শামসুর রাহমানের 'কখনো আমার মাকে' কবিতাটি কোনো এক সময়ে সারাক্ষণ গুন গুন করে আওড়াম। প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। মায়ের কথা মনে করে পড়া নয়, এটা এমনিতেই ভাল লাগতো। বিশেষ কোনো কারণও নেই। একেক সময় একেকটা কবিতা খুব বেশি ভালো লাগে। যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম তখন পুরো 'কবর' কবিতা মুখস্থ ছিল। ঘাটেমাঠে, হাঁটবাজারে সর্বত্র এটা আবৃত্তি করে বেড়াতাম। একটা সময় ছিল যখন 'কেউ কথা রাখে নি' কবিতার শেষ স্তবকটি পাগলের মতো আবৃত্তি করতাম - বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল ছুঁয়ে একদিন বরুণা বলেছিল........ ।
আরেকবার একটা হাসন রাজার গান এমন প্রিয় হয়ে উঠেছিল :
মায়ে বাপে কইরা বন্দি খুশিরও মাঝারে
লালে ধলায় হইলাম বন্দি পিঞ্জিরার ভিতরে রে
হাসন রাজায় ডাকবো যখন ময়না আয়রে আয়
এমনও নিষ্ঠুর ময়না আর কি ফিরিয়া চায়ও রে ...
কান্দে হাসন রাজার মন মনিয়ায় রে
খুব টেনে টেনে গাইতাম। গাইতে গাইতে গলা ধরে আসতো।
মা মরে যাবার পর যে কোনো দু:খিনী, ছিন্নবস্ত্র ভিখারিনীকে দেখলেই মনে হতো- এ আমার মা নয় তো? মাকে খুব বেশি স্বপ্নেও দেখি নি। ২০০২ সালের কথা। মা মরে যাবার প্রায় ২২ বছর পর তাঁকে স্বপ্ন দেখি। খুব সাদাসিধে স্বপ্ন মনে হয় আজ, কিন্তু মায়ের কি রুদ্র চেহারা ছিল সেদিনের সেই স্বপ্নে! খুবই অল্প সময়ের স্বপ্ন। দশ সেকেন্ডের বেশি হয়তো নয়। অথচ মনে হচ্ছিল অনেক লম্বা সময় ধরে সে স্বপ্নটা দেখছিলাম। দ্রুত সব ঘটে গেছে।
বর্ষার শেষ সময়। আশ্বিন কার্তিক হবে হয়তো। মাঠের পর মাঠ, সুবিশাল প্রান্তর, আমন ধানে ছেয়ে গেছে সব। মাঝখান দিয়ে এক সরু খাল বয়ে গেছে। মৃদু স্রোত বইছে সেই খালে। কাঁচি হাতে কখনো খালের পাড় ঘেঁষে, কখনো বা ধান ক্ষেতের আল ধরে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক কিশোর। সে আমি।
হঠাৎ দেখি আঁচলে ঘোমটা টেনে আঁকা-বাঁকা আল ধরে এক মহিলা ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ধানের শীষ ছাড়িয়ে বহু উঁচু তার শরীর। লালচে পাড় বেগুনি রঙের শাড়ি তার পরনে। আমি অবাক হই, কে এই নারী এই ভর দুপুরের বিরান মাঠে হাঁটে?
নারীমূর্তিটি সামনে এসে দাঁড়ায়, ঘোমটা খুলে আমার মাথায় হাত রেখে বলে, কেমন আছিস্ বাজান? আমি আরো অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবি, কে এই অচেনা নারী? স্বপ্নের মধ্যেই ধীরে ধীরে মনে পড়লো- সেই কোন্ সুদূর শৈশবে এমনই এক রূপবতী মায়ের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সেই মুখ এতোদিন কোথাও লুকিয়ে ছিল, হঠাৎ আবির্ভূত হলো আজ। কি মজার কাণ্ড, আঁচলের ভিতর থেকে এক থালা পাটি সাপটা পিঠা বের করে এনে সে বললো, নে খা।
আমার খুব অভিমান হলো, মা এতোদিন পরে এলো? আমাকে ফেলে এতোদিন কোথায় ছিল মা? আমার কথা কি একবারও মনে পড়ে নি? কি নিষ্ঠুর মা আমার! হঠাৎ আমার জেদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। একটা পিঠাও মুখে তুললাম না। মার হাত থেকে থালাটি এক ঝটকায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দে ছুট। রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠলো মা। লম্বা লম্বা পা ফেলে আমাকে ধরতে ধেয়ে আসতে থাকলো সে। ভয়ে প্রাণ বাজি রেখে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছি। এই বুঝি হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে ফেলবে। ঐ তো খালের পাড় দেখা যায়, ঐদিকেই ছুটতে লাগলাম। খাল পার হয়ে ওপারে গেলেই নিরাপদ, স্বপ্নের মধ্যে ভাবি।
খাল পর্যন্ত পৌঁছে গেছি। খালে নামলে পানি পার হওয়া কি সম্ভব হবে? আমি কি সাঁতার জানি? স্বপ্নের মধ্যে মনে করতে পারলাম না। গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে এক লাফ দিলাম, খুব জোরে। অবশেষে হাফ ছেড়ে বাঁচি, খাল পার হয়ে গেছি। শুধু স্বপ্নেই এমন লম্বা খাল লাফ দিয়ে পার হওয়া যায়। মা-ও এতোক্ষণে খাল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। খাল পার হবার জন্য এবার সে এক পা খালে ফেললো। এতো গভীর খাল ছাপিয়েও তার বিশালকায় শরীর দেখা যাচ্ছে। সে আর এগুলে না। কোমরে হাত রেখে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। খাল পার হযে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে আমিও ঘুরে দাঁড়িয়েছি। দূর থেকে মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি পলকহীন ভাবে। তার কঠিন মুখ ধীরে ধীরে মিষ্টি হাসির আভায় ছেয়ে গেল। আমি স্বপ্নের মধ্যেই কেঁদে উঠলাম .. মা ... মা ...
মা মরে যাবার পর কিছুতেই মায়ের মুখ মনে করতে পারতাম না। কতো কষ্ট হতো। মায়ের কোনো ছবিও ছিল না।
১৯৮০ সনের ১৬ এপ্রিল বুধবার বিকেল ৩:১৬-তে মা মারা গেছে। আমার দু:খিনী মা কতো স্বপ্ন দেখতো- আমি একদিন অনেক বড় হয়ে তার কোলে সমস্ত রাজ্যের সুখ এনে দেব। মস্ত ঘরের সিঁড়িতে বসে আমার রূপবতী প্রৌঢ়া জননী পান খেয়ে লাল টুকটুকে ঠোঁট আর লাল করে ফেলবে- তার নাতিনাতনি কতো দুষ্টুমি করবে তার সাথে!
আমি আজ কতো বড় হয়েছি, মায়ের কল্পনায় এর এককোণাও আসে নি কোনোদিন। আমার মায়ের নাতিনাতনিরা তার ছেলেমেয়েদের চেয়ে হাজার গুণ শান্তিতে দিন গুজরান করে- এদের আজ সবই আছে, সেই রাঙাদাদীটি নেই- নেই আমার লক্ষ্মী মাও।