ইচ্ছে করেই অ্যালার্ম দেই নি রুদ্র । অর্পিতার ফোনে ঘুম ভাংবে ব্যাপারটা সে জানে। ( I will see you again) রিংটোন টা বাজছে। এই ধরনের গান রুদ্র পছন্দ করে না। তবু ও মহা বিশ্বের অদ্ভুত মায়াজালে পড়ে মাত্র কদিন আগে নাকি অনন্তকাল আগে এই গান টাই তার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে।
জীবন??? নাকি মৃত্যু???
কথা টা ভাবতেই রুদ্রর আত্মা নামক অদৃশ্য স্বত্বা মুহূর্তেই ক্ষুধায় কাঁদতে থাকা সদ্য মারা যাওয়া শিশুর মত নিরব হয়ে যায়। শিশুটি তবু মরে বেঁচে যায়, রুদ্র কে আবার সেই যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হয়। (I will see you again) বেজেই চলেছে। রুদ্র তার মারা যাওয়ার দিন সকালে এই রিং টোন টা সেট করেছে। সে কাজ টা কেন করেছিল, সে জানে না। কিন্তু এখন রিং টোন টাই বারবার তার মারা যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়, আবার চেঞ্জ করতে ও ইচ্ছা করে না, মন যেন কোন এক ছকে বাধা । বই পুস্তকে একটা কথা লেখা থাকে মাঝেই মাঝেই যে প্রচণ্ড কষ্টে মন ভেঙ্গে যায়। কিন্তু রুদ্রর কাছে মনে হয় একটা কষ্টের সাগরে তার মন ডুবে থাকা একটা ছোট্ট মাছের মত, যার বেঁচে থাকার জন্য ওই সাগর ছাড়া কোন জায়গা নেই। আবার জীবন- মৃত্যুর সেই বিরক্তিকর দো টানা।
“ বারবার এই দিন টাতে এই সকাল সাত টা বাহান্ন মিনিটে তোর মরা গাছে গোলাপ ফোটার খবর টা না দিলে হয় না? ” চোখ টা বন্ধ করেই রুদ্র ফোন টা ধরে। রুদ্রর কাছে ব্যাপার টা নতুন না হলে ও অর্পিতা প্রচণ্ড অবাক হয়।
“ তুমি জানলে কিভাবে? আর বারবার মানে? ”
“ভার্সিটি তে আয় তারপর কথা হবে। রাখলাম। ” অর্পিতা রুদ্র কে তুমি ডাকলেও রুদ্র তুই ডাকে। ফোন টা রেখে রুদ্র উঠে হাত মুখ ধুয়ে ভার্সিটির জন্য রেডি হয়ে নেয়। একই কাজ বারবার করতে ভাল লাগে না, কিন্তু কিছুই করার নেই।
খাবার টেবিলে বসে পছন্দের খাবার গুলো দেখেও রুদ্রর বিরক্ত লাগে। এই মরার কারনেই তার আদর টা যেন বেড়ে গেছে। বড় দুই বোন চাকরি করে। বাবা মারা যাওয়ার পর তারাই সংসার খরচ চালায়। এখন ও বিয়ে করেনি। তারা আদরের কোন কমতি রাখছে না। খাওয়া শেষ করতেই মা রাইসা খন্দকার রুদ্রর পাশে বসেন।
“মা, দাও তিনশ টাকা টা দাও, আমার যেতে হবে।” রুদ্রর কথায় তার মায়ের মন যেন গভীর রাতে কুকুরের ডাক শোনা কুসংস্কার বিশ্বাসী মনের মত আন্দোলিত হয়ে ওঠে। প্রতিদিন তিনি রুদ্র কে দেড়শ টাকা দিলে ও আজ তিনশ টাকা নিয়ে এসেছেন তা এখন ও তিনি রুদ্র কে বলেন নি, রুদ্র ও কিছু চায় নি। রুদ্র কে এই ক দিনে খুব বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। যদি ও সে কষ্ট দেয়ার জন্য আগের মত কিছুই বলে না। শুধু একটা হাসির কষ্ট মুখে ধরে রাখে। মানুষের কষ্টের হাসি চেনা যায়, কিন্তু এ হাসির অর্থ বোঝা বোধ হয় কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
টাকা টা হাতে দিতেই রুদ্র মায়ের কপালে একটা চুমু দিয়ে চলে যায়। যে ছেলে টা ড্রাগসের জড়িয়ে পড়ার পর তার আশা ছেড়েই দেয়া হয়েছিল, সেই ছেলের ড্রাগস ছেড়ে এমন লক্ষ্মী হয়ে যাবে- তা কল্পনা কত বড় আনন্দের তা একজন মা ছাড়া কেও বুঝবে না। সেখানে বাস্তবতা এসে ধরা দিলে তা পৃথিবীর সব সুখের সমষ্টির চেয়ে ও বেশি। মায়ের পরাজয় হলেও অর্পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে।
ভার্সিটি তে ভর্তি হউয়ার পর পর রুদ্র ড্রাগস এ জড়িয়ে পড়ে। মেধা তালিকায় চান্স পাওয়া অমায়িক চেহারার এই ছেলেটির ড্রাগস এ জড়ানোর গল্প মোটা মুটি ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের সবারই জানা। সব কিছু জেনে ও অর্পিতা প্রথম দেখেই রুদ্র কে ভালবেসেছিল। এডিক্টেড হলে ও সম্ভবত অসাধারন মেধার কারনে রুদ্রর রেজাল্ট সব সময় ই ভাল ছিল, যদি ও সে খুব একটা ক্লাস করত। না ভার্সিটির প্রথম ক্লাস থেকেই প্রত্যেক টা ক্লাসে অর্পিতা অধীর হয়ে থাকত একটি বার রুদ্র কে দেখার জন্য। আমাবস্যার সময় জ্ঞান থাকলে ও রুদ্রর দেখা পাওয়া ভাগ্য বলেই মনে করত অর্পিতা।
প্রথম বর্ষের পরীক্ষার সময় রুদ্রর সাথে পেছনের সিটে বসার সৌভাগ্য হউয়ায় অর্পিতা নিজের অনেক গুলো ভাল কাজের ফল বলেই মনে করে। টুক টাক কথা হলে ও পরীক্ষার শেষের দিন অর্পিতা রুদ্রর কাছে থেকে নিজে চেয়ে ফোন নাম্বার নেয়। তখন থেকেই অর্পিতা নিজে থেকে ফোন দিয়ে রুদ্রর সাথে রাতে কথা বলত। স্নায়ুর নিয়িন্ত্রনে থাকা রুদ্র সব সময় উদাসিন হয়েই কথা বলত অর্পিতার সাথে। স্নায়ুর প্রসাদ নিয়ে রুদ্র বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরেই থাকত। একান্তভাবে নারী পুরুষের কথা সম্ভবত ত্রিভুজের ভুমির দুই প্রান্ত থেকে শুরু হয় যা সময়ের সাথে এক বিন্দুতে গিয়ে মিলে মিশে এক হয়ে যায় যেখান থেকে আলাদা করা যায় না।
রুদ্র ও অর্পিতা কে ভালবেসে ফেলে । সময়ের নিয়মিত বৃষ্টির ধারায় অনেক ঝড়ের পর ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের শুরু তে রুদ্র রিহাবে তিন মাসের চিকিৎসা শেষে নিয়মিত ক্লাস শুরু করে। অর্পিতার ভালবাসায় মায়ের লক্ষ্মী ছেলেটা হয়ে ওঠে। অসহ্য পাপবোধ রুদ্র কে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেললেও মা প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাত গুলো ভুলে নতুন করে সব গুছিয়ে নেন।
রুদ্র এখন থার্ড ইয়ারে পড়ে। অর্পিতার সাথে সম্পর্কের প্রায় দেড় বছরের কিছু বেশি হতে চলল।
আজ ভার্সিটি তে পৌঁছে সোজা ক্যান্টিনে র দিকে হাঁটতে থাকে রুদ্র। ক্যান্টিনের কোনার টেবিল টাতে নীল পরির মত বসে আছে মেয়েটা। সময় যে সুন্দর কে এত অসহ্য করতে পারে- তা রুদ্র ছাড়া পৃথিবীর কেও জানে না।
