কর্মকর্তা যদিও, মাস শেষে বেতন জোটে নেহায়েত সাদামাটা
যদিও বেতন স্বল্প, বিশাল পৈতৃক সংসার বিস্তৃত ডালপালায়
এবং বলে রাখি, আমিই কর্ণধার
এবং
ছোট দুটি ছেলেমেয়ে, স্ত্রী আর নিজে.....এই মিলে শহরের এককোণে আপন সংসার
অফিসের ছুটি শেষে ঘরে ফিরি, অমনি
ওরা হাওয়ার বেগে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোলে
ত্বরিত হাঁতড়ে পকেট কিংবা কোমর
বের করে একটি-দুটি চকোলেট অথবা চুইংগাম।
কোথাও বেড়াতে যাই.....চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, শিশুপার্ক,
ওয়ান্ডারল্যান্ড, আশুলিয়া
ওদের সবুজ উত্সুক চোখ সারাক্ষণ খোঁজে রংবেরঙের চকোলেটবক্স,
মচমচে চিপস, শিশুতোষ যতোসব লোভনীয় খাবার।
আইসক্রিমঅলা কিংবা ফেরিঅলা দেখলেই
অতি ব্যস্তভাবে, 'আইসক্রিম চাই....চুইংগাম আমার চাই।'
ওদের সঙ্গে করে কখনও মার্কেটে যাই, শখের সামগ্রী কিনি
পোশাকআশাক, কসমেটিকস; একটি দুটি দোকান ঘুরতে
না ঘুরতেই ওদের
আর্জিআবদারে কান ঝালাপালা.....এটা চাই, ওটা চাই,
একবার দুবার, বহুবার চাই, বড়দের মতো
আরও চাই স্যুট টাই শাড়ি।
মাছতরকারির কাঁচাবাজারে, চালডাল-রসুনপেঁয়াজ, নিত্যপ্রয়োজনীয়
সওদা কিনতে ব্যাগ হাতে ঘর থেকে বেরুতে উদ্যত হতেই
তড়িঘড়ি তৈরি ওরা সামনে দাঁড়ায়.....'আমরাও সঙ্গে যাবো।'
যতোই বলি না আমি.....এ গরমে
মাছহাটায় যায় না হাঁটা, একদম সিদ্ধ হয়ে যাবে
দারুণ দুর্গন্ধে বমি হবে
বড্ড আপসহীন ওরা, শক্ত করে হাত চেপে
বলে, 'যাবোই বাজারে, যাবোই।'
অতএব আমরা বাজারে চলি, এটাসেটা সওদা কিনি,
এক হাতে থলে
অন্যহাতে মেয়ে, সতর্ক চোখে চেয়ে দেখি অনুজার ফ্রক ধরে
পেছনে ছেলে হাঁটে।
এখানেও স্বস্তি নেই, একভাগা মাছ কিনতেই ওদের
সনাতন হাঁক.....পুতুল চাই, মেয়ে বলে, লম্বা সাদা চুলঅলা পুতুল,
ছেলের জন্য স্পাইডারম্যান, রোবোকপ চাই-ই চাই।
কী যে ছাই বাজার করি! ঘরে ফিরলে অনলবর্ষী তিরস্কারে গৃহিণীর
মুখে ফোটে খই.....'আনাজ আনো নি? রসুন কই?
গোলআলু? তেজপাতা? তেল? কিছুই আনো নি?
কেন বাজারে যাও ওদের নিয়ে?
সবগুলো টাকা নষ্ট করেছো
কীসব হাবিজাবি কিনে। এসবে কি সংসার চলে?
এই আমি দিচ্ছি বলে, খবরদার, ওদের বাজারে নিবে না কক্ষণো আর।'
নিছক 'হাবিজাবি' কিনে উড়িয়ে দিলাম এতোগুলো টাকা!
আমারও খারাপ হয় মন। অথচ দেখি ভাইবোনে মিলে
মহোল্লাসে উঠেছে মেতে সদ্যকেনা খেলনায়, ওরা চকোলেট খায়,
চুইংগাম খায়
আমাদের হাবিজাবি কী অপরিহার্য সম্পদ ওদের!
