বাংলাভাই এবং শায়খ আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ জানিয়ে জিডি করা সাংবাদিক ( সেলিম জাহাঙ্গীর, ফটো সাংবাদিক-দৈনিক জনকণ্ঠ, রাজশাহী) এর লেখা টা থেকে অনেক সংবাদ যোগ করা হয়েছে । এছাড়াও বিভিন্ন দৈনিক এর কিছু সংবাদ এবং ছবি যোগ করা হল ।
শুরু টা হয়েছিল ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল । ওসমান বাবু (২৭)। বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা ওসমানকে কুপিয়ে আহত করার পর জবাই করে হত্যা করে। প্রকাশ্য দিবালোকে তারা ঘটনা টি ঘটায়। রাজশাহীর বাগমারায় ঘটনা টি ঘটানোর পর, সর্বহারা নিধনের নাম দিয়ে এরকম হত্যাকান্ড চালাতে থাকে তারা রাজশাহীর অন্যান্য থানাতেও ।
হত্যাকান্ডের খাতিয়ান : বাংলা ভাইয়ের স্টাইল ছিল উল্টো করে ঝুলিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা।
১ বছরের ভেতর এভাবে হত্যা করা হয় ৩২ জনকে । নির্যাতনে পঙ্গু হন বহু মানুষ । বাংলা ভাই বাহিনী ধরে নিয়ে যাবার পর নওগাঁর আত্রাই-রানীনগরের ধর্মীয় সংখ্যালঘু তরুণ সুফল ও সুশান্ত, বাগমারার সাজুরিয়া গ্রামের আবু তালেব ভুট্রা ও বারুইহাটি গ্রামের শহিদুল ইসলামসহ নিখোঁজ রয়েছেন আরও অন্তত: ৫/৭ জন মানুষ। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর ধরে এরা নিখোঁজ রয়েছেন। পুলিশ ও স্থানীয়দের ধারণা, নিখোঁজ সকলকেই হত্যা করা হয়েছে।
জঙ্গি মদদদানের অভিযোগে দায়ের করা বাগমারার হাসানপুরের নির্যাতিত ফজলুর রহমানের মামলায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক, রাজশাহী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শীশ মোহাম্মদ এর ৩১ বছরের কারাদন্ড হয়েছে। যদিও এই দুই অভিযুক্তকে পুলিশ বা র্যাব এখনও ধরতে পারেনি।
নিহতদের তালিকা: বাংলা ভাই বাহিনীর নির্যাতনে নিহত ৩২ জনের মধ্যে পরিচয় মিলেছে যাদের তারা হলেন ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল ওয়াসিম ওরফে ওসমান বাবুকে, ১১ এপ্রিল (১১ এপ্রিল নির্যাতনের পর ১৭ এপ্রিল নিহত) বাংলা বাগমারার কনোপাড়ার গোলাম রব্বানী মুকুলকে উপরে লটকিয়ে, ২০ এপ্রিল দূর্গাপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য আজাহার আলীকে, ২২ এপ্রিল নওগাঁর রানীনগরের বেলঘরিয়ার মোশারর হোসেন, নাটোরের পীরগাছার সাইফুর, ২৩ জুলাই নওগাঁ জেলার আত্রাইয়ের কাশিয়াবাড়ির দীপংকরকে একইভাবে, ২৭ এপ্রিল নওগাঁর আত্রাই কাশিয়াবাড়ির দীপংকর রায় ও ইউপি দফাদার, এপ্রিল মাসেই দূর্গাপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য আজাহার আলীকে নির্যাতন করলে তিনি অসুস্থ্য হয়ে গত বছরে মৃত্যুবরণ করেন, ১ মে আত্রাইয়ের ভোঁপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য শেখ ফরিদ, অজ্ঞাত ৩ ব্যক্তি, রাজশাহীর বাগমারার নীমপাড়ার রাবেয়ার ১৩ মে ধর্ষণের কারণে ১৪ মে আত্মহনন, ১৫ মে বহুল আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা ও সর্বহারার নেতা নওগাঁরা রানীনগরের সফিকপুরের আবদুল কাইয়ুম বাদশাকে হত্যার পর লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা, ২৪ জুন রানীনগরের সিম্বা গ্রামের আওয়ামী লীগ ও সর্বহারা নেতা খেজুর আলীকে টুকরো টুকরো করে কেটে, রাণনিগরের বড়গাছার আফজালকে, ৩০ জুন গাছে ঝুলিয়ে বর্বর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয় বাগমারার মাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ইয়াসিন আলী, ২৫ জুন নাটোরের বাসুদেবপুরে অজ্ঞাতনামা ৩ ব্যক্তিকে হত্যা, ১৪ নভেম্বর রানীনগরের ভেটি ক্যাম্পে ছাত্রলীগ নেতা জিয়াউল হক জিয়া, ২৭ নভেম্বর বাগমারার তাহেরপুরের বিষ্ণুপুরে বাসদ (মাহবুব) নেতা আলী আকবরকে, ২০০৫ সালের ২২ জানুয়ারি বাগমারার শ্রীপুরে আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুরকে হত্যা ও আওয়ামী লীগ নেতা জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন মৃধাকে হত্যা প্রচেষ্টা চালানো হয়। এছাড়া বাংলা ভাইয়ের নির্যাতনের শিকার হয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া বৃদ্ধ রহিমা বেওয়া কিছুদিন আগে মারা গেছেন। প্রায় ৫ বছর পর বাড়ি ফিরেছেন বাগমারার আবদুল বারী।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: অভিযোগ এসেছে স্থানীয় নির্যাতিত লোকদের কাছ থেকে । ভুক্তভূগী এলাকাবাসী দের কাছ থেকে ।