“ তোমাকে যে গতকাল নীল সার্ট আর কাল জিন্স টা দিয়ে ছিলাম ওটা পড়ে আসনি কেন? ” রাগ মাখান কণ্ঠে ধোয়ার মত কথা গুলো বের হয়েই মিলিয়ে যায়। কেননা রাগের কোন রেখা তার মায়াবী মুখটার সামান্য অংশ কে ও বসে আনতে পারে নি। গতকাল সারাদিন অর্পিতা রুদ্রর বাসায় ছিল। কালকেই সে রুদ্র কে সার্ট- জিন্স টা গিফট করেছে।
“ গতকাল !!!!” কথাটা বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র।
“ ভাল কথা । আমার মরা গাছে গোলাপ ফুটেছে তুমি জানলে কিভাবে? ” রুদ্রর দীর্ঘ-শ্বাস কে পাত্তা না দিয়ে জিজ্ঞাসা করে অর্পিতা।
রুদ্রর প্রস্ন টা বিরক্ত লাগে যার কারন এক মাত্র সে নিজে আর ওপরের একজন ছাড়া কেও জানে না। সে তার বাবার ওপর রাগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু নিজে কে বাবার ভালবাসায় ঘেরা বিরাট মহাবিশ্বের একটা পরমানু মনে হয়। এ ভালবাসার সীমা অতিক্রম করে রাগের রাজ্যে যাওয়া কোন মানুষ বা কোন শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়।
“ কাল বলব, এখন এ কথা থাক ”
“আচ্ছা ঠিক আছে, বাসায় চল। ” অর্পিতা রুদ্রর হাত ধরে ক্যান্টিনের বাহিরে এসে সোজা গাড়িতে গিয়ে ওঠে।
“আজ জোস্না রাতে সবাই গেছে বনে” ড্রাইভার অর্পিতার পছন্দের গান টা ছেড়ে দেয়। অর্পিতা চুপ করে রুদ্রর হাত টা ধরে ঘাড়ে মাথা রাখে। রুদ্র অর্থহীন নিষ্ঠুর শাস্তির মানে খোঁজার নিস্ফল চেষ্টায় বাহিরে তাকিয়ে থাকে।
অর্পিতার মা ছোট বেলায় মারা গেছেন। শিল্পপতি বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি, ব্যবসার কাজেই সব সময় ব্যস্ত থাকেন। বাসায় বেশির ভাগ সময় চারজন কাজের লোক ছাড়া কেও থাকে না।
সন্ধায় বাসায় ফিরে আসে রুদ্র। সামাজিক শৃঙ্খল ভাঙ্গার এক বিচিত্র আনন্দ ও পাপ বোধ আছে। মানব শরীরের নিজের শক্তি মনের শক্তির সাথে মিশে গেলে তা অজেয় হয়ে যায়। কিন্তু নিত্য চক্রের এক ঘেয়েমি সত্ত্বেও শরীরের ঘুম ভাঙ্গালেও পরম স্বাধীনতা, আনন্দ – পাপ বোধ কে এমন এক মৃত্যু দেয় যা মন কে মাতৃ স্নেহের আদল অনুকরনে নিষ্ঠুর ভাবে জড়িয়ে রাখে- সম্ভবত এ পরম স্বাধীনতার মানে শুধু রুদ্র জানে । মনের সংযোগ বিহিন শরীর শুধু একটা যন্ত্রের মত ই , এক ঝাঁক ক্লান্তি টা বোনাস হিসেবে আসে।
রুদ্র সরাসরি নিজের রুমে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মা এসে ঘুমন্ত রুদ্র কে দেখে কোন এক অজানা আশঙ্কায় দুঃস্বপ্নে কাঁপতে থাকা চোখের পাতার মত কেপে ওঠেন। তবু ও নিজে কে সংবরণ করে ভাবেন কাল যা জিজ্ঞাসা করার করবেন।