কখনও কখনও একাই বাজারে যাওয়া হয়, অথবা অন্য কোনও কাজে
পাঁচতলার সিঁড়ি বেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজায় বেল টিপতেই
দৌড়ে এসে কবাট খোলে ওরা। বাজারের থলেটি
মেঝেতে রাখার ঢের আগে
ঝুঁকে পড়ে
তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে ওদের আরাধ্য ধন
একটি দুটি চকোলেট
চুইংগাম।
কিছুই পাই না ভেবে.....কী এমন অমৃতময়
এসব চকোলেট কিংবা চুইংগাম!
একদিন চাল নেই ঘরে, মাছমাংস তাও, বাজারের বেলা পড়ে যায়
এমনি সংকটে গৃহিণীর তাড়ায় বেরুবার কালে
ঘরে আমার বৃদ্ধ বাবা এগিয়ে এসে বলেন, 'আমিও আসি?'
অতিশয় বিরক্তিভরে
তাকাই তাঁর দিকে ফিরে, অমনি চোখ পড়ে বাবার চোখে.....
জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখে কী যেন নিদারূণ নেশা তাঁর
অকস্মাত দেখি এক পিতৃউন্মাদ কিশোর :
........সেই কবে, কতোদিন আগে, বাবার কোলে চড়ে, কাঁধে চড়ে, হাত ধরে
........গুটিগুটি পায়ে দৌড়ে চলতো বালক মেঘুলা কিংবা দেবীনগরের হাটে
........পালদের রসগোল্লা, বালুশাই আর অমৃতি কী যে প্রিয় ছিল
........বাজারে ঢুকেই ওসব তার চাই, তারপর অন্যসব কাজ।
........কখনও কখনও বাবা তার
........বহুদূর কোমরগঞ্জ কিংবা শিবরামপুর হাটে যেতেন। সকাল-দুপুর-
........বিকেল-সন্ধ্যা, পুরোটা দিন প্রতীক্ষায়
........তাকিয়ে থাকতো সে পথের পানে, যে-পথে প্রাণাধিক বাবা তার
........ফিরে আসবেন ঘরে। মাথার ঝাঁপিতে বাজারসওদা থাক বা না থাক
........তার জন্যে থাকবেই থাকবে মোড়কভর্তি বালুশাই, অমৃতি অথবা রসগোল্লা।
........কখনও সখনও প্রতীক্ষায় থেকে থেকে
........কখন ঘুমিয়ে যেতো বালক, আর্দ্র আঁখিকোণে অশ্রু শুকিয়ে
........হঠাত ঘুম ভাঙলে
........দেখতো, কুপি হাতে অদূরে তার মা, তন্দ্রায় ঢুলুঢুলু
........নিজেকে করতো আবিষ্কার বাবার কোলে.....হাঁটু ভেঙ্গে গুটিসুটি,
........বাবার হাসিমুখ, ডানহাতে মুখের সামনে মস্তবড় বালুশাই এক
........'ঘুমাইয়া গ্যাছাও বাজান? বালুশাই খাও।
........খালি খালি দেরি হয় আজকাল।'
আমার বাবাকে আমার কৈশোরে দেখি, আমার বিরক্ত ও কঠিন
এবং নিষ্ঠুর অবয়বে নেমে আসে কী এক করুণ মমতা। সহসা
আমি বাবা হয়ে যাই
আর
বাবা যেন একটি কিশোর, আমার সেই কিশোরবেলার মতো :
ঠিক আমার ছেলেমেয়ে দুটোর মতো
আমার হাত ধরে ধরে বাজারময় হাঁটবেন বাবা
পছন্দের কিছু দেখলেই বলবেন, 'জিনিসটা খুব সুন্দর বানাইছে বাজান।
এইখানে ভালো পায়জামা পাওয়া যায়? একটা তসবির দরকার।
দাঁড়াও, তোমার মা'র জন্য একখানি পানদানি কিন্যা লও।'
আমি বাবা হয়ে যাই আমার বাবার। তারপর তাঁর কঙ্কালসার পিঠে
আমার নরম হাত রেখে বলি: 'বাজারে যাবে তো আগেই বলো নি কেন?
তাড়াতাড়ি তৈরি হও।' মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে
পায়জামা খোঁজেন, পাঞ্জাবি খোঁজেন
চটিজুতো খোঁজেন আমার বাবাকিশোর।
আমি এক ধ্যানে
আমার পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কৈশোরের দিকে তাকিয়ে থাকি।
***২০০৩
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সকাল ১১:৪৮