চরের মেয়ে-১
চরের মেয়ে-১
চরের মেয়ে-২
চরের মেয়ে-৩
চরের মেয়ে-৪
চরের মেয়ে-৫
শাহজাহানের ওখানে একদিনও যাওয়া হয়নি। ও অবশ্য প্রতিদিনই যেতে বলে। শাহজাহানের অনেক আকুতি মিনতির পর পরীক্ষার মাঝখানে এক ছুটির দিনে ওর ওখানে গেলাম। তখন নিঝুম ঝাঁঝালো দুপুর।
এবার যারা দূর থেকে পরীক্ষা দিতে এসেছে তাদের মধ্যে সবচাইতে উপভোগ্য এবং ভালো বাসাটি পেয়েছে শাহজাহান। এবং ইতিহাস ঘাটলে এটা একটা মজার রেকর্ডও হয়তো হয়ে থাকতে পারে। রেকর্ডটা হলো, অত্র অঞ্চলের কোন ছেলে নিজের শ্বশুর বাড়িতে থেকে এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে, এমন চমকপ্রদ ঘটনার কথা আমরা কেউ শুনিনি।
বুঝতেই পারছেন যে শাহজাহান ওর শ্বশুর বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে। আপনাদের নিশ্চয়ই খটকা লাগছে, এস.এস.সি পরীক্ষার্থী একটা ছেলের আবার শ্বশুর বাড়ি হয় কি করে? তাহলে আর বলছি কি, এটাই তো মজার ঘটনা।
খুব বেশি দিন হয়নি শাহজাহান বিয়ে করেছে, বড় জোর এক বছর। এ বয়সের বিয়ে সচরাচর যেভাবে হয়, প্রেম করে বিয়ে - আপন মামাত বোনের সাথে আকৈশোর বিরতিহীনভাবে প্রেম। গত বছর যখন শাহজাহানের নানী মৃত্যুশয্যায় পড়লেন, তখন তিনি হঠাৎ করেই খায়েশ করলেন, মৃত্যুর আগেই তাঁর একমাত্র ছেলের ঘরের নাতনি জয়নবের সাথে মেয়ের ঘরের নাতি শাহজাহানের বিয়ে বন্ধন দেখে যেতে চান। এখানেই ইচ্ছের শেষ নয়, ওদের কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চাও দেখে যেতে চান তিনি। যেই সাধ সেই কাজ, কিন্তু ওদের বাচ্চা-কাচ্চা হতে পারেনি, বৃদ্ধাও আর বেশিদিন বেঁচে থাকেননি।
কিন্তু আমি ভাবতাম, এস.এস.সি পরীক্ষার ঠিক এক বছর আগে বিয়ে করে বইয়ের পড়া কি এক রত্তি পড়তে পেরেছে শাহজাহান? আমি হলে তো পারতাম না।
ছাত্র হিসাবে শাহজাহান খুব তুখোড় না হলেও কম মেধাবী নয়। শেরখান, কবির, ইমরান, জাহিদ, প্রমীলা - ওদের পরের সারিতেই সে পড়ে। ওর বুদ্ধি এবং সমৃতি শক্তি খুব প্রখর। একবার তো শাহজাহান আমার কলজের পানি শুকিয়েই দিয়েছিল।
সেটি ষষ্ঠ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা ছিল। প্রাইমারী স্কুল থেকে এসে ভর্তি হয়েছি বিধায় পরস্পরের মেধা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা ছিল না। তবে সাময়িক পরীক্ষায় আমার অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় সবাই পেয়েছিল। সেজন্য সবাই ভাবতো প্রথম স্থান অধিকারের জন্য একটি নামই নির্ধারিত - নাহিদুল ইসলাম। তবে দ্বিতীয় স্থানের জন্য সবাই শেরখানকেই বেশি আশা করছিল। এরপর ইমরান, জাহিদ কিংবা কবিরের নাম উচ্চারিত হতো।
চূড়ান্ত ফলাফলে শাহজাহান সবাইকে চমকে দিল - ওর রোল নম্বর হলো দুই। ঘটনা এখানে নয়। তার আগে প্রাইমারী স্কুলের সকল পরীক্ষায় আমি ছিলাম অপ্রতিদ্বন্দ্বী, দ্বিতীয় স্থানধারীর থেকে প্রতি বিষয়ে কম করে হলেও গড়ে ১৫টি নম্বর বেশি পেতাম। কিন্তু শাহজাহানের মার্কশীট হাতে নিয়ে দেখি ও আমার চেয়ে সব মিলিয়ে মাত্র ১৭টি নম্বর কম পেয়েছে। আমি সেবার চমকে উঠেছিলাম, অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি!
