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেননা। বুঝতে পারি, মায়ের খুব ব্যথা হচ্ছে। বললাম, মাগো । তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? খুব বেশী কি ব্যথা গো মা?
মা শিশুর মতো হাসেন।অবিকল এক ছোট শিশুর মতো। কী যে মিষ্টি সে হাসি।কী যে নিষ্পাপ সে হাসি। হেসে হেসে মা বলেন-আমার একটুকুও ব্যথা নেই মানিক।মাযে একেবারে সুস্থ। তোর মায়ের কোনো অসুখ নেই।
এটা ছিলো আমার মায়ের দশম এবং শেষ মিথ্যা কথা। এটুকু বলেই আমার এক মিথ্যাবাদী জান্নাতবাসী ফিরিশতা মা চোখ বুঝলেন। এই পৃথিবীতে আমার সাথে মায়ের মমতা নিয়ে মিথ্যা বলার আর কেউ রইলোনা।
(একটি ইংরেজী জার্ণাল থেকে ভাবানুবাদ)