সকাল বেলা কপালে একটা জড়তাহীন হাতের স্পর্শে রুদ্রর সমগ্র স্বত্বা অদ্ভুত শিহরনে সৃষ্টি মেঘমালায় ভালবাসার প্রবল বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে ওঠে। সে জানে, এটা অর্পিতার স্পর্শ। রুদ্র সমরেশ মজুমদারের একটা গল্পে পড়েছিল যে , সন্ন্যাসীদের আশ্রমে সন্ন্যাসী নারী দের কপালে আস্রম গুরু মাঝে মাঝে হাতের তিন টি আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করেন। সে স্পর্শে এমন ই ভালবাসার সিক্ততা বহমান থাকে যে একজন সন্ন্যাসী নারীর পুরুষের কাছে থাকা সকল চাহিদা পূর্ণ হয়ে যায়। আস্রম গুরু রা সিদ্ধ পুরুষ হয়ে এ অলৌকিকতা লাভ করেন। তখন বিশ্বাস না করলে ও অর্পিতার স্পর্শের আলাদা কোন যৌক্তিক বা অযৌক্তিক ব্যক্ষা খুঁজে পায় না রুদ্র।
আলতো করে চোখ টা খুলতে খুলতে ভাবে অর্পিতার ঠোঁট টা সেই অলৌকিকতার পক্ষ পাতিত্তই করল মাত্র। অবশ্য আর একটা ব্যক্ষা দেয়া যায়। মনের ভালবাসা ঠোঁট কে ইঙ্গিত দিলে অন্যান্য মেয়ের ঠোঁট পাপড়ির মত বা কমলার কোয়ার মত হয়ে ধরা দিলে ও অর্পিতার ঠোঁট টা পূর্ণিমার বৃষ্টি ঝরা রাতের চাঁদের মত হালকা হলদেটে কিন্তু গোল হয়ে যায়। মেয়েটা এটা জানে বলেই মনে হয় হলদে টাইপ কি এক রঙের লিপস্টিক মাখে।
“ এইটা তোমার জন্য। আজকে পড়তে হবে না। কাল পড়বে। আজ আমি সারা দিন এখানে থাকব। অ্যান্টি কে বলেছি আজ দুপুরে আমি রান্না করব। ” একটা ব্যাগ দেখিয়ে সমগ্র নারী হাসি কে হারানোর হাসি হেসে বলে অর্পিতা।
রুদ্র জানে ব্যাগ এ কি আছে। সে একটু হাসার চেষ্টা করে।
“ তুমি উঠে হাত মুখে ধুয়ে খেতে এস। আমি কিচেনে গেলাম। ” কৃএিম ব্যস্ততার আনন্দ নিয়ে উঠে চলে যায় অর্পিতা।
রুদ্রর বাবার মারা যাওয়ার পর থেকে প্রায় মাঝে মাঝেই অর্পিতা রুদ্র দের বাসায় আসে। রুদ্রর মা রাইসা খন্দকার অর্পিতা কে ছেলের বউ হিসেবে মেনেই নিয়েছেন। অর্পিতার বাবা ও আপত্তি করবেন না রুদ্রর মত মেধাবী ছেলের হাতে মেয়ে কে তুলে দিতে। যদি ও রুদ্র রা মধ্যবিত্ত। রাইসা ও ইকনমিকস এ মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন। মাস্টার্স পরীক্ষার সময় রুদ্রর বড় বোন মৌ তার পেটে ছিল। পরে সন্তান দের দেখা শোনার জন্য আর কোন চাকরি করেন নি। রুদ্রর বাবা সরকারি ব্যাংকের বেশ বড় অফিসার ছিলেন। পরহেজগার মানুষ কোন দুর্নীতি করতেন না। তাই বেশ টানা টানি করেই সংসার চলত।
রুদ্র হাত মুখ ধুয়ে বাথ রুম থেকে বের হতেই অর্পিতা নিজের হাতে নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢোকে। নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। আজকের ব্রেড এ যেন শুধু জেলি নয়, অর্পিতার মন নিংড়ান ভালবাসা মাখান। রুদ্র ছেলেটা জানে যে অর্পিতার এই অসীম ভালবাসার চেয়েও বেশি ভালবাসে সে অর্পিতা কে। তবু ও এই পরিস্থিতিতে বিরক্তি আর গভীর কষ্টের এক সুক্ষ বুননে যেন রুদ্রর মন কেও সেলাই করতে থাকে। রুদ্র মুখে কিছু বলে না। অর্পিতা এক মনে নানা গল্প বলতে থাকে। রুদ্র শুধু হু হ্যাঁ করতে থাকে।