অবশ্য এর পরের বার এবং আর কখনোই শাহজাহান অমন চমক দেখাতে পারেনি। তবে এস.এস.সি-র টেষ্ট পরীক্ষায় সে কিছুটা ভালো করতে পেরেছে বলে শিক্ষকগণ আশা করছেন যে হয়তো বা, হ্যাঁ হয়তো বা শাহজাহানও একটা ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে বসতে পারে।
কিন্তু শাহজাহানের হাতের লেখা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারি না। ওর লেখা একটি অক্ষরও আমি বুঝি না এবং পড়তে পারি না। কাক আর বকের ঠ্যাঙের মত তা কেবলই পেঁচানো। লিখে সে বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনী দিয়ে। ওর শাহাদাৎ আঙ্গুলটা ছোটবেলায় কেটে গিয়েছিল, লেখার সময় জ্ঞবিকলাঙ্গঞ্চ আঙ্গুলটা বন্দুকের নলের মত খাড়া আর সোজা হয়ে থাকে, কোন কাজে লাগে না। আমি ভেবেই পাই না স্যারেরা ওর অমন বিদ্ঘুটে লেখা বোঝেন কেমন করে। আরো আশ্চর্য - অমন হাতের লেখা দিয়ে বিগত দশটি ক্লাস ও কিভাবে পার হয়ে এল? আমি যদি ওর পরীক্ষার খাতা কাটতাম তাহলে আমি নিশ্চিত শাহজাহান কোন সাবজেক্টেই পাশ করতে পারতো না। যার হাতের লেখা বুঝি না তাকে কি নম্বর দেয়া যায়? ওর এস.এস.সি পাশ করা নিয়ে অবশ্য আমি বেশ দুশ্চিন্তায় আছি।
তবে রূপবান বলতে যা বোঝায় শাহজাহান সত্যিকার অর্থেই তাই। আমি দেখেছি ক্লাসের মেয়েরা জ্ঞকত আমোদেঞ্চ শাহজাহানের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টার কথা বলেছে। শাহজাহানও পারে বটে! মেয়েরা যে কতখানি শক্তিধর চুম্বক তা শাহজাহানকে দেখলে বোঝা যায়। যেখানে মেয়েরা আছে, এটা অবধারিত যে শাহজাহানকে অন্য কোথাও নয়, ঠিক মেয়েদের মাঝখানটাতেই পাওয়া যাবে। মেয়েদের সামনে ওর মুখে কথার ফুলঝুঁড়ি ফোটে। শাহজাহান অবিরল হাস্যকৌতুক করে যায়, মেয়েরা আমোদে গলে পড়ে, হেসে কুটি কুটি হয়। ও পারে বটে! কিভাবে পারে? আমি পারি না।
বিয়ের পর শাহজাহান যেদিন প্রথম ক্লাসে এল, আমার মনে পড়ে, শাহজাহানের সাথে কথা বলার জন্য ছেলেরা কোন সুযোগই পেল না, কিন্তু মেয়েগুলো ওকে ঘিরে ধরে হাজার রকমের প্রশ্ন করতে শুরু করলো, যার মর্মার্থ কিছুটা আমি বুঝি, বাকিটা মাথায়ই ঢোকে না। সদ্য বাসর-ঘর উত্তীর্ণ শাহজাহান অত্যন্ত বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ বিবাহিত পুরুষের মতই রসিয়ে রসিয়ে মেয়েদের সব প্রশ্নের জবাব দিল। সায়ন্তনী বললো, তোর বউ কি আমার চাইতেও বেশি সুন্দরী? শাহজাহান বলেছিল, তুই আবার একটা সুন্দরী নাকি? আমার বউয়ের মত অমন সুন্দরী এই দশ গ্রামে খুঁজে পাবি না। সায়ন্তনী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কৌতুক করে বলেছিল, তাহলে তো আমাদের কপাল পুড়লো। সুন্দরী বউ পেয়েছিস, আমাদের দিকে কি আর ফিরে তাকাবি?
