(দেশের জন্য যারা কবিতা লিখেন, দেশের জন্য যারা পদ্য লিখেন, দেশের জন্য যারা গল্প লিখেন। দেশকে যারা সত্যিকারের ভালোবাসেন। দোয়েলের সৌন্দর্য্যে যারা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকেন আর একটি ঘাস ফড়িং, একটি ঘাসফুল, ধানের ডগার উপর একটু শিশির যাদের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য এক বিস্ময়কর আনন্দ দেয় শুধু তাদেরকে এই কবিতাটি উৎসর্গ করা হলো।)
ধূসর সময়ের প্রান্তরে প্রান্তরে-
গহীন সময়ের আলো আর অন্ধকারে,
এক অশ্বথ বটের নীচে আমি শুনি শ্বাশত শতাব্দীর নিঃশ্বাস-
শুনি নিভৃত কুহকের ডাক, দেখি সজল বিলের গাংগচুর জলা হাঁস
হৃদয় মন্দিরে খুঁজি চারহাজার বছরের মাটির আঘ্রান-
কত সাধু আর তাপসীর প্রান আকুল করা হাজার বছরের গান ।
আজ আমি সেই হ্বদয় মত্থিত সুর
আর বটরাখালির বাঁশীর কথা বলছি-
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
ফাল্গুনের ছায়া মাখা রোদে,
ঝরনার চঞ্চলতায়- চক্রবালের নীরব জনপদে-
বিলীন পটভূমির ইতিহাসের প্রথম উতস থেকে-
কত খণ্জনার নাচ, আর অবরিল ধুলো গায়ে মেখে
কত নদীজন্মালো, কত ভেঙে গেলো তীর
মনে পড়ে আজ সেই আর্য আর দ্রাবিড়,
আমি আজ সেই খুঁজে ফেরা আমার শৈশবের কথা বলছি-
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
দুহাজার ছয়শত আট সাল বিজনে
অংগ,ভংগ,মগধের নিরজনে,
সুজলা,সুফলা,শশ্য,শ্যামলা,গিরি ,কুন্তলায়,
নির্ঝর বহমান নদী আর হ্রদে, পাখীর মুখরতায়,
অবারিত নীলের বিস্তৃত আকাশের ঠিকানায়,
জনপদের সেই অবিস্মরনীয় সূর্য্য পরিক্রমায়
প্রতিনিয়ত আমার বেড়ে ওঠার কথা বলছি-
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
আমি ছিলাম,রামায়নে,মহাভারতে,
যেখানে বিম্বিসারের,অজাতশত্রুর,শাসনের দীপ্তিতে
আশ্চর্য্য প্রশান্তিতে ভরিয়ে রেখেছিলো আমার মন,
যতিহীন জীবনের সেই প্রানের স্পন্দন,
আজ আমি সেই স্ম্বতি আর সহস্র লগনের কথা বলছি,
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
তারপর সহসা একদিন-
বুকের উপর ছুটে চলা স্রোতস্বীনি গংগার ঢেউ
উন্মত্ত ক্রোধে তেজী অশ্বের লাগাম টেনে দাঁড়িয়ে কেউ
২৩৩৪ বছর আগে-নন্দ রাজ্যের রুপালী জোছনায়,
আমার সূর্যনদীর পাড়ে,সূর্যসন্তানেরা ,সূর্যপরিক্রমায়-
গেয়েছিলো সেই রামধুনর সাতরংগা বিজয়ের গান
আর আমি মহাবিস্ময়ে দেখেছিলাম তোমার ভীতু প্রস্থান-
মহাবীর আলেকজান্ডার ,তুমি গুটিয়ে নিলে তোমার চরন-