খেয়ে রুদ্র লালনের “ আমি অপার হয়ে চেয়ে থাকি ওহে দয়া ময়, পাড়ে লহে যাও আমায় ” গানটা কম্পিউটারে ছেড়ে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।
ওদিকে নাস্তা করিয়ে রুদ্রর দুই বোন কে অফিসে পাঠায় অর্পিতা। অর্পিতার বিচরনে যেন একটা শুষ্ক নদী ভরা জোয়ারে শরীরে নানা ভাঁজ নিয়ে নিজের যৌবন মেলে ধরে পৃথিবীর কাছে। কষ্ট শব্দটা যেন সুখ শব্দ দিয়ে সম্পূর্ণ রুপে প্রতিস্থাপিত হয়ে ধরা দেয় রাইসা খন্দকারের কাছে।
অর্পিতা আর রুদ্রর মা বাসার বাতাসকে নানা গল্প দিয়ে ভরিয়ে দিতে দিতে কিচেনে রান্না করে। মাঝে মাঝে এটা নেই, ওটা থাকলে ভাল হত- এসব অভিযোগ নিয়ে রুদ্রর কাছে যায় অর্পিতা। যদি ও সে জানে যে রুদ্র এসবের কিছুই জানে না, তবু ও রুদ্রর মুখ টা অর্পিতার মন কে প্রত্যেকবার, মায়ের কাতু কুতু তে হাসতে থাকা অবুঝ ছোট্ট শিশু র মত আনন্দে রাঙ্গিয়ে দেয়।
একটা ভাল লাগার সুখানুভুতি যে এভাবে কষ্ট দিতে পারে- তা রুদ্র ছাড়া কেও জানে না।
দুপুরে অর্পিতা , রুদ্র, রুদ্রর মা , ইতিমধ্যে হাফ অফিস হউয়ায় অফিস থেকে বড় দুই বোন ও চলে আসেন। সবাই মিলে খেতে বসেন। অর্পিতাই একের পর এক কথা বলে মাতিয়ে রাখে। রুদ্রর কাছে মনে হয়, তার মনে উল্কাপাতের মত কোন এক অজানা জায়গা থেকে হাজার হাজার হীরক খণ্ড খসে গেঁথে যাচ্ছে। হীরক প্রাপ্তির আনন্দ সাথে মন ক্ষত বিক্ষত হউয়ার কষ্ট ।
খাওয়ার পর অর্পিতা রুদ্রর মা বোনের সাথে গল্প করে বিকালে চলে যায়। সারা টা দিন রুদ্রর সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা বলা হয় না।
যাওয়ার আগে অর্পিতা রুদ্রর রুমে যায়।
“ জান, আমার গোলাপ গাছটাতে প্রথম একটা কলি ধরেছিল, কিন্তু গাছ টা মরে গেছে। কলিটাও কাল ই হয়ত ঝরে যাবে। তুমি কাল সকালে নীল সার্ট আর এই কাল জিন্স টা পড়ে আসবে। ”... ঠোঁটে একটা আলত চুমু দিয়ে বেরিয়ে যায় অর্পিতা।
রুদ্রর শরীর টা কেমন যেন লাগে। শুয়ে থাকতে থাকতে রাত আঁটটার ভিতরেই ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুম থেকে উঠেই পাশে মা আর বড় বোন দের চোখে পড়ে। রুদ্র কে স্যালাইন দেয়া হয়েছে গতকাল রাতে। শরীর দুর্বল ছিল বেশি। বড় বোন রা ছুটি নিয়েছেন। স্যালাইন দেয়া অবস্থায় কিছু খাওয়া নিষেধ। শেষ হতে সারা রাত ই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এখন পর্যন্ত অর্ধেক ও শেষ হয় নি।
“ বাবা। তুই গতকাল দুপুরের কথা টা কাও কে বলিস না। একজন ওপরে আছেন, তার জন্যই আমি তোঁকে ফিরে পেয়েছি। ” রুদ্রর মাথার কাছে বসে রাইসা খন্দকার এর কথা গুলোর সাথে মমতা নিজে থেকে তার অস্তিত্তের প্রমান দিতে গিয়ে ফোঁটা ফোঁটা অস্রু রুদ্রর কপাল ভিজিয়ে দেয়।