বাংলা ভাই বাহিনীর এসব কর্মকান্ডের প্রতি রাজশাহীর বহুল অেেলাচিত তৎকালিন এসপি মাসুদ মিয়া (জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে চাকুরিচ্যুত), রাজশাহীর পুঠিয়া-দূর্গাপুর থেকে নির্বাচিত বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজশাহী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নাদিম মোস্তফা, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী বর্তমানে এলডিপি নেতা আলমগীর কবির, সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী রহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, সাবেক ডাক ও টেলিযোগোযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক’র সরাসরি মদদ ও সহযোগিতা ছিল বলে অভিযোগ করা হয় ।
জামাতশিবিরের জেএমবির সাথে জড়িত থাকার নথি পুলিশের হাতে আসলেও তা উপরের নির্দেশে গায়েব করে ফেলা হয় ।
বাংলা ভাই এবং শায়খ আব্দুর রহমান কে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে গোলাম আযম,নিজামী রচিত বিভিন্ন বই এবং দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর বিভিন্ন ওয়াজের সিডি পাওয়া যায় ।যদিও মতিউর রহমান নিজামীর সেই বক্তব্য ‘বাংলা ভাই ও বাংলা ভাই বাহিনী বা জঙ্গি সংগঠনের কোন অস্তিত্ব নেই বাংলাদেশে। এসব মিডিয়ার সৃষ্টি।’ প্রচন্ড সন্দেহের উদ্রেকই ঘটায় ।
২০০৫ সালের ২২ জানুয়ারি বাগমারায় আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন মৃধাকে বাংলা ভাই বাহিনীর ক্যাডাররা হত্যা করতে এসে জনপ্রতিরোধের শিকার হয়ে জনতার ওপর বোমা হামলা চালিয়ে আওয়াম লীগ নেতা মাহাবুর রহমানকে হত্যা করে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিরোধে আটক বাংলা ভাই বাহিনীর তিন ক্যাডার গণপিটুনিতে নিহত হয় একই দিনে। এ ঘটনার পর ২০০৫ সালের ২৪ জানুয়ারি রাজশাহীর বিতর্কিত এসপি মাসুদ মিয়া প্রথম স্বীকার করেন যে, ‘বাংলা ভাই রয়েছে’। প্রায় একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী আবারও বাংলা ভাইকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার কিছুদিন পর দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রেফতারকৃত বাংলা ভাই বাহিনীর ক্যাডারদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বাংলা ভাই ও বাংলা ভাইয়ের আধ্যাত্মিক গুরু বলে পরিচিত শায়খ আবদুর রহমানের নেতা হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ-আল-গালিবের নাম বেরিয়ে আসে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে পুলিশ ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দিবাগত শেষ রাতে অর্থাৎ ২৩ ফেব্র“য়ারি ভোরে ড. গালিবকে তার তিন সহযোগী (আবদুস সামাদ সালাফী, আবদুল লতিফ ও আযীযুল্লাহ) সহ গ্রেফতার করে। বাংলা ভাই ও আবদুর রহমান প্রসঙ্গ কার্যত ধামাচাপা পড়ে যায়। ম্লান হয়ে যায় বাংলা ভাইর গ্রেফতার অভিযান।
