গত উইকেন্ডে আমরা গিয়েছিলাম একটা ঝরণার ছবি তুলতে। জাপানি এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম এই ঝরণাটার কথা। জাপানে আপনি যেকোন ঘোরার জায়গাতে যান না কেন মানুষের ভীড় থাকবেই। কিন্তু তার কাছে শুনেছি যে ঝরণাটা একদম নিরিবিলি। সেখানে নাকি মানুষের দেখাই পাওয়া যায়না। আপনাদের ভাবীতো শুনে মহাখুশি। কারণ একটাদিন মানুষের ভীড় ছেড়ে নিজেদের মতো থাকা যাবে। তাই গত শনিবার গিয়েছিলাম সেই ঝরণা দেখতে।
যাওয়ার আগেরদিন অনেক খুঁজেও গুগল ম্যাপে যাওয়ার রুট খুঁজে পেলাম না। সত্যি কথা বলতে কি ঝরণাটারই কোন খোঁজ পেলাম না ম্যাপে। কিন্তু জায়গাটার একটা নাম যেহেতু আছে তাই জায়গার নাম দেখেই পরদিন আমরা রওনা হলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সাথে দুপুরের খাবার দাবার, ছোট তাবু আর ঝরণার পানিতে মাছ ধরার জন্য আমার মেয়ের ছোট একটা জাল। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো সেখানে গিয়ে। স্থানীয় অনেককে জিজ্ঞেস করার পরও কেউ পুরোপুরি বলতে পারলোনা কোথায় সেই ঝরণা। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে যখন কোন মতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন আমরা গাড়ি থামিয়ে গুগল ম্যাপে দেখা শুরু করলাম কাছাকাছি ঘুরতে যাওয়ার মত অন্য আর কি আছে। ঠিক তখনই একটা বছর পঁচিশের জাপানী মেয়ে আমাদের গাড়ির কাছে আসলো। জিজ্ঞেস করলো আমরা হারিয়ে গেছি কিনা। আমরা বললাম যে ঠিক হারিয়ে যাইনি কিন্তু আমরা আসলে এসেছি একটা জায়গা খুঁজতে। ঝরণাটার কথা বলতেই দেখলাম মেয়েটি বললো যে সে জায়গাটি চিনে এবং আমরা চাইলে সে আমাদের সাথে সেখানে যেতে পারে। একথা শুনে আমরা একটু অবাক হলাম। ভদ্র এবং বিনয়ী হিসেবে জাপানিরা প্রথম সারির দিকে এর প্রমাণ জাপানে এসেই আমরা পেয়েছি। কিন্তু এও জানি জাপানিরা প্রচন্ড লাজুক টাইপের হয়। আপনাকে সাহায্য করার জন্য জান দিয়ে দিবে সে ঠিক আছে। কিন্তু আপনাকে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনার গাড়িতে উঠে পড়বে এতটা মিশুক জাপানিরা এখনো হয়নি।
সে যাই হোক। তাকে গাড়িতে উঠিয়ে আমরা ঝরণাটার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। একসময় তার নির্দেশিত পথে যেতে যেতে আমরা কালো পিচের মসৃণ রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের পুরোন রাস্তায় এসে পড়লাম। একসময় দেখলাম পুরোন রাস্তাও শেষ। পাথর আর শুকনো মাটির তৈরি রাস্তায় এসে আমি একটু ভীত হয়ে পরলাম। কারণ এদেশে যে এমন রাস্তা আছে তাই আমার জানা ছিল না। শেষ মেষ আমরা অবশ্য ঝরণার কাছাকাছি এসে পড়লাম। গাড়ি পার্ক করে মোবাইলে দেখলাম প্রায় চারটা বাজে। দুপূর গড়িয়ে বিকেল হয়ে পড়ছে।
প্রথমেই আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম। মেয়েটির নাম ইহারা, ইহারা মিয়ামোতো। তাকে বললাম আমাদের সাথে খাওয়ার জন্য। অনেক চাপাচাপির পর সে একটু খানি খেল আমাদের সাথে। তারপর আমরা রওনা হলাম পাহাড়ি নদীর ধার ঘেঁষে, মূল ঝরণাটার খোঁজে। প্রায় চল্লিশ মিনিট হাঁটার পর আমরা ঝরণাটার কাছে পোঁছালাম। ঝরণা দেখে আমরা একদম থ। এত সুন্দর ঝরণা আমরা আগে কখনো দেখিনি। আর পুরো জায়গাটাতে আমরা শুধু চারজন। আমি, কণা (আপনাদের ভাবী), আমার মেয়ে মেঘ আর ইহারা।
বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমি ছবি তোলার জন্য মরিয়া হয়ে গেলাম। উপরের পাহাড় থেকে ছবি তুললে ছবিটা দারুন আসবে। কিন্তু পাহাড়ে উঠার কথা শুনে কণা বেঁকে বসল। তাই ওদেরকে সেখানে রেখেই আমি একা পাহাড়ে উঠে গেলাম। অনেক কষ্টে দুইটা ছবি তুলতে না তুলতে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসলো। আসলে পাহাড়ী এলাকায় খুব দ্রুত অন্ধকার নামে। ঝটপট ছবি তুলে নীচে নেমে দেখি কণা আর মেঘ বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম ইহারা কোথায়। শুনে কণা আকাশ থেকে পড়লো। বললো আমি পাহাড়ে উঠার একটু পরই ইহারা কণাকে বলেছিল যে সেও ঝরণাটা উপর থেকে দেখবে। তাই আমার পিছে পিছে নাকি সেও গিয়েছিল। কিন্তু আমি তো তাকে দেখালাম না পাহাড়ের উপর! মনে মনে আমি একটু বিরক্ত হলাম। একে তো রাত হয়ে এসেছে, তার উপর চিনি না জানি না একটা মেয়ে একা আমাদের সাথে এই জনশূন্য জায়গায় এসেছে। ইহারার কিছু হলে আমরা কি করবো!
আমরা চিৎকার করে ইহারাকে ডাকতে লাগলাম। প্রায় দশমিনিট ডাকাডাকির পর যখন আমরা তার কাছ থেকে কোন উত্তর পেলাম না তখন প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। তাবু গুছিয়ে আমরা গাড়ির কাছে চলে আসলাম এই চিন্তা করে যে যদি ইহারা গাড়ির কাছে এসে থাকে। কিন্তু এখানেও তাকে পেলাম না। মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করলাম প্রথমেই আমাদের লোকালয়ে যেতে হবে। পুলিশকে সব কিছু খুলে বলতে হবে। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে যেই না গাড়ির হেড লাইট জালিয়েছি অমনি একটা নোটিশ বোর্ড চোখে পড়ল। ঝরণাটার নাম, বিবরণ ইত্যাদি। গাড়ি থেকে নেমে কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম ঝরণাটার নাম কাকিজোরে। নোটিশ বোর্ডে আরেকটি আলাদা কাগজে একটা মিসিং রিপোর্ট লেখা।
নাম-ইহারা মিয়ামোতো।
বয়স- পঁচিশ।
হারানোর তারিখ- ১৪ মে, ২০১২।
ছবিটি দেখে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। প্রায় পাঁচ বছর আগে ইহারা এখানে এসে হারিয়ে গিয়েছিল। আমি আর কিছু চিন্তা না করে দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। এর পর আমি কিভাবে সেখান থেকে গাড়ি চালিয়ে লোকালয়ে ফিরেছি সেটা আরেকদিন বলবো।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৭ দুপুর ২:৪৫