সেদিন টিফিন পিরিয়ডে আমতলায় আমরা ছেলেরা শাহজাহানকে ঘিরে ধরলাম। ওর গলায় একটা সোনার চেইন ঝুলছিল। শার্টের ওপরের বোতামটা খোলা থাকায় প্রশস্ত লোমশ বুকের ওপর সোনার চেইনটাতে সত্যিই ওকে দারুণ লাগছিল।
বাসর রাতের অভিজ্ঞতা শুনে শুনে করিমের সেদিন শাহজাহানের মত অমন একটা বাল্য-বিয়ে করে ফেলার খুব সাধ হয়েছিল।
জয়পাড়া হাইস্কুল থেকে মাত্র দুশো গজ দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বড় খেলার মাঠ আছে। সেই মাঠের পশ্চিম পাশ থেকে খালের ধার ঘেঁষে আরো দুশো গজের মত হাঁটতে হয়। তারপরই শাহজাহানের নানার বাড়ি; সাবেক মামা এবং বর্তমান শ্বশুর বাড়িটি। জয়পাড়ার কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র পাঁচ শত গজ দূরের এলাকা, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে এখানে প্রমত্তা পদ্মার ভয়াবহতা ছিল। সেখানে চর পড়ে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে উঠেছে। শুকনো ও মৃতপ্রায় পদ্মা এখন এখান থেকে পাঁচ-ছয় মাইল পশ্চিমে।
জয়পাড়া শহর না হলেও এখানকার সবার গায়ে শহুরে হাওয়া লেগেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এখানকার সভ্যতা শহুরে সভ্যতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জয়পাড়ার কেন্দ্রস্থল থেকে শাহজাহানের শ্বশুর বাড়িটি এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও সেখানে এখনো সভ্যতার আলো-বাতাস তেমন একটা পৌঁছেছে বলে শুনিনি।
শাহজাহানের শ্বশুর বাড়িতে মস্ত বড় দুটি জোড়ন দেয়া চৌচালা টিনের ঘর, একটি বাড়ির পূবের ভিটায় উত্তর-দক্ষিণে লম্বা, এর সাথে ইংরেজি 'এল' অক্ষরের মত সংযোগ দিয়ে আরেকটি ঘর উত্তরের ভিটায় পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। দুটি ঘরেরই বাইরের দিকে লম্বা বারান্দা, বেড়া ঘেঁষে কয়েকটি হাতলওয়ালা বেঞ্চি পাতা। বাড়ির পূব ও দক্ষিণ দিকটাতে কয়েকটা ঝাড়ওয়ালা বড় গাছপালা থাকলেও অন্যান্য দিকে কেবল কলাগাছ আর কলাগাছ।
বাড়ির কাছাকাছি হতেই দেখতে পেলাম পূবের বারান্দায় দরজার কাছাকাছি একটি বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে বসে একমনে বই পড়ছেন ভাবী, শাহজাহানের বউ। পরনে তার চওড়া-পেড়ে মেরুণ রঙের শাড়ি, উত্তর দিকে মুখ করে, বাম হাতটা বেঞ্চির হাতলে ঠেকিয়ে ডান পা-টা মাটিতে ঠুকছেন, বাম পা-টা সামান্য ভেঙ্গে বেঞ্চিতে উঠিয়ে, ঘাড় কাত হয়ে ডান দিকে ঝুঁকে পড়েছে, খোলা চুলের একগাছি হেলে পড়েছে বলে মুখটি ঠিক দেখা যায় না।
ভিতরে কেউ নেই বোধ হয়, থাকলে গরমের এই বাতাসহীন দুপুরেও ঘরের সব কটা দরজা-জানালা কেউ আটকে রাখে? ভাবলাম, এঁরা হয়তো খুব পর্দানশীল পরিবার, তাই বাইরে থেকে অন্দর বাড়ির কোন কিছু দেখার সুযোগ এঁরা রাখেননি। আবার মনে হলো, হয়তো এই ঘরের ভিতরে এক কোণায় বসে এখন চুপচাপ পড়াশোনা করছে শাহজাহান, একান্ত নিরিবিলিতে। এই যে পাশাপাশি বসে থাকা - দুটি তরুণ-তরুণী - একজন ঘরের ভিতরে, আরেকজন বাইরে, কোন কথা নেই, চোখাচোখি নেই, চোখের ইশারা নেই, যে যার মত আপন মনে বই পড়ে যাচ্ছে, আমার কাছে মনে হলো এর চেয়ে রোমান্টিক কোন ঘটনা আর হয় না। দুজনে দুজনের কত কাছাকাছি, আবার একটি দেয়াল এদেরকে পরস্পরের থেকে কত যোজন দূরে সরিয়ে রেখেছে, কিন্তু দুজনেরই বুক ভরে আছে, দুজনেই জানে তারা আছে একান্ত কাছাকাছি। শাহজাহানের সংযম দেখে আমি যারপরনাই আশ্চর্য হলাম। এই নির্জন দুপুরে শূন্য ঘরে ও কিভাবে একা একা চুপচাপ বই পড়ে যাচ্ছে? বউয়ের চেয়ে কি বই এতখানি বড়? ও কিভাবে এসব পারে? আমি হলে তো পারতাম না। আফসোস!
আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ভাবী আমার দিকে তাকালেন। বেঞ্চি থেকে বাঁকা পা-টি নামিয়ে সোজা হয়ে বসলেন।
স্কুলের বহু ফাংশানে, কখনো বা রেডিওতে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত আমি অনেক শুনেছিঃ
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি।
কালো? সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।
আমি এতদিন এ গানটির গূঢ়ার্থ অনুধাবন করিনি। আমার মনে হলো, রবীন্দ্রনাথ যখন এ গানটি লিখছিলেন, তখন এই তরুণী মেয়েটি, যার গায়ের রঙ অতি কৃষ্ণ, কিন্তু রূপের ছটায় সারা ভুবন আলোকিত - এই মেয়েটি রবীন্দ্রনাথের ঠিক সামনে উপবিষ্ট ছিল।
আমি আড়ষ্ট মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, শাহজাহান আছে?
আমার প্রতি কোনরূপ মনোযোগ না দিয়ে ভাবী বললেন, ও-তো এখন পড়ছে।
মনে মনে রেগে গেলাম। বেজায় বেরসিক মহিলা তো! পড়ছে বলে কি বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা যাবে না? আর আমি তো একেবারে নিজে থেকেই আসিনি। গতকাল শাহজাহানই বলেছিল যেন আজ দুপুরে আসি। এ কৃষ্ণ মহিলার এত দেমাগ কেন?
আমি ভাবলাম, এভাবে ফেরত চলে গেলে অপমানটা গাঢ়তর হয়। এক মিনিটের জন্য হলেও আমি শাহজাহানের সঙ্গে দেখা করে যাবই যাব। যাবার বেলায় শাহজাহানকে যেমন কিছু কটূ বাক্য উপহার দিব, আমার আসার কথা সে তার বউকে জানায়নি বলে, আর ওর বউকেও কিছু টক-ঝাল কথা বলে যাব বইকি - স্বামীর বন্ধুদের সাথে তাঁর ব্যবহারটা ভদ্রজনোচিত হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়।
বললাম, আমার নাম নাহিদ, আমি ওর ক্লাসমেট। খুব ঘনিষ্ট -----
আপনি কি এবার পরীক্ষা দিচ্ছেন?
জ্বি ভাবী।
ভাবীর মুখ কঠিন হয়ে গেল। বললেন, আমাকে ভাবী ডাকছেন কেন? আমাকে ভাবী ডাকবেন না, ভীষণ লজ্জা করে।
দুঃখিত।
কোন্ স্কুলে পড়েন?
মালিকান্দা হাইস্কুলে।
গ্রূপ?
সায়েন্স।
পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?
ভালো।
ও-রকম সবাই বলে পরীক্ষা ভালো হচ্ছে। রেজাল্ট বের হলে দেখা যায় গোল্লা পেয়েছে।
শাহজাহান কি বাড়িতে আছে?
