ভালো কথা, বাজারি লেখক বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা দরকার। বাজারি লেখক মানে তুচ্ছ লেখক। তেল-সাবান-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাঁদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাঁদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তাঁরা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশির ভাগের ধারণা, তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাঁদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তাঁরা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাঁদের আক্রমণের নমুনা, অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্য তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎসাহিত্য থেকে বঞ্চিত। কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে না।...'
কালজয়ী এসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। বেশির ভাগ দেখা হয় দেশের বাইরের বইমেলায়। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তাঁরা কিছুটা বিচলিত বোধ করেন। কেন করেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এমন একজনের সঙ্গে কথোপকথনের নমুনা_
কালজয়ী : কেমন আছেন?
আমি : জি ভালো।
কালজয়ী : ইদানীং কিছু কি লিখছেন?
আমি : একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে আছি। আপনার দোয়া চাই যেন আরেকটা সস্তা লেখা লিখতে পারি।
কালজয়ী : (গম্ভীর)
আমি : আপনি কি মহান কোন লেখায় হাত দিয়েছেন?
কালজয়ী : আপনার রসবোধ ভালো। আচ্ছা পরে কথা হবে।
কালজয়ীরা আবার স্তুতি পছন্দ করেন। তাঁরা নিজেদের গ্রহ মনে করেন বলেই উপগ্রহ নিয়ে ঘোরাফেরা করতে পছন্দ করেন। গ্রহদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কখনোই থাকে না, কিন্তু উপগ্রহের সঙ্গে থাকে। উপগ্রহরা উপযাজক হয়েই টেলিফোন করেন। তাঁদের টেলিফোন পেলে আতঙ্কিত বোধ করি। কেন আতঙ্কিত বোধ করি তা ব্যাখ্যা করছি_
উপগ্রহের টেলিফোন এসেছে, কণ্ঠ উত্তেজিত। উত্তেজনার ভেতর চাপা আনন্দ।
হুমায়ূন ভাই! আপনাকে তো শুইয়ে ফেলেছে।
কে শুইয়েছেন?
বদরুদ্দীন উমর।
কোথায় শোয়ালেন?
সমকাল পত্রিকার সেকেন্ড এডিটরিয়েলে। উনি বলেছেন, আপনার লেখায় শিক্ষামূলক কিছু নাই।
এটা তো উনি ঠিকই বলেছেন। আমি তো পাঠ্যবই লিখি না। আমার বই শিক্ষামূলক বই হবে কেন? জীবনে একটাই পাঠ্যবই লিখেছিলাম_ কোয়ান্টাম রসায়ন । সম্ভবত ওনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
না হুমায়ূন ভাই, আপনি জিনিসটা হালকা দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। একটা বাদানুবাদ হওয়া উচিত। আপনি একটা কাউন্টার লেখা দিন। এটা আমার রিকোয়েস্ট।
আমি টেলিফোনের লাইন কেটে দিলাম। রাতের আড্ডায় আমার সমকাল-এর পাতায় শুয়ে পড়ার ঘটনা বললাম। বন্ধুরা আনন্দ পেল। আমার যেকোনো পতন আমার বন্ধুদের কাছে আনন্দময়।
এখন শিক্ষা বিষয়ে বলি। অতি বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের মানুষ সব কিছুতেই শিক্ষা খোঁজে। গল্প-উপন্যাসে শিক্ষা, নাটক-সিনেমায় শিক্ষা। একসময় ঈদে প্রচারিত হাসির নাটকের শুরুতেই আমি লিখে দিতাম_ 'এই নাটকে শিক্ষামূলক কিছু নেই।'
সাধারণ মানুষ এবং অসাধারণ সমালোচকরাই শুধু যে শিক্ষা খোঁজেন তা নয়, দেশের প্রধানরাও শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী। তাঁরাও একে অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নানান ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড হাতে নেন।
শিক্ষা নিয়ে এত উদ্বেগের পরও জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই মূর্খ হচ্ছি কেন কে বলবে?
_________________
(ফাউনটেনপেন)
বই মেলা তে এই বাজারি লেখকের খুব অভাব বোধ করি। চারিদিকে একটা নি:স্পৃহ ভাব। হিমুর জোৎস্না কিংবা মিসির আলির যুক্তি খোজে নেশাগ্রস্ত তরুনেরা। নিজেদের শুভ্র ভাবা যুবকেরা উদাস ভঙ্গি তে হাটে। চশমা পরিষ্কার করে। হয়তো কালজয়ী ছিলেন না, সাহিত্য মান টান আমিও বুঝি না তেমন। আমি বুঝি প্রতিটি লাইনে নেশা আর ঘোর। বই মেলা আপনাকে মিস করছে স্যার, একুশে চত্বর মিস করছে, নিজেকে শুভ্র ভাবা কোন এক তরুন আপনাকে মিস করছে, হলুদ পাঞ্জাবি পড়া রাতে হটতে বের হওয়া যুবক আপনাকে মিস করছে, প্যারা সাইকোলোজির কোন শিক্ষক আপনাকে মিস করছে, প্রথম প্রেমে পড়া কিশোরী আপনাকে মিস করছে, মধ্য ভয়সে প্রেমে পড়া অবিববাহিত কেরানি আপনাকে মিস করছে, নিজেকে বাকের ভাই ভাবা পাড়া মাস্তান টি আপনাকে মিস করছে, তেজস্বী কোন মহিলা আপনাকে মিস করছে, বেকার সেই যুবক আপনাকে মিস করছে, খামখেয়ালী জীবন যাপন করা মেধাবী যুবক মিস করছে, মদ খেয়ে বমি করে ভাসিয়ে দেয়া খালু আপনাকে মিস করছে, গ্রামের কোন প্রাইমারি স্কুল টিচার আপনাকে মিস করছে যে তার ছাত্রির প্রেমে পড়েছে। প্রজন্ম চত্বরে স্লোগান - " তুই রাজাকার" আপনাকে মিস করছে। মিস করছে স্যার, মিস করছে।