অস্রু যেন নীরব ভালবাসায় রুদ্র কে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
সন্ধার সময় ঘুম থেকে ওঠে রুদ্র। স্যালাইন শেষ। প্রচণ্ড খুদা লেগেছে । অর্পিতার ফোন বেজে ওঠে। রুদ্র মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ঘোষণা দিয়ে তিন দিনের জন্য অর্পিতার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। এই তিন টা দিন গতকাল শেষ হয়েছে। অর্পিতার কাছে এই তিন টা দিন নিজের অজান্তে অতিতের বা ভবিষ্যতে করবে এমন কোন গুরুতর পাপ কাজের শাস্তি মনে হয়। তবু অসম্ভব জেদি রুদ্র, তাই কিছু বলেনা।
অর্পিতা রুদ্রর বোনের কাছে থেকে ফোন পেয়ে অসুস্থতার কথা জেনেছে। অর্পিতার এক্সাম ছিল বিকালে তাই দিনে আসতে পারে নি, এখন আসতে চায়।
রুদ্র বলে, “ আমি ঠিক আছি কাল কে আসিস। আমি খেয়ে ঘুমাব। এখন রাখছি। ”
রুদ্র অসম্ভব চাপা। রুদ্রের কথায় অর্পিতা শান্ত হয় না, কিন্তু মন কে মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ ভাবে অন্নের কথায় সপে দিতে হয় মনের সম্পূর্ণ শান্তির জন্য। অর্পিতা কাল কের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
রুদ্র মায়ের হাতে সামান্য ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল দশ টায় ঘুম থেকে ওঠে রুদ্র। আজ তিন দিনের শেষ দিন। গত দুই দিন এক বারের জন্য ও অর্পিতার সাথে তার কথা হয় নি।
বোনেরা অফিসে চলে গেছে। ফ্রেস হয়ে রুদ্র টেবিলে আসে নাস্তা খেতে। মা ঘর গোছাচ্ছেন। রুদ্র আজ ক্লাসে যাবে না বলে ঠিক করেছে। খেতে খেতে কি মনে করে, (I will see you again ) গান টা রিং টোন হিসেবে সেট করে। তাড়াতাড়ি খেয়ে মায়ের রুমে যায়, মাকে হেল্প করতে।
ঘর গোছানর সময় আলমারির একটা তাকে হঠাৎ একটা চিঠি হাতে পায় রুদ্র। চিঠিটা খুলেই সে চিনতে পারে, এটা বাবার লেখা। রুদ্রর মা অন্য দিকে ব্যস্ত থাকায় এদিকে খেয়াল করেন নি।
রুদ্র কিছু না বলে চিঠি টা নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
রুদ্র বাবার চিঠি টা পড়ে কাঁপতে থাকে। শরীরের প্রত্যেক টা অংশ চোখের পানির মত ছিঁড়ে পড়তে চায়।
দুই বছর আগে রুদ্র ড্রাগস এ জড়িয়ে পড়েছিল । ছোট থেকে পরিবার থেকে ভালবাসার কমতি ছিল না। তবু ও হঠাৎ করেই জড়িয়ে পড়েছিল এই অন্ধকারে । স্নায়ুর নিয়ন্ত্রন থেকে মনের নিয়ন্ত্রনে যাওয়া এত টা সহজ না। স্নায়ুর ডাকে টাকার জন্য প্রতিদিন রুদ্র তার মাকে মার ধোর করত। রুদ্রর মা শুধু একজন মা বলেই এই অসহ্য যন্ত্রণার নিয়তি সহ্য করতেন ছেলে কে ভালবাসার জোড়ে। বাবা ও প্রচণ্ড ভালবাসত ছেলে কে। প্রথম প্রথম বাধ্য হয়েই ছেলেটা কে টাকা দিতেন। কিন্তু তিন মাসের মাথায় একদিন রুদ্র তার বাবার অফিসের কলিগের কাছে থেকে টাকা চুরি করে পালানোর সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।