২০০৫ সালের ১১ মার্চ রাজশাহীর তৎকালীন এসপি মাসুদ মিয়াকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। পরবর্তীতে জঙ্গি তৎপরতায় মদদ দেয়ার অভিযোগে এসপি মাসুদকে চাকুরিচ্যুত করে সরকার। ২০০৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এই পুরস্কারের টাকার পরিমাণ ঘোষণা করেন। এই দুই জঙ্গি সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পারলে এক কোটি টাকা পুরস্কার প্রদান করা হবে। যেকোন একজনকে ধরিয়ে দিতে পারলে দেয়া হবে ৫০ লাখ টাকার পুরস্কার। বহু নাটকীয়তার পর অবশেষে ২০০৬ সালের ১ মার্চ সিলেটের শাপলাবাগের সূর্য্যদীঘল বাড়ি হতে শায়ক রহমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর হাতে ধরা দেন। বাংলা ভাই একই সালের ৬ মার্চ ধরা পড়েন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার রামপুর গ্রামের একটি বাড়ি থেকে
কেন শুরু হল এই তৎপরতা:
সর্বহারা সন্ত্রাসীরা ২০০৪ সালের ৭ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যায় নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলাধীন কামারপাড়া বাজারে ভূমি উপমন্ত্রীর ভাইপো ও যুবদল নেতা গামাকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি সমর্থক সন্ত্রাসীরা নলডাঙ্গার কাজীপাড়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থক নেতা-কর্মীদের ৩১ টি বাড়ি ও ১৫টি দোকানে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। আগুন লাগানো হয় গান পাউডার ব্যবহারের মাধ্যমে। সাবেক উপমন্ত্রী দুলুর আরেক ভাইপো ও যুবদল নেতা ডলার এবং ভাগ্নে ডালিমের নেতৃত্বে প্রায় দু’শ লোকের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী এই তান্ডবলীলা চালায়। ওই সালের বছরের ফেব্র“য়ারিতেই সর্বহারাদের হাতে ভূমি উপমন্ত্রীর ভাইপো ও যুবদল নেতা গামা, গামার সহযোগি পুঠিয়ার সাধনপুরে যুবদল নেতা পাখি ও দূর্গাপুরের ওয়ার্ড কমিশনার বিএনপি নেতা আনোয়ার খুন হন। পাখি ও আনোয়ার কমিশনার নাদিম মোস্তফার খুবই ঘনিষ্ঠ। আর সাবেক ভূমি উপমন্ত্রীর ভাইপো কথিত সর্বহারাদের হাতে নিহত হবার পর সর্বহারাদের নিধনের জন্য জঙ্গিদের মাঠে নামানো হয় বলে শোনা যায়। শুরুর দিকে ক্যাডাররা নিজেদেরেকে ‘দুলু বাহিনী, গামা বাহিনী, আল কায়দা বাহিনী, মুসলিম রক্ষা পরিষদ, মুজাহেদীন বাংলাদেশ, হরকাত-উল জিহাদ’ সহ নানা নামে নিজেদেরকে জাহির করে। পরবর্তীতে তারা জাগ্রত মসলিম জনতা বাংলাদেশ বা জেএমজেবি নামে তাদের অপারেশন চালাতে থাকে। সর্বহারাবিরোধী অভিযান শুরুর মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই এলাকার সাধারণ মানুষ বুঝে ফেলেন যে, বাংলা ভাই বাহিনীর উদ্দেশ্য সর্বহারা নির্মূল নয়। ফলে নব্য এই সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী বাহিনীর কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষ অতি দ্রুতই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন।
কে এই বাংলা ভাই? : কথিত সর্বহারাবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে উত্তরাঞ্চলে হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে ভয়ংকর ত্রাস সৃষ্টিকারি একটি নাম বাংলা ভাই। জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ এর প্রধান ও জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)’র অপারেশনাল চিফ বাংলা ভাই ওরফে সিদ্দিকুল ইসলাম (৪৫)’র পিতা নাজির হোসেন। তার বাড়ি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার মহিষবাহান ইউনিয়নের কর্ণিপাড়া গ্রামে। বাংলা ভাই একই উপজেলার তরফ সরতাজ ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৯ সালে দাখিল, ১৯৯১ সালে আলিম, ১৯৯৫ সালে বগুড়া আযীযুল হক কলেজ থেকে বাংলায় বিএ অনার্স এবং ১৯৯৭ সালে একই কলেজ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি গাবতলী উপজেলার লাঠিগঞ্জ স্কুল ও কলেজে তিন বছর চাকুরি করেন বাংলার প্রভাষক হিসেবে। চাকুরির ফাঁকে ফাঁকে বগুড়া শহরে ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রিত রেটিনা কোচিং সেন্টার