ও দুপুরে কারো সাথে দেখা করে না। ওর ডিস্টার্ব হয়। সবাই তো আর ওর মত ব্রিলিয়ান্ট না। ফাজিল-ফুজিল ছেলে-পেলেরা যখন তখন এসে ওকে ডিস্টার্ব করে। পড়ায় ওর দারুণ ক্ষতি হয়।
আমি আহত হলাম। বললাম, আমার কথা শুনলে কিন্তু ও নিশ্চয়ই চলে আসবে।
ভাবী আরো কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কোন জরুরী খবর আছে? থাকলে আমার কাছে বলতে পারেন, আমি ওকে বলে দিব।
ঠিক আছে তাহলে, যাই।
আমি ঘুরে যেতে উদ্যত হই। ভাবী ডাকলেন, শুনুন।
জ্বি। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে জবাব দিই। মনে মনে ভাবি, হয়তো ভাবী একটু প্রসন্ন হয়েছেন, এখনই শাহজাহানকে ডেকে দিবেন।
কিন্তু ভাবীর দিকে তাকিয়ে দেখি তাঁর চোখ-মুখ আগের চেয়ে আরো অনেক কঠিন। বললেন, আপনি আসার সময়ে একটা অভদ্রতা করেছেন, যাওয়ার সময়ে আরেকটা।
আমি দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। মনে মনে আমার অভদ্র আচরণ দুটো খুঁজতে থাকি।
ভাবী বললেন, আপনি প্রথম দেখায় সালাম দেননি। এখন যাওয়ার সময়েও না।
দুঃখিত ভাবী, স্লামালাইকুম। লজ্জিতভাবে যাওয়ার জন্য ঘুরে পা বাড়াতেই ভাবী আবার ডাকলেন, শুনুন।
আমি ঘুরে দাঁড়াই।
এখানে এসে বসুন। বলে ভাবী তাঁর পাশের বেঞ্চিটা দেখিয়ে দেন।
আমি জড়োসড়ো হয়ে বসতে বসতে ভাবি, এ মহিলাকে যতখানি রোমান্ঢি~ক ভেবেছিলাম, বাস্তবে তিনি তার সম্পূর্ণ উল্টো।
ভাবী বললেন, আপনি আমাকে যতখানি কঠিন মনে করেছেন আসলে আমি ততখানি কঠিন নই। আমি দুটি কারণে আপনার ওপরে রেগে গেছি বলে আপনার সাথে এতখানি রূঢ় আচরণ করলাম। প্রথমত, প্রথম দেখায় আপনি আমাকে সালাম দেননি। তখনই আমি মনে মনে চটে গেছি। দ্বিতীয়ত, শাহজাহান আপনার ঘনিষ্ট বন্ধু, অথচ আজ অব্দি ঘনিষ্ট বন্ধুটির বউকে দেখেননি, এটা খুবই লজ্জার কথা। আর আপনি কিভাবে বুঝলেন যে আমিই শাহজাহানের বউ? আসলে আমি ওর বউ নই, বউয়ের মা। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আপনি কত বড় ভুলটা করেছেন। আপনার কি চোখ নেই?
আমি লজ্জায় মিইয়ে গেলাম। মাটির সাথে মিশে যাবার সাধ হলো। লজ্জায় সংকুচিত চোখ দুটো কোন মতে ওপরে তুলে বললাম, দুঃখিত খালাম্মা, আমি অত্যন্ত লজ্জিত। বলে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম।
বসুন। খালাম্মা বললেন।
আমি বসলাম।
শুধু শুধু আপনাকে দোষ দিয়েই লাভ কি? অনেকেই এই ভুলটা করে, আমাকে আমার মেয়ে মনে করে কেউ আপা, ভাবী ডাকে; আবার আমার মেয়েকেও কেউ খালাম্মা বলে ফেলে।
খালাম্মার মুখের গাম্ভীর্য্য ধীরে ধীরে সরে গিয়ে তাতে সামান্য হাস্যচ্ছটা জেগে উঠলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সহজ হওয়ার দিকে এগোতে থাকলো।
আমিও সংকোচ কাটিয়ে উঠতে থাকলাম। খালাম্মা হেসে বললেন, আমি আর আমার মেয়ে মাত্র তের বছরের বড়-ছোট। এগার বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। বার বছর বয়সে আমার প্রথম বাচ্চাটির গর্ভপাত না হলে আমার আরো একটা বাচ্চা থাকতো যার সাথে আমার বয়সের ব্যবধান থাকতো মাত্র বার বছর। খুব মজার হতো, তাই না? বলেই খালাম্মা খিলখিল করে হেসে উঠলেন।