আমার গৌরব, অহংকার ,আমার চির দীপ্তিমান সেই স্বপন,
আমি আজ সেই তেজোদীপ্ত বিজয়ের কথা বলছি,
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
তারপর ছায়া ঢাকা, পাখী ঢাকা, শান্ত ,সূর্যে চন্দ্রে সুনিবিড়
কেটে যায় কত বছর ,কত যুগ-কত রংগে আবীর,
মূর্য,গুপ্ত রাজ্যের ইতিকথা,কত তমালের আর হিয়াল
মনে পড়ে চন্দ্র গুপ্ত মূর্য, অশোক, মহান শশাংক ,ধর্মপাল।
খিলজি আসে, সালতানাত হয়, আফগান,মুঘল,তূর্কির অধিকার-
শের শাহ ছুটে চলে সোনারগা থেকে পেশোয়ার,
কত ইট-সুড়কি,স্মৃতির গ্রান্ড ট্রাংক রোড,আর স্মৃতির মিনার,
আমি যেন এই পৃথিবীর জান্নাত, প্রাচুর্য্যের সমাহার,
আজ আমি সেই ঐশর্য্যের কথা বলছি
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
সেই ঐশ্চর্য্যের লোভে আসে ধূর্ত শিয়াল, চলে স্বপ্ন হননের ছল,
অন্ধ কুটুরে আমার দীপ্তি নিঃশেষিত হয়,কাঁপে আমার অন্চল,
বাণিজ্য বেসাতির বিবস্ত্র আমার সবুজ আঁচল, দেখি ডাকুর পাল
বিশাল আকাশের নীলিমায় চন্দ্রহরনের সময় সেতো ১৬৭৩ সাল,
শিয়ালের পর আসে হায়েনার দল,তাদের গোপন পদধ্বনি
১৬৯০ সাল-শুরু হয় আমার বুকে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার গ্লানি ।
শুরু হয় আমার অশ্রুপাত, বিষাদের নিরালয়ে হাহাকার করে প্রান
সিরাজ পলাশীতে, আর কাশিম বক্সারে নির্মমভাবে হেরে যান।
কাঁদে বাংলা, বিহার ,উড়িষ্যা-এই ছিলো আমার ললাটে
আমার দুঃখ, আমার আলো বাতাসেই মীরজাফরেরা বেড়ে ওঠে
আজ আমি সেই স্বর্নীল আকাশে, বেদনাবিঁধুর
ক্রন্দনভরা মেঘাচ্ছন্ন দিনলিপির কথা বলছি,
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
শতেক বছর পরে আবারো ১৮৫৭ সাল,
দাম্ভিক ব্রিটিশ রাজ,চলে শোসনের কূটচাল
কৃষ্টি ,সভ্যতা, হাজার বছরের এক মিলিত ঐকতান
সূর্য্য ,চন্দ্রের আলো সব যে আমারই সন্তান,
১৯০৫ সালে শুরু হয় ভাঙগন, মাতার অশ্রুলাল
আবার মিলিত হয় একি মোহনায় ১৯১২ সাল।
আমার নীলিমায় উড়ে কত দেশী,বিদেশী শকুন-
রক্ত লাল হয় কত মাঠ, বোনের কত অশ্রু আর ভাইয়ের খুন।
আর নক্ষত্র খচিত হয় কত হাজারো নাম
মুক্তির মন্দিরে বলি হতে থাকে কত ক্ষুধিরাম,
তেপান্তর ঘটে কত মহান বীর সেনানীর, কাঁদে ভাইয়ের প্রাণ
ফাঁসীর মন্চে ঝুলে কত সূর্যসেন,কত সূর্যসন্তান
আমি আজ সেই বীরের শোনিত ধারার মর্মন্তুদ অগ্নির কথাবলছি,
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
এরপর হানা দেয় ধর্মের কূটকৌশল, রাজগ্লানি
নীল আকাশে অবিরাম গাংগচিলের গোংগানি,
