ঐশীর ছড়া
*****
মৌমাছি মৌমাছি
মৌমাছি মৌমাছি
মধু নিয়ে কোথায় যাস?
আমাকে দিয়ে যাস।
না না না
দিব না দিব না
একটু তো দিস।
না, না না।
প্রজাপতি প্রজাপতি
প্রজাপতি প্রজাপতি
একটু কাছে আয়
না না না
যেখানে যাস
আমাকে নিয়ে যাস।
ছোট পাখি ছোট পাখি
ছোট পাখি ছোট পাখি
একটু কাছে আয়
আয় আয় আয়।
না না,
কাছে এলে ধরে ফেলবে
না না, ধরবো না।
না না,
আমি কাছে আসবো না।
*********
সাইফের ছড়া
১.
কতো রকমের রং যে আছে
কোন্টা ছেড়ে কোন্টা আঁকি?
আমি যে ছবি আঁকি
লাল, বেগুনি।
নীল আকাশে পাখি
কতো রং দিয়ে আঁকি।
২.
স্বাধীনতার জন্য কতো মানুষ
শহীদ হলো
সবাই যুদ্ধ করেছে
পাকিস্তানিদের সাথে।
সবুজ পাতার ভিতর
লাল রঙের ফোঁটা
বাংলাদেশের পতাকা।
*******************************************************
আমার নিজস্ব কোনো পড়ার বা লেখার টেবিল নেই, কারণ আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে অনেক আগেই; এখন এগুলোর বিশেষ কোনো দরকারও পড়ে না, অবশ্য ছাত্রজীবনেও তেমন দরকার পড়তো না, কারণ, শুয়ে শুয়ে পড়ার মধ্যেই আমার যতো শান্তি ও তৃপ্তি। ছেলেমেয়েদের পড়া ও লেখার টেবিল, ডাইনিং টেবিল, ফ্রিজের 'ছাদ', বুকশেল্ফ, শো-কেস, ট্রাংক, আলমিরা, টিপয়, এমনকি ড্রইং রুম ও বেডরুমের মেঝেভর্তি প্রচণ্ড অগোছালো চিঠিপত্র, পাণ্ডুলিপি দেখে আমার দুই ছেলেমেয়ে এমনিতেই অতিষ্ঠ। স্ত্রীও অতিষ্ঠ কম নয়। আমার কাজ হলো ঘর এলোমেলো করা, তার কাজ হলো কাজের ছেলে নিয়ে ওগুলো গোছানোর প্রাণপণ চেষ্টা করা, যদিও জীবনেও গোছানো হয়ে ওঠে না, কারণ, গোছানোর আগেই ঘর আগের মতো আবার অগোছালো হয়ে যায়। পত্রিকা সংক্রান্ত কাজ করার সময় কম্পিউটার কি-বোর্ডে আমার হাতের আঙ্গুলগুলো যথাসম্ভব দ্রুত ছুটতে থাকে, তখন নিজের অজান্তে, কখনো বা মনের 'অকারণ' আনন্দে একদম প্রাণের ভিতর থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে 'পাঁচমিশালি' অতি উচ্চাঙ্গীয় সঙ্গীত নন-স্টপ বের হতে থাকে। বাসায় মেহমান থাকলে স্ত্রী মাঝে মধ্যে এসে নিচু স্বরে বলে যায়, আমি যেন এরূপ 'অশ্রুতপূর্ব' সুললিত সুরের গান বন্ধ রাখি। কখনো বা মৃদু ভর্ৎসনা করে বলে, তোমার গান শুনে ওরা লজ্জা পাচ্ছে, পরে গেয়ো, ওরা যাবার পর, নইলে বাথরুমে যাও। কিন্তু আমি থামি না। কারণ, মেহমান লজ্জা পাচ্ছে এটা স্ত্রীর ধারণা মাত্র, বাস্তবে দেখি মেহমানরাও প্রথমে গুনগুন সুরে আমার সাথে তাল মেলায়, পরে তারা নিজেরাই প্রধান গায়কে পরিণত হয়। বাসায় শালা-শালি ও তাদের বউ-জামাইরা থাকলে খুব জমে, ওরা গানের এতোই পাগল যে ওদের গলার অত্যাচারে আমার তখন ঘর ছেড়ে পালাবার দশা হয়। তবে ওরা যেভাবে সবগুলো গানের কথা আর সুরকে একত্র করে গায় তাতে যে কেউ বলবেন যে ওরা ওদেরই স্বরচিত সুর ও কথায় গান পরিবেশন করছে। আমার এক ছোটভাই জানে যে আমি খুব গানের (হযবরল টাইপের) ভক্ত, সামনাসামনি গান গাইতে সে খুব লজ্জা পায়, ছাদে গিয়ে উঁচু গলায় তার ভাবীকে (আমার স্ত্রী) গান শোনায়, যাতে আমি সেই গান শুনে বলি, ছাদে গেছিস কেন, ঘরে আয়, আমরা দুজনে কোরাস গাই।