সেদিন রাতে বাবা মখসেদুল খন্দকার রুদ্রকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনেন। কিন্তু প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মখসেদুল সাহেব নিজের ছেলের জন্য এত বড় অপমান সহ্য করতে পারেন নি। ছেলে কে ও প্রচণ্ড ভালবাসায় ছেলে কে ও কি বলবেন – বুঝতে পারছিলেন না।
পৃথিবী ত্যাগ কেই মুক্তির উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
লিখেছিলেন একটা ছোট্ট চিরকুট।
চিরকুট টা পড়ে রুদ্রর প্রচণ্ড বুক ব্যথা শুরু হয়ে হয়। ধীরে ধীরে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে। রুদ্রর ঘরে শব্দ শুনে রাইসা খন্দকার ছুটে এসে দেখেন। ছেলে মাটিতে পড়ে আছে। চিৎকার করে রুদ্রর কাছে গিয়ে শিক্ষিত বলেই হয়ত ক্ষণিকের জন্য মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু শ্বাস, পালস, আর হার্ট বিট চেক করে বুঝতে পারেন রুদ্র মারা গেছে। অজ্ঞান হয়ে যান রাইসা।
প্রায় বিকালে জ্ঞান ফিরে দেখেন রুদ্রর লাশ সামনে । রুদ্রর বোন রা এখন ও বাসায় ফেরে নি। পাশে পড়ে আছে চিরকুট টা। বাক রুদ্ধ রাইসা চিরকুট টা হাতে নেন। তিনি আগে ও পড়েছেন। কিন্তু রুদ্র কে কখন ও দেখান নি।
“ হে মালিক! আমি কখন ও অন্যায় করি নি। তোমার পথে থেকেছি। তবু ও এ যন্ত্রণা কেন আমি জানি না। আমি আমার সন্তান কে অনেক ভালবাসি মালিক। সে না বুঝে ভুল করেছে, আমাকে তার মাকে কষ্ট দিয়েছে। তুমি তাকে মাফ করে দিও মালিক। আত্মহত্যা মহা পাপ জেনে ও অনন্ত কালের শাস্তি মাথা পেতে নিলাম। আমার ছেলে কে তুমি সাড়ে তিন হাত কবরের আজাব থেকে রক্ষা কর। ”
রাইসার চোখের পানি তে চিরকুট টা ভিজে যায়। সাথে সাথেই রুদ্র জেগে ওঠে। রাইসা ভয় না পেয়ে সব ভুলে ছেলে কে জড়িয়ে কেঁদে ওঠেন। মা ছেলে অনেক ক্ষণ জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন। রাতে রুদ্রর বোনেরা আসেন। রাইসা শুধু জানান রুদ্র অসুস্থ।
রাতে মায়ের জোরাজুরি তে সামান্য খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে রুদ্র।
ঘুমের আগে রুদ্রর গত কাল কের ঘটনা ভিন্ন ভাবে মনে পড়ে। মনে হয় সে সাড়ে তিন দিন আগে এসে পড়েছে। কিন্তু সে জানে সে মারা গেছে। মৃত্যুর পর সে সাড়ে তিন হাত কবর পায় নি, পেয়েছে সাড়ে তিন দিনের উল্টো চক্র।
I will see you again ..............রুদ্রর রিং টোন টা বাজছে।
“ বারবার এই দিন টাতে এই সকাল সাত টা বাহান্ন মিনিটে তোর মরা গাছে গোলাপ ফোটার খবর টা না দিলে হয় না? ” চোখ টা বন্ধ করেই রুদ্র ফোন টা ধরে। রুদ্রর কাছে ব্যাপার টা নতুন না হলে ও অর্পিতা প্রচণ্ড অবাক হয়। …………………………………………।।