বয়স আমার সাত কি আট বছর হবে। যখন তখন মায়ের চুল ছিঁড়ি, বুকে-পিঠে কামড় বসিয়ে দিই, মা তেড়ে আসেন, বাবার কাছে লুকোই, ছোট ভাইবোনদের শরীর খামচে দিই, কিল-ঘুষিতে ওদের নাক ফাটাই। পাখি মারতে গুলি-গুলতি নিয়ে বনে-জঙ্গলে ছুটোছুটি করি, গুলতি চালাতে পারি না, কখনো দিগম্বর, কখনো বা সামান্য নেংটি কিংবা গামছা থাকে পরনে, আনাজ কোটার বটি দিয়ে খেজুরের ডাল কেটে খেলনা হাতি বা ঘোড়া বানাই।
আমাদের বাড়ির দক্ষিণ ধারে যে নিচু জায়গাটা ছিল, সেখানে ছিল একটি ছোট ডুমুর গাছ। সকাল-দুপুর-বিকেল সারাক্ষণটা আমরা বাচ্চারা ডুমুর গাছে চড়ে নাচানাচি, দাপাদাপি করতাম। গাছের ডালপালা ভাঙ্গতাম, আবার গাছ থেকে লাফ দিয়ে পা ভাঙ্গতাম। এমনই হৈচৈ-এ মেতে থাকতাম সারাবেলা।
একদিন দুপুরে। ডুমুর গাছের এক শক্ত ডালে দাঁড়িয়ে কেবলই উপর-নিচ দোল খাচ্ছি। একবার মনের মধ্যে কি জেদ চাপলো, লাফিয়ে ঝাঁকি দিয়ে এ-ডালটাকে আজ ভেঙ্গে ফেলবো। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে, ডালের যতখানি মাথায় গিয়ে দাঁড়ানো সম্ভব ততখানি দূরে গিয়ে আমি ডালটাকে ঝাঁকি দিচ্ছি। আমার ঝাঁকির তালে তালে নিচে দাঁড়ানো বাচ্চারাও আমার সাথে সাথে জোরে বলে যাচ্ছে হেইও - হেইও - । ডাল ভাঙ্গার উৎসব যেন - এমনই উল্লাসে সবাই ফেটে পড়ছিল। হঠাৎ মটমট শব্দে ডাল ভেঙ্গে গেল - গাছের নিচে বাচ্চারা ডাল ভাঙ্গার উল্লাসে সমস্বরে হুররে করে উঠলো। কিন্তু আমি ভারসাম্য হারিয়ে চিৎপটাং হয়ে ঝপঝপ করে মাটিতে পড়ে গেলাম - আর ডালটি পড়লো আমার ঠিক পিঠের ওপর। সবাই অনর্গল চেঁচিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মাটির সাথে বুকে চাপ খেয়ে আমার গেছে দম বন্ধ হয়ে, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু দাঁড়াতে পারছি না, বাচ্চাগুলো ডালের ওপরে উঠে লাফাচ্ছে, আমি ডালের নিচে চাপা পড়ে মরতে যাচ্ছি। আমি চিৎকার দিতে পারছি না, আমার দম ফেটে গেল, দম ফেটে গেল, মা - মা - ।
জীবনমৃত্যুর সেই সন্ধিক্ষণে দেখতে পেলাম কে এক অপরূপা তন্বী তরুণী ভিড় ঠেলে সবগুলো বাচ্চাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ডালের নিচ থেকে আমাকে টেনে তুলে নিল - শংকিত চোখ-মুখ তার, আমার বুক ডলে দিচ্ছে, আমার শ্বাস ফিরিয়ে আনার প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে। অবশেষে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয় - আমি মা-মা বলে জোরে কাঁদতে থাকি - তরুণীর চোখে পানি। আমাকে বুকে জড়িয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে বলে, একদম পাগল পুলা - একদম পাগল পুলা - ভাঙ্গা ডাইলে চইড়া কেউ লাফায়? মইর্যা তো গেছিলিরে বাজান - তোরে আমি আর কোনোদিন দুই নজরে দেখতাম না - বাজানরে - । তারপর পাগলের মত আমার গালে মুখে গলায় চুমু খেতে থাকে। আমি চোখ খুলে প্রথম ভালো করে তাকে লক্ষ্য করে দেখি, এ যেন আকাশের পরী। আমি মনে মনে বললাম, আমার মায়ের চেয়েও রূপবতী এ কোন্ তরুণী? আমি তাকে আগে দেখি নি, অথচ কতই না আদরে সোহাগে মুহূর্তে আমার অন্তর ভরিয়ে দিল? আমাকে সাপটে কোলে করে নিয়ে মায়ের কাছে এসে কেঁদে দিল সে, তোর পুলা আইজ মরতে গেছিল রে বুজি। গাছ থনে ডাইল ভাইঙ্গা পড়ছিল। এই দেখ্ কি অইছে ওর বুকে-পিঠে?