আমি আবারো ভাংগনের ক্রন্দন শুনি,
বিবেদের বিষময় শংকচূড় শব্দধ্বনি
দ্বিখন্ডিত হই ,আরেকবার সেতো ১৯৪৭ সাল।
এবার রক্তচূষা ব্রিটিশ বেনিয়ার সম্পদ লুন্ঠিত প্রস্থান।
১৯৫৮সালে আমার কলংকিত নাম চাপিয়ে দেয়া হয়,
আমি হই ভাগ্য বিড়ম্বিত ইস্ট পাকিস্তান।
শূন্য হতে থাকে আজন্মলালিত আমার মাতৃত্বের বুক-
সন্তান হারা আমি-পাথর হয়ে যাই , মাতম আর শোক
স্ফীত চর্বির সারমেয় শাবকের দাঁতালো নখরে
৬৮হাজার বর্গমাইলের সবুজ ভূমি কেঁপে ওঠে শকুনের বিষাক্ত আঁচড়ে ।
এরপর আমার শস্য, আমার বসতভাটি,আমার উচ্ছ্বাস,
আমার কন্ঠ ,আমার অধিকার ,আমার সুখ, আমার নিঃশ্বাস,
আমার স্বপ্ন,আমার আহলাদ, আমার কৃষ্টি,আমার তৃষ্না,
আমার সভ্যতা,আমার সংগীত,আমার আরতি, আমার জোছনা,
আমার শ্যামলিমা, আমার নদী, আমার ঘাস, , আমার তিথী,
আমার জীবন,আমার বেড়ে ওঠা, আমার সাচ্ছন্দ্য, আমার মৃত্তি,
আমার জল ,আমার পাঠাঘার,আমার শিল্প সব তিলে তিলে লুন্ঠিত হয়।
আজ আমি সেই জুলুমের ,নিপীড়নের ,নির্যাতনের, বন্চনার,শোষনের,নিস্পেশনের,ছলনার,কথা বলছি
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
তারপর একদিন এক কালো রাতে আমি দেখলাম-
বুকে আমার বয়ে চলেছে রক্তগংগা অবিরাম,
রক্তের পদ্মা ,মেঘনা,যমুনা,কুশিয়ারা ,আড়িয়াল খা,
লাশে ভরা নদী, বিরান মাঠ,রক্ত লাল কর্ণফুলি সুরমা।
মৃতের অরন্যে লাশের পাহাড়,
খুনের জোছনা-চারপাশে নিদারুন নিস্তব্ধ,ভয়াল অন্ধকার
আমার সন্তানের লাশের গন্ধে ভারী হলো আমার নিঃশ্বাস।
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর-নেইকোনো জীবনের আশ্বাস
সেদিন বিজয়ের সেই লগনে আবার আমার নব জন্ম প্রাপ্তি,
শকুন,হায়েনা, ধূর্ত, নরপিশাচের কবল থেকে আমার মহা মুক্তি।
আমি হলাম ধরনীর এক বীর প্রসুতি মা, নেই কোনো শংসয়'
পুরো পৃথিবী শুধু এক অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে রয়।
মায়ের জন্য জীবন দেয়া রক্তবীজের সেই সব সূর্যসন্তান,
আজ কোথায়-
দোয়েলের সুরে,রাখালীর বাঁশীতে,নৌকার পালে, আম্র মুকুলে?
নক্ষাত্রোলিকত আকাশে আকাশে-সোঁধা মাটির সবুজ শ্যামলিমায়?
আজ আমি সেই হারিয়ে যাওয়া দীপ্তিমান নক্ষত্রদের কথা বলছি-
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
না,না পারোনি, তোমরা আমাকে এতুটুকু চিনতে পারোনি?
আমার দুঃখ, আমাকে চেনার সেই সূর্যসন্তানেরা আর নেই ।
ওরা আজ পরম শান্তিতে আমার বুকে
ঘুমিয়ে আছে,
ঘুমিয়ে আছে,
ঘুমিয়ে আছে।