পরিচালনা করতেন। তবে অন্য একটি মতে, পরীক্ষার ফলাফল ভাল না হওয়ায় ছাত্রশিবিরের পরিচালিত ঢাকাস্থ কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা শুরু করেন। তার অন্য ভাই রফিকুল ইসলাম গাবতলী উপজেলার গেরিরহাটে চাতালের ব্যবসায় নিয়োজিত এবং আরেক ভাই জহুরুল ইসলাম গাবতলী উপজেলার মহিষবাহান ইউনিয়নের মোকসেদিয়া আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক। বাংলা ভাই গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার সাঘাটা গ্রামের চিলমানেরপাড়া মাদ্রাসার শিক্ষক ইব্রাহিম হোসেনের কন্যা রোকেয়া বেগমকে বিয়ে করেন। তার এক শ্যালক ওমর ফারুক সাঘাটা মাদ্রাসার শিক্ষক। ছাত্রজীবনে বাংলা ভাই ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন
বাংলা ভাই গ্রেফতার হয়েছিলেন, কিন্তু…: ২০০২ সালের ১৭ আগস্ট বাগেরহাটের মোল্লাহাটে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও আওয়ামী লীগ নেতা ও তার কন্যাকে হত্যার চেষ্টার অভিযোগে পুলিশ বাংলা ভাইকে তার সহযোগিদেরসহ গ্রেফতার করেছিল। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর পরই বাংলা ভাই তার জঙ্গি পরিচয় গোপন করে নিজেকে আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশের একজন নেতা ও বিশিষ্ট আলেম এবং তার নাম সিদ্দিকুল ইসলাম বলে উপস্থাপন করেছিলেন। বাংলা ভাই ওইসময় চার সপ্তাহ বাগেরহাট জেলহাজতে ছিলেন। কিন্তু বিএনপি-জামাত জোট সরকারের কতিপয় প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপির তদবিরে তিনি ছাড়া পান
এসপি মাসুদ মিয়ার সঙ্গে বাংলা ভাইয়ের বৈঠক : ২০০৪ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯ টায় বাংলা ভাই ঢাকা মেট্রো-চ-১১-০৪১১ নম্বরের সাদা রঙের মাইক্রোবাসযোগে ৭/৮ জন সশস্ত্র ক্যাডার নিয়ে বাগমারা থেকে রওনা দেন। মোহনপুরে এসে জনতার রোষানলে পড়ে ওই মাইক্রোবাসটি। জনতা ডাকাত মনে করে মাইক্রোবাসটি ঘিরে ফেলে। পরে ক্যাডারদের হাতে থাকা ওয়্যারলেস সেটে পুলিশে খবর দেন বাংলা ভাই। খবর পেয়ে তড়ি ঘড়ি করে পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজশাহী মহানগরীর বর্ণালী মোড়ে দ্বিতীয় দফায় জনতা মাইক্রোবাসটিকে আটক করে। এসময় একই কায়দায় বাংলা ভাই ওয়্যারলেসে আলফা-ওয়ান (পুলিশ কমিশনার এর সেট) এর কাছে সংবাদ পাঠান। এর কিছুক্ষণ পরেই আরএমপির পুলিশ কমিশনার এর একটি বিশেষ দল এসে বাংলা ভাই এর মাইক্রোটি নিয়ে যায় সরাসরি পুলিশ সুপারের অফিসে। ওইদিন পুলিশ সুপার মাসুদ মিয়ার সঙ্গে তার কার্যালয়ে প্রায় দু’ঘন্টাব্যাপী রুদ্ধদার বৈঠক করেন বাংলা ভাই। বৈঠক শেষে বাংলা ভাই মাইক্রোবাসে উঠে বাগমারার উদ্দেশে রওনা দেন। এর আগে দুই রাত বাংলা ভাইয়ের ওই দল মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে মাইক্রোবাসে করে সশস্ত্র টহল দেয়
২০০৪ সালের ২৩ মে বাংলা ভাই বাহিনীর হাজার হাজার ক্যাডার রাজশাহীতে সশস্ত্র মহড়া দেয়। এদিন সশস্ত্র মহড়া দেয়ার পর জঙ্গিরা রাজশাহীর তৎকালীন ডিসি (বর্তমানে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার) এম. আজিজ হাসান, এসপি মাসুদ মিয়া ও ডিআইজি (বর্তমানে পুলিশের আইজি) নূর মোহাম্মদের কাছে ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ এর নামে স্মারকলিপি প্রদান করে। ওইসময় প্রশাসন জঙ্গি বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডারদের জামাই আদর করে প্রটেকশন দিয়েছিল
কয়েকজনের কথা :