আমার মায়ের বুঝি অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। দিশেহারা মা আমাকে ত্বরিৎ কোলে টেনে নেন। বলেন, কছ কি তুই? এই বিপত্তি কেমনে অইলরে কর্পুরা? আমার হাত-পা-বুক ডলতে ডলতে মা কেঁদে ফেলেন।
আমার কর্পুরা খালা, আমার মা - দেখতে যেন বেহেস্তের হুরপরীদের মত। পথ চলতে চলতে যখনই কোন নারীকে দেখেছি, তরুণীকে দেখেছি, মনের ভিতরে অজান্তে একটা তুলনা জেগে উঠতো, এরা কি আমার মায়ের চেয়েও অধিক রূপবতী? আমার কর্পুরা খালার চেয়েও? আমার মা-খালার চেয়েও অধিক রূপবতী কেউ হতে পারে এ আমার বিশ্বাসই হতো না। যদিও বা দৈবাৎ কোনো নারীকে দেখে মনে হতো যে এরা আমার মা-খালার চেয়েও অধিক রূপবতী, হিংসায় আমার অন্তরটা জ্বলে যেত।
কি যে সুন্দর ছিলেন আমার মা আর আমার খালা, তা কোন উপমাতেই বোঝানো সম্ভব নয়। মার গলা ধরে তাঁর কোলে ঝুলে পড়ে যখন এক ধ্যানে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, মা তাঁর রাঙা ঠোঁটে হাসির রং মাখিয়ে আমার গালে টুসি মেরে জিজ্ঞাসা করতেন, চাইয়া চাইয়া এত কি দেখোছ রে বাজান? আমি আরো শক্ত করে মার গলায় গলা মিশিয়ে বলতাম, মা, তুই কত্তো সুন্দর! তুই এত সুন্দর অইলি কেমনে রে মা? আমার মা আমার দু-গালে আবারো টুসি দিয়ে চুমু খেয়ে বলতেন, আল্লার দান রে বাজান। তুই কি এইসব বুজবি?
আমার কর্পুরা খালা যখন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতো, তখন আমি খুব, মায়ের কাছে যেমন, তার চেয়েও বেশি ডানপিটে হয়ে যেতাম। তখন আমি একদিনও নিজ হাতে ভাত খেতাম না। খালার কোলে শুয়ে শুয়ে আমি তার কান টানতাম, চুল টানতাম, নাকে খামচি দিতাম, খালা আমার মুখে ভাত তুলে দিত। মাঝে মধ্যে আবার ফোহ্ করে মুখের একদলা ভাত খালার মুখে ছিটিয়ে দিতাম। খালা কৃত্রিম বিরক্ত হয়ে উঠে যেতে উদ্যত হলেই বিষম জোরে পিঠে কামড় বসিয়ে দিতাম। খালা কেঁদে-কুটে অস্থির হতো মাঝে মাঝে। মাকে বলতো, তোর পুলাডা কি যে বদমাইশ অইছে!
খালার কথায় আমার কেবলই হাসি পেত, খিলখিল করে কেবলই হাসতাম। খালা ঘর থেকে বেরুলেই ঝাঁপ দিয়ে তার কোলে উঠতাম। খালা পারতো না, তারপরও আমাকে কোলে করে কত ঘুরতো!
এভাবে বহুদিন আমার পৃথিবী ছিল আমার মা আর খালার পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে অন্য কোন আপন নারী ছিল না।