একবার ইমরান টেলিফোনে আমার গাওয়া একটা মরমী সঙ্গীত শুনে অভিভূত হয়ে বলে, দোস্, তোর তো দেখি চমৎকার গলা। আমি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওকে আরো কয়েকটা গানের কিছু কিছু চরণ গেয়ে শোনাই। ও আমাকে অজস্র ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, আজকাল তো গানই শোনা হয় না। সময় নেই। অনেক দিন পর তোর গান শুনে বুকটা ভরে গেল।
শাহনাজের কাছ থেকে টেলিফোনে একটা বইয়ের সমালোচনা লিখে নিচ্ছিলাম। লেখা শেষে সে বলে, এবার পড়ে শোনা। আমি পড়ে শোনাই। ও বলে, আমি আবার গোড়া থেকে বলি, এবার অতো ভুল করিস না। দ্বিতীয়বার ভুল হয় নি। শেষমেষ সে বলে, তোর গলা কিন্তু সত্যিই 'অপূর্ব'। আমি বলি, এবার তাহলে ঐ গানটা শোন্.... নিশি রাইতে যাইও ফুলবনে গো বন্ধুয়া। দরদ দিয়ে গাইছি, (আমি সব গানই খুব দরদ দিয়ে গেয়ে থাকি) ও মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলে, গানের কলির তো বারোটা বাজিয়ে দিলি। আমি হেসে বলি, স্যরি, আমি বোধ হয় বিজ্ঞাপনের কথাগুলো দিয়ে গেয়েছি, তাই না? ও বলে, এটা কোনো বিজ্ঞাপনের ভাষাও না, অরিজিন্যল গানের কথাও না, তুই সবগুলো একদম গুলিয়ে ফেলেছিস। ওকে থামিয়ে আমি বলি, 'আমার কাছে গানের কথার চেয়ে গানের সুরটাই প্রধান। ও কিটকিট করে হেসে বলে, আমার বড় বোনের মতো। আমি বলি, তাহলে তোর বোনকে নিয়ে একদিন আমাদের বাসায় আয়। করিম, ইমরান, আর শাহজানকেও ওর বউ-বাচ্চা সহ আসতে বলি। আমি আর তোর বোন যুগল গান গাইব।' শাহনাজ বলে, 'সেটা একটা ভালো প্রস্তাব, তবে তোর বাথরুমের সামনে কি বসার সুব্যবস্থা আছে?' আমি বলি, কেন? ও বলে, এসব হলো বাথরুমের গান। আমার বোন কিন্তু স্টেজেও ওঠে। তুই বাথরুমে ঢুকে গান গাইবি, আমরা বাইরে বসে গালে হাত দিয়ে একমনে সেই গান শুনবো। বলেই হেসে ফেলে বলে, 'কী, মাইন্ড করলি?' আমি মাইন্ড করি না। বলি, 'তুই তো ঠাট্টা করলি, কিন্তু তুই জানিস না, বাথরুমেই শিল্পীদের আসল গানটা বের হয়। গোসল করতে বাথরুমে ঢোকার দশ পনর মিনিট আগে থেকে আমার গানের রেওয়াজ চলতে থাকে। মনের ভিতরে ভাব জমতে শুরু হয় আর কী। বাথরুমে ঢুকলে আমি ভাবের পাগল আর গানের পাগল হয়ে যাই, দীন-দুনিয়ার কথা আমার তখন কিচ্ছু মনে পড়ে না রে, শাওয়ারের পানি ঝরার শব্দকে মনে হয় বাদ্যযন্ত্রের বাজনা, আমি সেই বাজনার সাথে একাত্ম হয়ে যাই। বাথরুম থেকে বাইরে আসার পরও আমার শরীর মনে সেই ভাব বহুক্ষণ ধরে চলতে থাকে।'
গান গাওয়া-গাওয়ি নিয়ে মাঝে মাঝে বেশ তিক্ততারও সৃষ্টি হয়। একদিন গাইছিলাম 'নদীর জল ছিল না কূল ছিল না, ছিল শুধু ঢেউ, আমার একটা নদী ছিল জানলো না তো কেউ।' খুব দরদ দিয়ে গাইছিলাম, আমার নিজের চোখেই পানি এসে যাচ্ছিল (অথচ পথিক নবীর গলায় শোনার সময় আমার কোন ভাব আসেনি)। ওমা, স্ত্রী বলে কী, এমন গান শুনলে পাগলা কুকুর কিন্তু দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়বে। আমি কিছুটা রেগে গিয়ে বলি, আমি গান গাওয়া শুরু করলেই তুমি তাতে বাধা দাও। জানো না এতে আমার রক্তচাপ বেড়ে যায়? সে মুচকি হেসে বলে, 'আমি কি গান গাইতে তোমাকে কখনো মানা করেছি? তোমার গান শুনতে তো আমার ভালোই লাগে। তুমি আমার প্রিয় শিল্পী না?' সত্যিই এ কথায় আমার শরীরে আগুন জ্বলতে থাকে। সে কাছে বসে বলে, 'বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে আমরা যখন রাতদুপুরে হেঁটে হেঁটে আমাদের বাড়ি থেকে তোমাদের বাড়িতে যেতাম, তখন তুমি কতো গান গাইতে, আমি কি তখন মানা করতাম? বরং কান খাড়া করে শুনতাম তুমি কীভাবে জানা সুরে না-জানা গান নিজের কথা দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে গাইতে। আমার কিন্তু খুব ভালো লাগতো যে তুমি শুধু গায়কই না, গীতিকারও।'
স্ত্রীর এ কথা শুনে সেদিন আমি বাসার সবচাইতে সুন্দর প্লেট, যেটিতে আমি খাই, ভাংতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভাঙ্গি নি, ভাবলাম, যারা গান বোঝে না, গান নিয়ে যারা রসিকতা আর উপহাস করে তাদের সাথে আবার অভিমান কীসের?
একদিন বিকেলে বারান্দায় বসে আমার ছোট শ্যালিকা গুনগুন করে নিচু সুরে গাইছে, 'নদীর জল ছিল না.....'।
স্ত্রী হেসে হেসে বলে, 'ব্যাপার কিরে, তোর দুলাভাইয়ের বানানো গান তুই কই পেলি?'
শ্যালিকা অবাক হয়ে বলে, 'এটা কি দুলাভাইয়ের লেখা?'
স্ত্রী বলে, 'এমন আজগুবি গান আর কে বানাবে?'
'নাহ্,' শ্যালিকা বলে, 'এই গানের সিডি বের হয়েছে কতো আগে! আমার প্রিয় গান এটা, রোজই শুনি।'
''সতিই?' স্ত্রী বলে, 'তাহলে এই গানের অর্থ কী? নদীতে পানি নেই, অথচ ঢেউ আছে। মাতাল না হলে এই অর্থহীন গান কেউ শোনে?'
শ্যালিকা হাসতে হাসতে বলে, 'আপারে আপা, মাতাল না হলে কেউ গান লিখতে পারে? গান শোনেও ওরকম মাতালরাই।'
আমি স্ত্রীকে বলি, 'আমার গাওয়া সব গানকেই আমার নিজের বানানো গান মনে করো না। আমি ভালো গানও জানি।'
শ্যালিকা উৎসাহী হয়ে বলে, 'দুলাভাই, আপনার একটা ভালো গান শোনান তো, আজ শুনি।'
আমি বলি, 'আব্দুল আলীমের গাওয়া একটা পল্লীগীতি ডলি সায়ন্তনী নতুন করে গেয়েছে, সুর আর কথায় অবশ্য একটু ভেরিয়েশন আনা হয়েছে। শোন্... বহুদিনকার পীরিত গো বন্ধু, একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না।'
আমি খুব দরদ দিয়ে গাইলাম, স্ত্রী আর শ্যালিকা খুব মগ্ন হয়ে শুনলো। গাওয়া শেষে বলি, এমন গান কি আর দ্বিতীয়টি হয়? শ্যালিকা বলে, 'গানটা খুবই চমৎকার। ভালো গলায় গাইতে পারলে এক গানেই সুপার স্টার হওয়া যায়।' আমি বলি, 'তাহলে এবার বোঝো।' শ্যালিকারত্ন বলে, 'দুলাভাই, আপনি মাইন্ড করবেন না কিন্তু, এগুলো ভালো গান হলেও ব্যাকডেটেড। আপনিও কিন্তু আগের দিনের গান আর পল্লীগীতি ছাড়া কিছু জানেন না। ব্যান্ডের গান কতো সুন্দর তা জানেন? হিন্দি গানও তো আপনার কাছে ভালো লাগে না।' জরুরি একটা কাজ ছিল বাইরে। শ্যালিকার সাথে কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই।
রাতে বাসায় ফিরলে দেখি দ্বিতীয় শ্যালক তার স্ত্রীকে নিয়ে হাজির। ডাইনিং টেবিলে সবাই চিন্তিত মুখে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। শ্যালক হেসে দিয়ে বলে, 'কী, আমরা তো ভাবছিলাম দিওয়ানা হইয়া বনে চইল্যা গেছেন বুঝি। যাক ভালোই হইলো।'