রানীনগরের বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলা ভাই বাহিনীর হাতে নির্যাতিত আবদুল জলিল (৫৮) একাত্তরে অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সেই দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকে বাংলা ভাই বাহিনী হাত থেকে খাবারের প্লেট ফেলে দিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। অশ্র“সিক্ত চোখে তিনি তার ওপর পরিচালিত বর্বর নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করার সময় সেখানে উপস্থিত সকলের চোখ অশ্র“সিক্ত হয়ে ওঠে। একইভাবে ভেটি মাদ্রাসার নৈশ প্রহরি আবদুর রাজ্জাক (৫২) কে পিটিয়েছে জঙ্গিরা। তার ওপর গরম পানি ঢালা হয়েছে। তিনি এখন পঙ্গু (প্রতিবন্ধি)। তিনি বলেন, ‘আল্লাহই ওদের বিচার করবে’। পঙ্গু (প্রতিবন্ধি) ফজলুর রহমান বলেন, ‘এই বাংলার মাটিতেই বাংলা ভাই ও তার সহযোগিদের ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু তাদের পৃষ্ঠপোষকরা এখনও বহাল তবিয়তে। তাদেরও বিচার করতে হবে। আমার এই একটাই চাওয়া।’ বাংলা ভাই বাহিনীর নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ শাফিনুর নাহার বলেন, ‘বাংলা ভাই বাহিনীর অপকর্মের বিরুদ্ধে আমিই প্রথম মামলা দায়ের করি। জঙ্গিদের ভয়ে এডভোকেট মামলার তদবির করারও সাহস পাননি। জঙ্গি মদদদাতা ও গডফাদার, এসপি মাসুদ মিয়া ও বাংলা ভাই বাহিনীর সকল ক্যাডারদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।’
বাংলা ভাই বাহিনী ধরে নিয়ে যাবার পর থেকেই নিখোঁজ বাগমারার সাজুরিয়া গ্রামের আবু তালেবের মা রাবেয়া বেওয়া বললেন, ‘বাংলা ভাইর সন্ত্রাসীরা আমার ছেলেকে রমজান কায়ার বাড়িতে ধরে নিয়ে যায়। আমি বাংলা ভাইর কাছে গেলে সে আমাকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। আমার ছেলে পানি পানি করে চিৎকার করলেও ওরা এক ফোটা পানি দেয়নি। ওরা আমাকে ও আমার স্বামীকেও হত্যার হুমকি দেয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করনু। কিন্তু আমার ছেলের খোঁচ আইজ পর্যন্ত পানুনা। আমি এখন কি খাবো। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই, ক্ষতিপূরণ চাই।’নিহত মুকুলের মা খোদেজা বেওয়া বলেন, ‘তাহেরপুর হাইস্কুল মাঠে ইসলামী জলসার নামে আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে গাছে লটকিয়ে আমার ছেলেকে মেরেছে ওরা। নির্যাতনের আত্মচিৎকারের সময় আমি শুধু মা ডাক শুনতে পেয়েছি। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’ জঙ্গিরা খেজুর আলীর লাশ চার টুকরো করে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল। সেই খেজুরের স্ত্রী রেবেকা সুলতানা বলেন, ‘বাংলা ভাইয়ের ক্যাডাররা প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের ইশারায় আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে মারতে মারতে তুলে নিয়ে যায়। ধান বিক্রির টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে। আমার স্বামীর অপরাধ একটাই, সে থানা ছাত্রলীগের পাঠাগার সম্পাদক ছিল। বাংলা ভাই কি করে থানার পুলিশের সামনে দিনের আলোয় হত্যা-নির্যাতন করতে পারলো? বৃদ্ধ শ্বশুর আর আমার দুই শিশু কন্যার এখন কি হবে? জঙ্গিরা ও তাদের পৃষ্ঠপোষক আলমগীর কবিররা কি বলতে পারবে আমরা এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? সরকার এমন একটি বাহিনী বানালো যে বাহিনী জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলো না। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে সিম্বা স্কুল ভোট কেন্দ্রে আলমগীর কবির ক্যানভাস করার সময় আমার ভাই প্রতিবাদ করায় লাশ চার টুকরো করে তার প্রতিশোধ নিয়েছে। বাংলা ভাইয়ের ক্যাডাররা এখন বলে বেড়াচ্ছে খেজুরকে চার টুকরো করলাম, বাদশার লাশ গাছে ঝুলালাম। কিছুইতো হলো না। শুধু নাটকীয়ভাবে আমাদেরকে গ্রেফতারই করা হবে। কিছুই হবে না আমাদের। আমি সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির ও ক্যাডারদের ফাঁসি চাই। ক্যাডাররা এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে আইন তাদের ধরছে না কেন?’