খালাম্মা বলতে থাকলেন, যখন আমি এস.এস.সি পরীক্ষা দেই তখন জয়নবের বয়স দেড় বছর। আপনি জানেন, হলের এক কোণায় হায়াৎ আলী স্যার ঘের টেনে আমার জন্য একটা গ্রীন রুম করে দিয়েছিলেন। আমি আধ ঘন্টা পরপর ওখানে গিয়ে জয়নবকে দুধ খাইয়ে আসতাম। আরো আশ্চর্য ঘটনা কি জানেন, হায়াৎ আলী স্যার জয়নবকে কোলে করে হলময় ঘুরে বেড়াতেন। একবার একটা খুব মজার ঘটনা ঘটলো, জয়নব হেগে-মুতে দিল; হায়াৎ আলী স্যারের জামা কাপড়ের অবস্থাটা কি যে করে ফেললো, আল্লাহ্, আমি বলতেই পারছি না। হাসতে হাসতে খালাম্মা গলে পড়লেন। হাসি থামলে বললেন, কিন্তু জানেন, স্যার একটুও ঘৃণা করলেন না, হাসতে হাসতে বললেন, শিশু বাচ্চা হলো ভেস্তের ফুল। ওদের কোন কিছুতে ঘৃণা করলে আল্লাহ্ বেজার হোন।
খালাম্মা প্রশ্ন করলেন, বলুন তো সেবার আমি পাশ করলাম, নাকি ফেল মারলাম?
এমন আজব ধরণের প্রশ্নের কি কোন উত্তর দেয়া যায়? যদি জানতে চাওয়া হতো যে কোন্ ডিভিশনে পাশ করেছিলেন, তাহলে হয়তো আন্দাজ করে বলা যেত, এই কঠিন সমস্যা-সংকুল পরীক্ষায় 'পাশ'-এর অধিক কোন ডিভিশন পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি পাশ, নাকি ফেল করেছিলেন, যেখানে মাত্র দুটি প্রশ্নের মধ্যে যে কোন একটি উত্তর সঠিক, তারপরও মনে হলো সঠিক উত্তরটা ঠিক ততখানি সহজ না, যতখানি সহজ মনে হয়। কারণ পরীক্ষার্থীর মেধা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকলেও ফেল করার কথাটি উচ্চারণ করতে যে কোন বিবেকবান মানুষের বিবেকে বাঁধবে, এমনকি উত্তরটি সঠিক হলেও। পাশ করার কথাটা অবশ্য অবলীলায় বলে ফেলা যায়, উত্তরদাতা তাতে বিব্রতবোধ করবে না। তবে এক্ষেত্রে পরীক্ষার্থী যদি সত্যি সত্যিই অকৃতকার্য হয়ে থাকে তাহলে তো দুজনেরই বিব্রত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আমি বরং বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় দিয়ে বললাম, আপনি পাশ করেছিলেন।
উত্তর শুনে খালাম্মা খুব খুশি হয়ে বললেন, বলতে পারবেন কোন্ ডিভিশন পেয়েছিলাম?
ঝটপট জবাব দিলাম, ফার্স্ট ডিভিশন।
ঠিক ধরেছেন। তবে দুঃখের বিষয়টা কি জানেন? মাত্র চারটি নম্বরের জন্য আমি স্টার মাক্র্সটা মিস করেছিলাম।
আমি অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকাই, এ তো যেনতেন মহিলা নন, দারুণ মেধাবী এক নারী, যার ভিতরে দাউ দাউ আগুন, অথচ ছাইয়ের নিচে তা ঢাকা পড়ে আছে।
আপনি এবার বলুন তো দেখি জয়পাড়া কলেজ থেকে এ যাবত কালে কয়টি মেয়ে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে?
আমি বললাম, মাত্র একটি, এবং সেটা আপনি।
খালাম্মা যারপরনাই চমৎকৃত হয়ে বললেন, আপনি তো দেখি সবই জানেন। কার কাছ থেকে শুনেছেন এসব?