খাওয়া দাওয়া এক সঙ্গে করার পর ডাইনিং টেবিলে বসেই শ্যালক গান ধরলো। তার সাথে তার বউও। দেখি দুজনে প্রতিযোগিতা করছে, কে কতো বেশি গান জানে তার প্রতিযোগিতা। আমার ভিতরের রাগ চলে গেছে। ওদের সাথে আমি কখন যোগ দিয়েছি টের পাই নি। আমি শুধু পুরনো দিনের গান জানি এটা ঠিক, এবং এ ব্যাপারে আমার খুব গর্বও ছিল যে পুরনো দিনের গান হলো স্বর্ণ-সঙ্গীত, সেগুলোতে আমি ভরপুর। কিন্তু দেখি ওরা শুধু পুরনো দিনেরই না, কী যে ওরা জানে না আমি তাজ্জব হয়ে তা ভাবতে থাকি। অনেক আগেই শ্যালিকা আর স্ত্রী ঘুমের ঘরে চলে গেছে। আমিও বার তিনেক উঠতে চেয়েছি, কিন্তু এ দুজন টেনে ধরেছে, বসেন, গান শেষ হয় নাই। গান শেষ হলো সাড়ে চারটার দিকে। মাত্র ঘন্টা দুয়েক ঘুমানোর পর সাড়ে ছয়টায় আমাকে অতি প্রয়োজনে উঠে বাইরে যেতে হয়। তিনটায় বাসায় ফিরে কোনোমতে নাকে মুখে কিছু গুঁজে শুতে যাবার সময়ই শ্যালক হাত ধরে টান দিল, গান তো আরো আছে। ওর মুখে দুষ্টু হাসির ঝিলিক। আমি বলি, 'স্টুপিড, তোরা ভাবছিস আমি কিছু টের পাই নাই? আমি সবই বুঝেছি। তোদের সাথে আমি আর গান-ফানে নাই। যা, সর।'
দেখুন, যা বলতে চেয়েছিলাম এখনো সেটাই বলা হয় নি। যখন নন-স্টপ সঙ্গীত চলতে থাকে, আমার ছেলে-মেয়ে দুটো প্রায়ই ধমকে ওঠে বলে, 'আব্বু, প্লিজ, এসব গান খুব পঁচা।' শ্যালিকা যেমন সরাসরি না বলে একটু কূটনৈতিক ভাষায় আমাকে ব্যাকডেটেড বলেছে, বাচ্চারা তো আর কূটনীতি বোঝে না, ওরা মুখের ওপর একেবারে ডাইরেক্ট শুনিয়ে দেয় আমার গাওয়া গানগুলো দারুণ অশ্রাব্য। কিন্তু ওদের কথা কে শোনে? আমার অবিরাম গান চলতে থাকে, ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে ওরা ঘরে দরজা দিয়ে বসে থাকে, বা পড়তে যায়, বা বাইরে বেড়াতে যায় (বিকেলে)।
একদিন বিকেলে ঘরে ঢুকতেই স্ত্রী একটা কাগজ আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে, এই দেখো, কবির মেয়ে কবি হয়ে গেছে (আমি গান মুখস্থ রাখতে পারি না, কিন্তু গানের সুরগুলো সারাক্ষণ আমার কানে বাজতে থাকে। গানের চরণ ভুলে গেলে ফিলার হিসাবে নিজের শব্দ বসাই, তাই আমি স্ত্রীর কাছে কবি বটে)। আমি হাতে নিয়ে দেখি পেন্সিলে লেখা তিনটি ছড়া। কোনো বানান ভুল নেই, তবে এলোমেলো করে লেখা। আমি পড়ি আর মনে মনে হাসি, 'সবুজ অঙ্গনে'র কোথাও সে এ রকম ছড়া পড়েছে, কিংবা তার পাঠ্যবইয়ে 'কাজের লোক' ছড়াটি হয়তো সে পড়েছে, ঘরভর্তি এতো লেখালেখি দেখে ওর মনেও কিছু 'ভাব' জেগেছে বোধ হয়। তবে সবগুলো ছড়াই একই ঢংয়ে লেখা। আমি তাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য পরদিন কম্পিউটারে টাইপ করে লেজার প্রিন্টারে প্রিন্ট করে দিলাম। সে মহাখুশি। ওর মা বলে, 'সবুজ অঙ্গনে' ছাপিয়ে দেয়া যায় না? আমি বলি, অবশ্যই সবুজ অঙ্গনে ছাপা হবে। এ শুনে সে আরো অনুপ্রাণিত হয়। তার দেখাদেখি তার জ্যেষ্ঠ সহোদরও কবিতা লিখে ফেলে। দুদিনে দুজনের গোটা পাঁচেক ছড়া আমার কাছে জমা পড়ে।