আত্রাই উপজেলার কাশিয়াবাড়ীর নিহত দীপংকরের পিতা দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই, ওদের ফাঁসি চাই।’ বাগমারার নিহত ইয়াসিনের পিতা ইসমাইল বলেন, ‘আমার ছেলে ইয়াসিন আওয়ামী লীগের সদস্য। আমার ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। আপনাদের কাছে আমার এটাই অনুরোধ ও দাবি।’ নাটোরের নলডাঙ্গা সরগতিয়া গ্রামের মনোয়ার হোসেন বাবু, যাকে বাংলা ভাই নিজে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল হত্যা করে। বাবুর পিতা মহসিন বলেন, ‘আমার ছেলে তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী ছিল। মন্ত্রী ডুলুর (সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু) ক্যাডার বাংলা ভাইরা আমার ছেলেকে শুধু হত্যাই করেনি আমার বাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করেছে। আমাকে ও আমার পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। ২০০১ এর জাতীয় নির্বাচনের পর বাবুকে দু’বার হত্যার চেষ্টা করে ডুলুর লোকেরা। কিন্তু কোন বিচার নাই। আমি ছেলে হত্যার বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাই।’ অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আত্রাই ভোঁপাড়ার নিহত শেখ ফরিদের শিশু কন্যা ফারজানা বলেন, ‘আমার বাবা নিরপরাধ ছিল। আমার বাবাকে বাংলা ভাই ও তাদের স্থানীয় অনুসারী ক্যাডাররা কি জন্য মারলো-আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই।’ শেখ ফরিদের স্ত্রী লাইলী বেগম বলেন, ‘বাংলা ভাইসহ ৯ জন ক্যাডার আমার স্বামীকে তিন ঘন্টা ধরে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। আমি আপনাদের কাছে আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’ নওগাঁর রানীনগর সফিকপুরের আবদুল কাইয়ুম বাদশা যাকে হত্যার পর লাশ বগুড়ার নন্দিগ্রামের ভাটরা ইউনিয়নের বামন গ্রামের রাস্তার ধারে গাছের ওপর উল্টো করে লটকিয়ে রাখা হয়েছিল। বাদশার ছোট ভাই স্কুল শিক্ষক মাহমুদ মুসা বলেন, ‘বাংলাদেশের একটি কলংকজন অধ্যায় ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রচনা করেছিল বাংলা ভাই। সেসময় অত্যাচার-নির্যাতনের একটি নতুন মডেল আমরা দেখতে পাই। কুখ্যাত বাংলা ভাই-শায়খ রহমান ও জেএমবির অত্যাচারের শিকার আমরা। দেশে আইন-কানুন, পুলিশ, র্যাব, আর্মি, বিডিআর থাকার পরও একটি প্রাইভেট বাহিনী কেন নামানো হলো? আমার ভাই বাদশাকে অপহরণ করে বাঁশবাড়িয়া ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ সেই ক্যাম্প এখনও তল্লাশি করেনি। ক্যাম্পটি এখনও সচল। মাইকিং করে জবাই ও বিচার করার ঘোষণা দিয়ে বাদশাকে হত্যা করে ওরা। এটা কোন দেশ কোন আইনের অধীনে আমরা আছি। নওগাঁর তৎকালিন এসপি ফজলুর রহমানের কাছে গিয়ে বলেছিলাম আমার ভাই অপরাধী হলে তাকে গ্রেফতার করে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দিন। তখন এসপি বলেছিলেন, ‘এটি রাজনৈতিক হাই কমান্ডের নির্দেশ। আমাদের করার কিছুই নেই।’ আমি বাংলা ভাই, শায়খ রহমানের মত তাদের পৃষ্ঠপোষকদেরও ফাঁসি চাই। এলাকায় এখনও যারা বহাল তবিয়তে বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায় যারা আমাদের হুমকি দিচ্ছে তাদেরকেও গ্রেফতার ও শাস্তি দিতে হবে। জঙ্গিদের গডফাদার মন্ত্রী-এমপিদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানাচ্ছি ।
জঙ্গি তৎপরতা হত্যা-নির্যাতন বন্ধ করার দাবিতে বাংলা ভাইয়ের নামে প্রথম জিডি : ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন পেশাদার সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী হলেও সামাজিক কমিটমেন্ট বা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে ২০০৪ সালের ৩০ মে মৌলবাদি জঙ্গি সংগঠন জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমবি)’র নেতা তথাকথিত বাংলা ভাই বাহিনীর হত্যা-খুন-নির্যাতন-চাঁদাবাজি ও সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক দুই নেতাকে হত্যার হুমকিদানের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে দু’টি জিডি দায়ের করি। কিন্তু ওই জিডি দু’টির আজও কোন তদন্ত করেনি পুলিশ। জিডিতে বলা হয়, (বাগমারা থানার জিডি নম্বর-১৬৪৭, বোয়ালিয়া থানার জিডি নম্বর-১৫৮৭ উভয়ের তারিখ-৩০/০৫/২০০৪) ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল থেকে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের বাগমারা, আত্রাই, রানীনগর, নাটোরের নলডাঙ্গা, দূর্গাপুর, পুঠিয়া