আমি মনে মনে বললাম, এ মহিলা কি ধাঁধায়ই না আমাকে ফেলে দিয়েছিলেন। প্রথমে তো আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে এ মহিলা আমার চেয়েও মেধাবিনী এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী। এসব প্রশ্ন যিনি করতে পারেন, যার উত্তর প্রশ্ন করার কৌশলের ভিতরেই লুকানো থাকে, কোন মতেই তাঁর বুদ্ধি আমার চেয়ে অধিক হতে পারে না।
আমি উত্তর দিলাম, আমি এ এলাকার ছেলে না? এলাকার স্কুল-কলেজের খবরাখবর তো আমার নখ-দর্পনে।
খালাম্মা হাসতে হাসতে বললেন, আপনি সত্যি খুব বুদ্ধিমান। তবে এ এলাকার ছেলে হলেও স্কুল-কলেজের খবরাখবর রাখার ব্যাপারে আপনার ততটা বড়াই করা ঠিক না।
কেন?
আপনি আসলে স্কুল-কলেজের কোন খবরই রাখেন না।
এটা ঠিক বলছেন না কিন্তু। কোন্ খবরটা ঠিক বলিনি বলুন তো?
খালাম্মা হেসে দিয়ে বললেন, আপনি একটা খাসা চাপা মেরেছেন। আমি তো নই-ই, অন্য কোন মেয়েও আজ পর্যন্ত এ কলেজ থেকে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে বলে কোন রেকর্ড নেই।
আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। খালাম্মা হেসে হেসেই বললেন, কি, আমার কথায় আবার রাগ করেননি তো?
আমি বললাম, এইচ.এস.সি-তে কোন্ ডিভিশন পেয়েছিলেন?
খালাম্মা কলকলিয়ে হেসে উঠে বললেন, ডিভিশনের কথা বলছেন? আমি তো প্রথম বার পাশই করতে পারিনি।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, এস.এস.সি-তে এত ভালো রেজাল্ট করেও এইচ.এস.সি-তে ফেল করলেন? এটা কি করে সম্ভব?
খালাম্মা বললেন, সেটা-ই তো ভাবি। আরো আশ্চর্য কি জানেন? তার পরের বছরও আমি গোল্লা মারলাম। সবাই ভাবলো বিয়ে হওয়ার কারণেই আমার মেধার এমন অধঃপতন ঘটেছিল। আমার হাজব্যান্ড কি যে মন খারাপ করলো। আমিও মনে খুব কষ্ট পেলাম। একবার ভাবলাম, ধূর ছাই, মেয়ে-মানুষ হয়ে এই গণ্ডগ্রাম থেকে এস.এস.সি পাশ করেছি, সেটাই তো কত। দু-দুবার এইচ.এস.সি-তে ফেল করে তৃতীয়বার পরীক্ষা দেয়ার আর দরকারটাই বা কি? আমি তো আর জর্জ-ব্যারিস্টার বা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে যাচ্ছি না।
আমি বললাম, জর্জ-ব্যারিস্টার হওয়ার মত সব যোগ্যতাই কিন্তু আপনার আছে। আমার তো মনে হয় যে আপনার ভিতরে কেবল হাই-এ্যাম্বিশনটাই ছিল না।
খালাম্মা মুখ টিপে হেসে বললেন, আপনি কিভাবে বুঝলেন জর্জ-ব্যারিস্টার হওয়ার মত আমার সব যোগ্যতাই আছে?
আমি স্মিত হেসে বললাম, আপনি দারুণ বুদ্ধিমতী।
খালাম্মা লাজুক হেসে বললেন, বুদ্ধিমতী না, কচু। আপনি শুধু শুধু চাপা মারছেন।
আমি বললাম, একদম না। আপনি বলুন, আপনার মত কটা মেয়ে এস.এস.সি-তে ফার্র্স্ট ডিভিশন পায়? আর আপনি তো শুধু ফার্স্ট ডিভিশন নয়, মাত্র চারটি নম্বরের জন্য স্টার মাক্র্সটা মিস করেছিলেন। আপনার মত এমন ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে খুব কম হয়, বিশেষ করে এমন একটা গণ্ডগ্রামে।
অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০০৪
পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
পর্ব-৯
পর্ব-১০
পর্ব-১১
পর্ব-১২
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৫