আরো একটি বিষন্ন বিকেল পার করলাম। পুরো বিকেল জুড়েই ছিল ‘কনে দেখা’ রোদ। নামটা আমার কাছে যথার্থ মনে হয়না। বরং বিষন্ন রোদ বলে ডাকলেই মনে হয় মানাতো। সারাদিনের প্রখর রোদ বিলিয়ে দেওয়ার পর সূর্যটাও যেন বিষন্ন মন নিয়ে ডুবে যাচ্ছে। আর যাওয়ার সময় কিছু কিছু মানুষের মনটাকে বিষন্নতায় ডুবিয়ে যাচ্ছে।
মাঝে মাঝে মনে হয় কি দরকার এত কষ্ট করার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাটছি শুধুমাত্র একটি ডিগ্রীর জন্য। নিজের দেশ ফেলে সম্পূর্ণ নতুন একটা দেশে পরে আছি। এদেশের মানুষগুলোকে মনে হয় রবোট। কোন প্রাণের উচ্ছ্বাস নেই, মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। কেউ আপনার উপর খুশি নাকি বিরক্ত, রেগে আছে নাকি রেগে নেই কিছুই বোঝা যায়না এদের দেখলে। সারাদিন খালি কাজ আর কাজ। তাও যদি খুব ভাল আউটপুট থাকতো! রাস্তা দিকে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। স্কুল ছুটির পর ছেলে মেয়েরা বাড়ি ফিরছে। ৫-৬ বছরের ছেলে মেয়েরা কিছুটা লাফিয়ে কুঁদিয়ে জানান দিচ্ছে নিজেদের মানুষ বলে। কিন্তু এর থেকে বড় ছেলে মেয়েগুলো সব একা একা বাড়ি ফিরছে। কারো সাথে কোন কথা নেই। বুড়ো অথবা বুড়ীরাও একা একা যাচ্ছে। পার্থক্য শুধু কারো কারো সাথে কুকুর আছে। এদেশের কুকুরগুলোও খুব কম ডাকে। রাস্তায় এত এত কুকুর, কিন্তু ডাক শোনা যায় খুব কম।
মাঝে মাঝে জীবনের মানে খুঁজে পাইনা। মনে হয় আমি বড় অভাগা। মনে মনে ভাবি ঠিক এরকম একটি বিকেল যদি আমি পার করতাম কোন গ্রামে, যেখানে জীবন খুব জটিল নয়, জীবনের অংক শুধু দুইয়ে দুইয়ে চার। কি ভাল হত। শীত আসি আসি করছে। সারাদিন ক্ষেতে কাজ করে বা ভ্যান টেনে বিকেলে ভাত খেয়ে কোন খোলা ক্ষেতের পাশে বসে বসে এই রোদ দেখছি। তখনো কি মনটা এত বিষন্ন হত?
অথবা খুব বড়লোকের ছেলে আমি। বাবার টাকা পয়সা শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু এতটুকুও কমাতে পারছিনা। হয়তো বিকেলের এই রোদ দেখে প্রেয়সীকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বেরিয়ে পড়লাম। কোন ব্রীজের উপর গাড়ি পার্ক করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই রোদ দেখছি। তখন নিশ্চয়ই মনটা এত বিষন্ন হতোনা।
মাথায় নানা রকম চিন্তা ঘোরে, কিন্তু জীবনকে আর কোন দিকে ঘুরিয়ে নেওয়া সম্ভবনা। সিস্টেমের ভিতর আটকে গেছি। পেছানোর উপায় নেই, নতুন করে শুরু করার উপায় নেই। ছেড়ে পালিয়ে বাঁচারও উপায় নেই। বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। মৃত্যুই এখন একমাত্র বাঁচার উপায়। যতদিন না মরি, সিস্টেমের ভিতর দিয়েই যেতে হবে। আবার মাঝে মাঝে চিন্তা করি, যে মানুষটি সিস্টেমের ফাঁদে পা দেয়নি সেও কি সুখে আছে। যে কোন বাঁধনেই জড়ায়নি, যার কোন দৈনন্দিন রুটিন নেই, যার আগামী দিনটি কেমন যাবে ঠিক নেই সেওকি বিষন্ন হয়না! হয়তো আমাদের মতো দশজন মানুষের সিস্টেমে সে নেই, কিন্তু সেও নিশ্চয়ই তার মত করে বানানো কোন সিস্টেমে বন্দী। হয়তো অগোছালো কোন সিস্টেমে।
এরকম সময় অবশ্য বেশিক্ষণ থাকেনা। এই যেমন এখন রোদটাও নেই, আমার মনের বিষন্নতাটাও নেই। কিছুক্ষণ পরই ল্যাবের কাজ শেষ করে বাড়ি যাব। বাড়িতে আমার মেয়ে আর স্ত্রী অপেক্ষায় আছে। কাল একটা সরকারী ছুটি। রাতে বিরানী রান্না হবে। আসার সময় একটা কোক নিয়ে যেতে বলেছে। যদিও আমরা সবাই সিস্টেমের ভিতর। কিন্তু তারপরও জীবনটা আসলে খুব একটা খারাপ না।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:২১