প্রভৃতি এলাকায় কথিত সর্বহারা দমনের নামে মানুষের ওপর নির্যাতন-জুলুম চালাচ্ছে। হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ফসল লুটসহ নানা অপকর্ম করছে। দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকা সত্ত্বেও বাংলা ভাই বাহিনী তথা একটি প্রাইভেট বাহিনী দেশের প্রচলিত আইন-কানুন ও সংবিধানের কোন তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষের ওপর বর্বর ও নৃশংস নির্যাতন চালাচ্ছে। মানুষকে উপরে লটকিয়ে নির্যাতন, নির্যাতনের পর লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটানো হয়েছে। এসব কারণে মানুষের মধ্যে ভীতি, ত্রাস ও আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদ ও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৫ ধারা অনুযায়ী কেউ কাউকে কোন অবস্থাতেই নির্যাতন করতে পারবে না। কিন্তু তারপরও স্বঘোষিত বাংলা ভাই ওরফে সিদ্দিকুল ইসলাম পিতা নাজির হোসেন ওরফে শমসের আলী, সাং-কর্ণিপাড়া, উপজেলা-গাবতলী, জেলা-বগুড়া’র নেতৃত্বে কথিত সর্বহারা দমনের নামে গণ-মানুষের ওপর চলছে বাংলা ভাই বাহিনী’র একাত্তরের কায়দায় বর্বর নির্যাতন। বাংলা ভাই বাহিনী’র নির্যাতনের মাধ্যমে ১ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত (জিডি করার দিন পর্যন্ত) এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যসহ মোট ১০ জন হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় দু’শ মানুষ।
বাংলা ভাই বাহিনী’র অপরাধ, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও নৈরাাজ্যের খবর পরিবেশন করার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাই বাহিনী’র জঙ্গি সন্ত্রাসীরা ৪ সাংবাদিক এবং বাংলা ভাই বাহিনী’র তৎপরতা বন্ধের লক্ষ্যে আন্দোলনের নেতৃত্বদানের কারণে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক ও ওয়ার্কাস পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য ও বর্তমান সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশাকে হত্যার হুমকি দেয়। ২০০৪ সালের ২৩ মে হাতে লাঠি, হকিস্টিক, ছোরা, বল্লম, কালো ব্যাগ ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে ওই বাহিনী বাগমারা থেকে রাজশাহী মহানগরীতে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছে। ওইদিনই সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বাংলা ভাই বাহিনী’র জঙ্গিরা এই হুমকি দেয় বলে জিডিতে উল্লেখ রয়েছে। এই জিডি ছাড়া বাংলা ভাইয়ের নামে সরাসরি কোন অভিযোগ নেই বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের কোন থানায়। কিন্তু পুলিশ ওই জিডির কোন তদন্তই করেনি
জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেয়। এরপর তারা চট্টগ্রামের আদালতে বোমা বিস্ফোরণ, গাজীপুর, নেত্রকোনাসহ কয়েকটি স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হতাহত করে। ঝালকাঠিতে দুই বিচারককে হত্যা করে দেশে চরম অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করে। আর র্যাব নামে জেএমবি নিধনে। অবশেষে তারা সফলতার সঙ্গে জেএমবির আমির শায়খ আবদুর রহমান, সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ কয়েক শ জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করে তাদের গতি থামাতে সমর্থ হয়। র্যাব কর্মকর্তারা মনে করেন, এসব কারণেই জেএমবি দুর্বল হয়ে যায়।
র্যাবের মিডিয়া উইং প্রধান কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জেএমবি এখন আর খুব একটা সক্রিয় নয়। তবে কেউ সক্রিয় হয়ে উঠছে কি না, তার খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। যেসব জঙ্গি পলাতক রয়েছে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।'
১৭ আগস্ট যা ঘটেছিল : ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট। দিনটি ছিল বুধবার। সারা দেশেই স্বাভাবিক জীবন চলছিল সবার। সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে দেশের ৩৫০টি স্থানে পাঁচ শতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে দুজন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। গ্রেপ্তার ও আটক করা হয় শর্তািধক ব্যক্তিকে। সিরিজ বোমা হামলার খবর শুনে অফিস-আদালত সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলায় প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা দেশ। এরপর ধারাবাহিকভাবে একেক এলাকায় বোমা হামলা চলতে থাকে। এ পর্যন্ত জঙ্গিদের বোমায় জীবন দিতে হয়েছে ঝালকাঠির দুই বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদসহ ৩৩ জনকে। পুলিশ, আইনজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউই রক্ষা পাননি জঙ্গিদের বোমাবাজির হাত থেকে। অসংখ্য মানুষকে হতে হয়েছে পঙ্গু। বোমার স্প্লিন্টার এখন শরীরে বহন করছেন গাজীপুরের শরিফুল ইসলাম, নেত্রকোনার আবদুর রবসহ আরো অনেকেই।