সবুজ অঙ্গন ৫ম সংখ্যা বের হওয়ার পর হঠাৎ মনে পড়ে সবুজ অঙ্গনে ওদের ছড়া ছাপানো হয় নি, অত্যধিক ব্যস্ততার কারণে ভুলে গিয়েছিলাম। ওদের কিন্তু এতদ্সংক্রান্ত কোন আবেগ কিংবা উৎসাহ নেই, কারণ ওরা সে ছড়া লেখার কথা দুদিন পরই ভুলে গিয়েছিল। রাতদিন কার্টুন ছবি, এইচবিও চ্যানেল, পোকোমন গেইম, টার্মিনেটর, স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান ডুপারম্যান যা কিছু আছে সেগুলোর জন্য ওরা পাগল। কিন্তু আমার খারাপ লেগেছিল। ঐশী ওর প্রিন্ট করা কাগজটি আঁঠা দিয়ে দেয়ালে লাগিয়ে রেখেছে, সেটা এখনো আছে। আমার ইচ্ছে হলো, এবার এটা ছাপাবোই।
ঐশীকে খুব আদর করে কোলে বসিয়ে বললাম, এবার সবুজ অঙ্গনে তোমাদের ছড়া ছেপে দেব। মুহূর্তে ভুলে যাওয়া আবেগ ফিরে পেয়ে সে খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। আমি বলি, 'একটা শর্ত আছে।'
'কী শর্ত?'
'আমার গাওয়া একটা গান তোমাকে আজ শুনতে হবে, মাত্র চার লাইন।'
সে শান্ত হয়ে বসে বলে, 'ঠিক আছে।'
আমি বলি, 'কোন্টা গাইব?' টিভিতে কে যেন গান গাইছিল। সে বলে, আসিফের ঐ গানটা....। আমি বলি, এ গান তো আমি জানি না। জীবনে প্রথম শুনছি। আমি আমার পছন্দের একটা গান গাই? সে অনুমতি দেয়। তাকে আমার কোলে বসিয়ে শক্ত করে ধরে রাখি, যাতে ছুটে না যেতে পারে। তারপর যেইমাত্র শুরু করেছি.... বহুদিনের পীরিত গো....অমনি সে আমার হাত ছাড়িয়ে কোল থেকে এক লাফে নেমে গিয়ে বেডরুমে গিয়ে টিভি দেখতে শুরু করে। আমি ঐশী আর সাইফের ছড়াগুলো টাইপ করতে করতে গাইতে থাকি :
বহুদিনের পীরিত গো বন্ধু,
একই দিনে ভাইঙ্গো না।
তুমি একই দিনে ভাইঙ্গো না গো
একই দিনে ভাইঙ্গো না।
ঐশী দ্বিতীয় এবং সাইফ চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। ওরা অনেক বড় হলে ওদের বাবার গলার গান শুনতে একদিন খুব ইচ্ছে হতে পারে, সেদিন আমি হয়তো না-ও থাকতে পারি, আমার গান গাওয়া-গাওয়ি নিয়ে এবং ওদের ছড়া লেখালেখি নিয়ে এরূপ একটা ফুটনোট লেখা হয়ে গেলো, এটা যদি ওদের মনে পড়ে, ওরা খুব আনন্দ পাবে।
পুনশ্চ
এটা পড়ে আমার স্ত্রী বলে, ঘরের কথা এভাবে লেখা ঠিক না। আর তুমি কিন্তু একটু বাড়িয়েও লিখেছ। আমি বলি, কোন্টুকু বাড়িয়ে লিখেছি? সে বলে, সবটুকুই। বানিয়ে বানিয়ে যেমন গান গাও, এটাও ওরকম গল্প বানিয়েছ।
ভুলে যাওয়া গান : বহু দিনের পীরিত গো বন্ধু
গানের সুরে ও কথায় কিরূপ রূপান্তর ও পরিমার্জন ঘটেছে, নিচের গান দুটি শুনে ও কথাগুলো পড়ে তা বিশ্লেষণ করুন। যাঁরা গান নিয়ে গবেষণা করেন, কথা ও সুরের এ বিবর্তন, রূপান্তর ও পরিমার্জন তাঁদেরকে আকৃষ্ট করবে বলে আমার মনে হয়।
বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভেঙ্গো না
বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভেঙ্গো না
একই দিনে ভেঙ্গো না গো
ও হারে একই দিনে ভেঙ্গো না গো
একই দিনে ভেঙ্গো না
বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু
এই যে রে ভাই বংশীঅলা
বাজাও বাঁশি দুপুরবেলা
আরও একেলা
তোমার বাঁশির সুরে মনও হরে গো
ও তোমার বাঁশির সুরে মনও হরে গো
ঘরে রইতে দিল না
বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু
মাতা মইল পিতা রে মইল
গুণের ভাই ছাড়িয়া রে গেলো
সঙ্গে নিল না
আমি কী দোষ দিব পরের পুতের গো
আরে আমি কী দোষ দিব পরের পুতের গো
আপন কর্ম ভালো না
বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু
বন্ধু আমার আলারে ভোলা
না জানে পিরিতের জ্বালা
আরও একেলা
সে যে আসি বলে গেলো চইলে গো
ও সে যে
সে যে আসি বলে গেলো চইলে গো
আর তো ফিরে আইলো না
বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভেঙ্গো না
গানটি শুনুন আব্দুল আলীমের কণ্ঠে এখান থেকে ডাউনলোড করে
কে এই গানের শিল্পী?
প্রায় অভিন্ন সুরে ও পরিমার্জিত কথায় এ গানটিও শুনুন ডাউনলোড করে। আব্দুল আলীমের কণ্ঠে উপরের গানটি শুনে এতোই অভ্যস্ত ছিলাম যে এ নারীকণ্ঠের গানটি শুনে প্রথমেই ধাক্কা খাই ও চমকে উঠি। কিন্তু বার কয়েক শোনার পর এ গানটাও আমার কাছে এক সময় অনবদ্য মনে হয়; কিন্তু শিল্পীর নাম জানি না। তবে ডলি সায়ন্তনীর হতে পারে বলে ধারণা করছি। কারো জানা থাকলে প্লিজ জানাবেন।
বহুদিনকার পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না
বহুদিনকার পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না
তুমি একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না গো
তুমি একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না গো
তুমি একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না গো
বহুদিনকার পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না
বন্ধু আমার চিকন কালা
বাজায় বাঁশি দুপুরবেলা
বসি একেলা
বন্ধু আমার চিকন কালা
বাজায় বাঁশি দুপুরবেলা
বসি একেলা
আমার বাঁশির সুরে পাগল করে গো
আমার বাঁশির সুরে পাগল করে গো
আমার গৃহেতে মন রহে না গো
বহুদিনকার পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না
মাতা মলো পিতা মলো
গুণের ভাই ছাড়িয়া গেলো
সঙ্গে নিল না
মাতা মলো পিতা মলো
গুণের ভাই ছাড়িয়া গেলো
সঙ্গে নিল না
আমি পরের পুতের কী দোষ দিব গো
আমি পরের পুতের কী দোষ দিব গো
আমার আপন কর্ম ভালা না
বহুদিনকার পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না
বহুদিনকার পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না
তুমি একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না গো
তুমি একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না গো
তুমি একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না গো
বহুদিনকার পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না
বহুদিনকার পিরিত গো বন্ধু
একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না
একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না
একই দিনে ভাঙ্গিয়ো না
ডাউনলোড : আমি নিশ্চিত নই এটা কার কণ্ঠ। তবে ডলি সায়ন্তনীর কণ্ঠের মতোই লাগে
পরিমার্জিত ও পুনর্মুদ্রিত
১। ঐশী আর সাইফের ছড়া
২। ভুলে যাওয়া গান