১৭ আগস্ট বোমা হামলার পর আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ দায়িত্ব স্বীকার না করলেও প্রতিটি বিস্ফোরণস্থলে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নামে বাংলা ও আরবি ভাষায় লেখা লিফলেট পাওয়া যায়।
সেই লিফলেটে ইসলামী আইন বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়। সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, বিডিআর সবার প্রতি তাগুতি আইন বদলে আল্লাহর আইন হেফাজতে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
পরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শতাধিক ব্যক্তিকে। তাদের মাঝ থেকে প্রথম সাতক্ষীরার দুই সদস্য স্বীকার করে, এ ঘটনা জেএমবিই ঘটিয়েছে। এর পেছনে পরিকল্পনা ও অর্থিক সহযোগিতা জেএমবির আমির শায়খ আবদুর রহমানের। এরপর শায়খ রহমানকে গ্রেপ্তারের জন্য মাঠে নামে পুলিশ ও র্যাব। শায়খ রহমানকে গ্রেপ্তারের জন্য রাজধানীসহ একাধিক স্থানে অভিযান চালায় র্যাব। অবশেষে ২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেটের টিলাগড় এলাকায় র্যাব খুঁজে পায় শায়খ রহমানকে। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে র্যাব গ্রেপ্তার করে জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে।
তারা গ্রেপ্তারের পর জেএমবিপ্রধানের দায়িত্ব পায় মাওলানা সাইদুর রহমান। এরপর সাইদুর রহমানকে গ্রেপ্তারের জন্য মাঠে নামে র্যাব ও পুলিশ। অবশেষে গত বছরের মে মাসে সাইদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। একের পর এক জেএমবি সদস্য গ্রেপ্তারের ফলে জেএমবি দুর্বল হয়ে পড়ে। গত ৩ আগস্ট দুজন জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তবে এই দুজন আগে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিল। জামিনে বেরিয়ে এসে পরে পলাতক থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই গ্রেপ্তারের পর দলের দায়িত্ব নেয় মাওলানা সাইদুর রহমান ওরফে আবু জাফর। শুরা সদস্য হিসেবে যোগ দেয় আসাদুল ইসলাম আরিফ, বিপ্লব, রাসেল ওরফে যুবায়ের, আনোয়ার হোসেন ওরফে ফারুক। পরে তাদের মধ্যে দুজন ছাড়া অন্যদের গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
২০০৭ সালের ২৯ মার্চ শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইকে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর বাইরে থাকা জঙ্গিরা প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ২০০৭ সালের ৯ জুলাই ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার তিতলিয়া গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক ও র্যাবের সোর্স আনোয়ারকে গুলি করে হত্যা করে সাগর হোসেন ওরফে সায়েম এবং সাইফুল ইসলাম নামের দুই জেএমবি সদস্য। হত্যাকারী সাগর হোসেন ও সাইফুল ইসলামকে স্থানীয় জনগণ ধাওয়া করে ধরে ফেলে এবং তাদের স্থানীয় পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব।
২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর জঙ্গিরা বোমা হামলা চালিয়ে ঝালকাঠিতে বিচারক সোহেল আহমেদ ও জগন্নাথ পাঁড়েকে হত্যা করে। বিচারক হত্যা মামলায় জেএমবি নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, ইফতেখার হাসান আল মামুন ও আসাদুল ইসলাম আরিফকে আসামি করে মামলা করা হয়।
এরপর শায়খ রহমানকে ২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। একই বছর ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এলাকা থেকে বাংলা ভাই, ১৯ মার্চ ডেমরা থেকে খালেদ সাইফুল্লাহ, ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে আতাউর রহমান সানি, একই বছরের ১৭ নভেম্বর ঠাকুরগাঁও থেকে আবদুল আউয়াল ও ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠি থেকে ইফতেখার হাসান আল মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলেও আসাদুল ইসলাম আরিফ থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবশেষে ২০০৭ সালের ১০ জুলাই তাকে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব